সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪

শিরোনাম

কওমি সনদের স্বীকৃতির ফল পেতে হলে আরও তিনটি স্তরের মান প্রয়োজন!

মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

ড. হুমায়ুন কবির

কওমি মাদরাসা মূলত ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ মাদরাসার আলোকে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে কুরআন-হাদিছের মূলধারার শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদরাসা রয়েছে। কওমি মাদরাসায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০০৯ সাল থেকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলিমদের সঙ্গে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, সেটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা শিক্ষানীতিতেও স্থান পায়। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে ১৩ হাজার ৯০২ টি কওমি মাদরাসায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। সে সময় কওমী শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১৩ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) এর নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে সরকার। ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটিতে সচিব ছিলেন গওহারডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমিন। বর্তমানে বাংলাদেশে আলিয়া মাদরাসা, কওমি মাদরাসা এবং স্বতন্ত্র বা প্রাইভেট মাদরাসা নামে তিন ধারার মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ১৭৮০ সালে কলাকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গে আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার ধারা এবং ১৯০১ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা ধারার প্রচলন হয়। আর দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৬৬ সালের ১৩ মে দেওবন্দ, সাহারানপুর, উত্তর প্রদেশ ভারতে। প্রতিষ্ঠা করেন কাসেম নানুতবি (রহ.) ও সাথে ছিলেন মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী ও হাজি সায়ীদ আবিদ হুসাইন (রহ.)।

কওমি মাদ্রাসার পরিচয়:
কওমি মাদরাসা অর্থ কওম শব্দের অর্থ জাতি তাই কওমি মাদরাসা অর্থ জাতীয় মাদরাসা তথা বিভিন্ন জাতি বা গোত্রের অনুদানে পরিচালিত জাতির দ্বীনের কল্যাণময় প্রতিষ্ঠান। আর “আল-হাইআতুল উলয়া ললি-জাময়িাতলি কওময়িা বাংলাদশে” অর্থ বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা সর্বোচ্চ কমিশন।

স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট:
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল গনভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলিমদের সাথে মতবিনিময় সভা করেন। এর দুইদিন পরে ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকৃতির ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিছের (তাকমীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিলটি সংসদে উপস্থাপন করলে একই বছর ১৯ সেপ্টেম্বর তা কন্ঠভোটে তা সংসদে পাস হয়। প্রায় সোয়া দুইশ বছর পর স্বীকৃতি পেলো কওমি সনদ।নিয়মের বাইরে হলেও কওমি মাদরাসা স্বীকৃতি ঐতিহাসিক নিয়মের বাইরে বলার দুটি কারণ রয়েছে।

এক. ডিগ্রি ও মাস্টার্সের মান দেওয়া হয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। আর এখানে একটি বেসরকারী কমিশন বা সংস্থার তত্ত্বাবধানে দেওয়া হলো। তবে তা অযৌক্তিক নয়। কেননা, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মানও তো ইউজিসির মাধ্যমে। তাও তো একটি সংস্থা। তেমনি কলেজসমূহের মান দেওয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাধানে। আর তা নামে বিশ্ববিদ্যালয় কাজে সংস্থা। কেননা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো অনার্স মাস্টার্স নেই। তেমনি সকল আলিয়া মাদরাসার মান দেওয়া হয়েছে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। তাও নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে একটি কমিশন বা সংস্থা। কেননা, তাদের নিজস্ব কোনো অনার্স, মাস্টার্স কোর্স নেই। তাই বর্তমান যে কমিশনের তত্ত্বাধানে মান দেওয়া হলো তাও সেই রকম একটি কমিশন। যার নাম ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ বা বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা সব্বোর্চ কমিশন। তবে এর নাম পরিবর্তন করে ভবিষ্যতে “বাংলাদেশ কওমি বিশ্ববিদ্যালয়” করা যেতে পারে।

দুই. নিচের স্তরের মান না দিয়ে বা না নিয়ে সর্বোচ্চ স্তরের মান দেওয়া ও নেওয়া মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে তা নেই। তবে শুধুমাত্র দাওরায়ে হাদিছকে মাস্টার্সের মান দেওয়ার কারণে এই সনদ নিরানব্বই পার্সন স্থানে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে কওমী ধারার পড়ুয়া ছাত্ররা দেশীয় বিভিন্ন উচ্চ প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নেওয়া ও চাকরি ইত্যাদির সুবিধা পাচ্ছে না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সনদের ফল গ্রহণ করতে পারছে না। আলিয়া মাদরাসা ও কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রদের মত সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে হলে শর্ত সাপেক্ষে আরও তিনটি স্তরের মান প্রয়োজন। ১ম স্তর কাফিয়া বা জামাতে শাশুমকে দাখিল সমমান, শরহে বেকায়া বা ছাহারুমকে আলিম সমমান ও মেশকাত তথা উলা জামাতকে ডিগ্রির সমমান দিতে হবে ও নিতে হবে।

পাশাপাশি কাফিয়া জামাতে বর্তমান সিলেবাসের সাথে বাংলা, ইংরেজি ও অংক যোগ করতে হবে ও শরহে বেকায়াতে বাংলা ও ইংরেজি দুই সাবজেক্ট যোগ করতে হবে। বাকী মিশকাত জামাতে ও অন্যান্য জামাতে কোনো কিছু যোগ করার প্রয়োজন নেই। কাফিয়া ও শরহে বেকায়ার পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করবে বেফাকুল মাদারিস বাংলাদেশ ও মেশকাত ও দাওরায়ে হাদিছের পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করবে হাইয়া। চার স্তরের মান নিলে কওমী মাদরাসার ছাত্রদের দ্বীনি খিদমতের পরিধি ব্যাপক হবে ও দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নিচের মান না নিয়ে উপরে মান নেওয়া কতটুকু যুক্তি সংগত?

কওমি মাদরাসাকেন্দ্রীক একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই তাঁরা কওমি মাদরাসার নিচের স্তরের স্বীকৃতি চান না। এর আগে ২০১২ সালে সরকারের কাছে জমা দেওয়া কওমি মাদরাসা শিক্ষানীতিতে কওমির প্রাথমিক থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব স্তরের সুপারিশ করা হয়েছিল। সরকারেরও পরিকল্পনা তেমনটাই ছিল। একটি অংশের আপত্তির কারণে তা হয়নি। আমার মতে মানুষের এ ব্যাপারে সমালোচনা যুক্তিসংগত। কারণ নিচের স্তরের মান না নিয়ে উপরের মান নেওয়া যুক্তিসংগত নয়।

যতই যুক্তি দেওয়া হোক না কেন তা খোঁড়া যুক্তি। তাই নিচের স্তরের মান নেওয়া সময়ের ও তরুণ আলিমদের অপরিহার্য দাবি। মাদরাসায় ছাত্র কমে যাওয়ার কথা আমার মতে অযৌক্তিক। কেননা, কওমি মাদরাসায় যারা পড়ে তা আসলে মানতের ছাত্রের মত। কেউ নিজের একজন ছেলেকে আলিম বানানোর মানত বা নিয়ত করে তা থেকেই সে নিজের ছেলেকে কওমি মাদরাসায় ভর্তি করায়। তাই সে শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত করবে। আবার কিছু ছাত্র চলে যাওয়ার কথা সঠিক। তবে একথাও সঠিক নিচের স্তরের মান নিলে নিচে ছাত্রের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তাই কিছু ছাত্র চলে গেলেও সমস্যা নেই। আর আরব বিশ্বে প্রত্যেকটি স্তরের মান থাকার কারণে কি তাদের আলেম বের হচ্ছে না? তাদের থেকে আল্লাহওয়ালা বের হচ্ছে না? ইসলামিক স্কলার বের হচ্ছে না।

পৃথিবীর ৫২ টি মুসলিম রাষ্ট্রে তো সব স্তরের মান নিয়ে দক্ষ আলিম ও স্কলার বের হচ্ছে। আবার অনেকে সরকার সিলেবাসে হাত দেওয়ার ভয়ে নিচের স্তরের মান নেওয়ার পক্ষে নয়। তবে যদি কওমী কমিশন ছাড়া সরকার হাত না দেওয়ার শর্তে যদি মান নেওয়া হয় তখন এই ভয়ও চলে যাবে। আর যতদিন কওমী মাদরাসা সরকারের বেতন-ভাতা গ্রহণ করবে না ততদিন সরকার সিলেবাসে হাত দিতে পারবে না ইনশা আল্লাহ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক,
আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল: ০১৮১৫-৯২৫৭২৭

Views: 158

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন