শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শিরোনাম

আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন মোশতাক  

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১১, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ঢাকা: খন্দকার মোশতাক আহমেদ নভেম্বরের টালমাটাল পরিস্থিতির সময় বঙ্গবন্ধুর খুনি ও তার নিজের জন্য আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় খালেদ মোশারফের বিরুদ্ধে আমেরিকার সাহায্যও কামনা করেন। পুরানো সর্ম্পকের দাবি নিয়ে তিনি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দেন।

তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি এ রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাব পাওয়ার পর আমেরিকার পক্ষ থেকে মোশতাক আসতে চাইলে তাকে স্বাগত জনানো হবে বলে জানানো হয়। বলা হয়, তার জীবনের যদি আশু বিপদ থাকে তাহলে তাকে তাদের দূতাবাসেও সামরিক আশ্রয় দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হবে। মোস্তাকের মূখ্যসচিব মাহবুবুল আলম চাষী রাষ্ট্রদূত রোস্টারের কাছে টেলিফোনে এ প্রস্তাব রাখেন। খুনি ফারুক ও রশিদের জন্যও এমন আশ্রয় খুঁজছিলেন তিনি।

আমেরিকান সাংবাদিক লেখক বিজেড খসরুর ইংরেজিতে লেখা ‘বাংলাদেশে মিলিটারি ক্যু সিআইএ  লিঙ্ক’ গ্রন্থে এ সর্ম্পকে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। বাংলাদেশে ‘দি ইউনিভার্সেল একাডেমি’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে।

১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর রাত সাড়ে দশটায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের বিশেষ বিমানে উড়ে ব্যাংকক চলে যায়। তাদের এ চলে যাওয়ার সব ধরনের ব্যবস্থা করে দেয় প্রেসিডেন্টের সচিবালয়। এর আগে খালেদ মোশারফ  শাফায়েত জামিল, হাফিজ ইকবাল, স্কোয়ার্ডন লিডার লিয়াকত গোপন বৈঠক করেন। বৈঠক থেকে বের হয়ে এসে খালেদ মোশারফ ডালিমকে পরিস্কার জানিয়ে দেন মোশতাকের স্থলে প্রধান বিচারপতি নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন। অন্য দিকে, ১৫ আগস্টের সেনা নেতৃত্বকেও সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু মোশতাক তাদের বিদেশ পাঠানোর জন্য খালেদ মোশারফের সাথে সমঝোতা করতে চেষ্টা চালিয়ে যান। বলা যেতে পারে, মোশতাকের ভাগ্য ও ভবিষ্যত তখন থেকেই সুতার উপর ঝুলতে থাকে। ঠিক তখন তার মূখ্য সচিব মাহবুবুল আলম চাষী কথা বলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সাথে।

 বিজেড খসরু এ নিয়ে লিখেন, ‘৩ নভেম্বর দুইটা ২০ মিনিটে মাহবুবুল আলম চাষী বোস্টারকে টেলিফোনে বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট (মোশতাক) তাকে জানাতে বলেছেন, যদি অবস্থা এমন হয় যে, কারো রাজনৈতিক আশ্রয়ের দরকার, তাহলে তার ব্যবন্থা করা যাবে কিনা। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক ও রশিদের জন্য এমন আশ্রয় খুঁজছিলেন তিনি। তবে এক পর্যায়ে তিনি এ কথাও জানাতে চান যে, ঐ দুইজন ছাড়াও প্রেসিডেন্টের জন্যও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রয়োজন হতে পারে। বোস্টার বিশ্বাস করে ওঠতে পারেন নি, তাই আবার বলেন, আবার বলবেন কি ? চাষী আবার বলেন, প্রেসিডেন্ট নিজেও রাজনৈতিক আশ্রয়ের ইচ্ছা ব্যক্ত করতে পারেন।’ জবাবে বোস্টার জানান, বিদেশীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া তাদের স্বাভাবিক কোন রীতি নয়। তবে তিনি ওয়াশিংটনে যোগাযোগ করে জানাবেন। এ সময় চাষী জানান সময় খুব কম। বোস্টার তখন সময়সীমা জানতে চান। চাষী বলেন, ৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা ১৮ মিনিট ওয়াশিংটন সময়। পাঁচ মিনিট পর মাহবুবুল আলম চাষী আবারো বোস্টারকে ফোন করে জানান, খালেদ মোশারফের বাহিনীর সাথে সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে। ঐ সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে। বোস্টার চাষীর কাছে জানতে চান, তিনি আর কোন শক্তিধর দেশকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন কিনা। চাষী নেতিবাচক জবাব দিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্টের (মোশতাক) সরকারের প্রতি অতীতে আপনাদের সহানুভূতির বিবেচনায় আপনাদেরকেই এ বিষয়ে অনুরোধ করা যাচ্ছে, অন্য কাউকে নয়। অন্য প্রান্ত থেকে বোস্টার জানান, সময়তো খুবেই কম। বোস্টার তখনো ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারের জবাবের জন্য অপেক্ষায় আছেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দেশ ত্যাগ করেন। বোস্টার চাষীকে ফোন করে জানতে চাইলেন, মেজরদের দেশ ত্যাগের পর আর আমেরিকায় আশ্রয় দেয়ার ঐ অনুরোধ বহাল আছে কিনা। চাষী বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের বিষয়টি বহাল আছে। নির্ভর করবে ‘যারা দেশ শাসন করবে’ তাদের সাথে সমঝোতার উপর। বোস্টার এ বিষয়টি একটু বুঝতে চাইলেন। চাষী বলেন, ‘তিনি এর বেশি কিছু বলার মত অবস্থায় নেই।’

মোশতাকের আশ্রয় বিষয়ে অবশেষে কিসিঞ্জারের কাছ থেকে জবাব পান বোস্টার। কিসিঞ্জার বোস্টারকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট মোশতাককে আপনি আশ্বস্ত করেন যে, আমেরিকার সরকার তার ব্যক্তিগত কল্যাণের বিষয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছে। আমরা খুশি হয়েছি যে, সঙ্কটের সমঝোতা হযেছে ও রক্তপাত এড়ানো গেছে। আপনি তাকে বলতে পারেন যে, তিনি আমেরিকায় আসতে চাইলে  তাকে স্বাগত জানানো হবে। আপনি ইচ্ছা করলে বলতে পারেন যে, তার জীবনের যদি আশু বিপদ থাকে, তাহলে তাকে আমাদের দূতাবাসে সাময়িক আশ্রয় দেয়ার প্রস্তুতি নেব।’

এর আগে ৩ নভেম্বর দিনের প্রথমভাগেই খালেদ মোশারফের বিরুদ্ধে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাহায্য চান প্রেসিডেন্ট মোশতাক। তিনি সকাল আটটা দশ মিনিটে আমেরিকান রাস্ট্রদূতকে ফোন করে বলেন, ‘খালেদ মোশারফ সমস্যা তৈরি করেছে। রাষ্ট্রদূত বোস্টার জানতে চান, খালেদ মোশারফ সফল হয়েছে কিনা। প্রেসিডেন্ট তাকে জানান, মোশারফ সেনা প্রধান হতে চান ও আরো দুই-তিনটি বিষয়ে দাবি আছে তার। এ নিয়ে কথা বলার জন্য মোশতাক তাকে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু মোশারফ তাতে রাজি না হয়ে মিগ যুদ্ধ বিমান আকাশে উড়িয়ে তার শক্তি প্রদর্শন করছেন। এ নিয়ে বিজেড খসরু লিখেন, খালেদ মোশারফের সমর্থনকারীরা খুব দ্রুত ক্যন্টনমেন্টের নিয়ন্ত্রন গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। তারা তখন একটি রাশিয়ান মিগ যুদ্ধবিমান ও অস্ত্রধারী একটি হেলিকপ্টার সারা শহরে উড়িয়ে শক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। এ অবস্থায় মোশতাক কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সেনা বাহিনীর সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হন। আর এ উত্তপ্ত অবস্থার মাঝে আওয়ামী লীগে মোশতাকের শত্রু বলে পরিচিত জাতীয় চার নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সাবেক শিল্প মন্ত্রী কামরুজ্জামান জেল খানায় নিহত হন। যা প্রকাশ হয় অনেক পরে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে জেলখানায় ঘটনা নিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরপরই জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি এমনভাবে নেয়া হয়েছিল, পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সাথে সাথে যাতে আপনা আপনি এটি কার্যকর হয়। আর এ কাজের জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি ঘাতক দলও গঠন করা হয়। এ ঘাতক দলের প্রতি নির্দেশ ছিল পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সাথে সাথে কোন নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করবে। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার সবচাইতে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক সদস্য হিসেবে পরিচিত ও তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ও বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি বরখাস্তকৃত কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ এ পরিকল্পনা করেন।

সিএন/এমএ

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন