শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শিরোনাম

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ৬ দফা প্রস্তাব তুলে ধরলেন শেখ হাসিনা

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১

প্রিন্ট করুন
pm20181002163955 2109211745 1
pm20181002163955 2109211745 1

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতিসংঘের সাধারণ পরিষেদের ৭৬ তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় তিনি এ ভাষণ দেন। দেশের সার্বিক মান-উন্নয়নে ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। এবার নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১৭তম বার অংশগ্রহণ করলেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচিত রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শেখ হাসিনা অন্যতম। গত বছর করোনা মহামারীর কারণে জাতিসংঘ অধিবেশনে স্বশরীরে অংশ নিতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দেওয়া ভাষণে করোনা মোকাবিলায় ভ্যাকসিন বৈষম্য, বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকট, আফগানিস্তান সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু, টেকসই উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্পর্কিত এবং তথ্য-প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।

ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাধারণ পরিষদের এই ৭৬তম অধিবেশনটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে অব্যাহতভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। করোনার নতুন ধরনের মাধ্যমে অনেক দেশ বার বার সংক্রমিত হচ্ছে। এ মহামারিতে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।’

বাংলাদেশের উন্নয়নের কয়েকটি দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপি-তে আমরা বিশ্বের ৪১তম। গত এক দশকে আমরা দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। এ সময়ে আমাদের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২,২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছি”। 

নারীর ক্ষমতায়ন সহ সামাজিক অন্যান্য সূচিতে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন,’ গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ কমে এসেছে। প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭৩-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ, ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ কর্মসূচির এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে। এ সাফল্যের মূলে রয়েছে নারীর উন্নতি ও ক্ষমতায়নে বিপুল বিনিয়োগ।’

এর সাথে যোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিভিন্ন সময়ে আমরা ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছি, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহের জন্য চলতি অর্থবছরে বাজেটে ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের সংস্থান রাখা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, এ যাবৎ উৎপাদিত টিকার ৮৪ শতাংশ উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের কাছে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, নিম্ন আয়ের দেশগুলো ১ শতাশেরও কম টিকা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অধিবেশনে তাঁর দেওয়া ভাষণে প্রথম প্রস্তাব রাখেন টিকার বৈষম্য নিয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। গত বছর এ মহতী অধিবেশনে আমি কোভিড-১৯ টিকাকে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। বিশ্বনেতাদের অনেকে তখন এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেছিলেন। সে আবেদনে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং আমরা ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে টিকা বৈষম্য বাড়তে দেখেছি। জরুরি ভিত্তিতে এ টিকা বৈষম্য দূর করতে হবে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।’ 

এর সাথে যোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে টিকা প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে। প্রযুক্তি সহায়তা ও মেধাস্বত্ত্বে ছাড় পেলে বাংলাদেশও ব্যাপক পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম।

দ্বিতীয় প্রস্তাব রাখেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা বিষয়ক। শেখ হাসিনা ভাষণে বলেন, এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে উঠা কঠিন হবে। ধনী অথবা দরিদ্র কোন দেশই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে নিরাপদ নয়। তাই আমি ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নিঃসরণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং টেকসই অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের আহ্বান জানাচ্ছি।

মহমারির প্রকোপে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি পূরণের জন্য তিনি ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করার জন্য জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তৃতীয় প্রস্তাবে।

চতুর্থ প্রস্তাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,’কোভিড-১৯ অতিমারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি। তবে, এ মহামারি অনেক দেশের উত্তরণের আকাংখাকে বিপন্ন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আমরা প্রণোদনা ভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরও সহায়তা আশা করি।

ভাষণের পঞ্চম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহামারিকালে অভিবাসী গ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার এবং তাঁদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানান।

রোহিঙ্গা সংকটের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ষষ্ঠ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন,’রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী আফগানিস্তানের সংকট তুলে ধরে বলেন, আফগানিস্তানের বিনির্মাণ এবং ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণ আফগানিস্তানের জনগণের উপরই নির্ভর করে। আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশটির জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে যেতে বাংলাদেশ সদা প্রস্তুত।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগের ঘাটতির বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে।একইসঙ্গে এটি বৈশ্বিক সংহতি ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার উপরেও আলোকপাত করেছে। সর্বজনীন বিষয়গুলোতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

উল্লেখ্য, ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জনের জন্য ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলুশান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন), গ্লোবাল মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনিস্টিউট ও সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পুরস্কার প্রদান করে। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের (ইউইনজিএ) উদ্বোধনী সেশনে অংশ নেন শেখ হাসিনা। ২৭ সেপ্টেম্বর এবারের ইউএনজিএ সমাপ্ত হয়েছে এবং আগামী ১ অক্টোবর ঢাকায় ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন