বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

ট্রাম্পের ‘গণ-নির্বাসন’ পরিকল্পনায় অভিবাসীদের ভয়, অর্থনৈতিক ক্ষতির শঙ্কা

রবিবার, নভেম্বর ১০, ২০২৪

প্রিন্ট করুন
ট্রাম্প

ইফতেখার ইসলাম: নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত গণ নির্বাসন পরিকল্পনার কারণে নিউইয়র্ক সিটির অভিবাসী সম্প্রদায়গুলোতে চরম ভীতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে ব্রুকলিন ও কুইন্সের মতো এলাকায় বসবাসকারী অনথিভুক্ত অভিবাসীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগে আছেন।

জানা গেছে, নিউইয়র্ক সিটিতে প্রায় ৪১ লাখ ২০ হাজার অনথিভুক্ত অভিবাসী বসবাস করছেন। এখানে অধিকাংশ অভিবাসী সুরক্ষিত থাকেন। সচরাচর ভয়াবহ কোন অপরাধ না করলে কাউকে নির্বাসিত করা হয় না। তবে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসী নীতি শঙ্কিত করছে লাখ লাখ অনথিভুক্ত অভিবাসীদের।

ইয়াতজিরি টোভার ব্রুকলিনে বসবাস করছেন। তার সাছে মা-বাবাও রয়েছেন। তারা প্রায় ৩০ বছর ধরে এখানে আছেন। তোভার বলেন, আমার বাবা-মা নিজেদের নিউইয়র্কবাসী হিসেবে মনে করেন, অন্য সবার মতো। কিন্তু এখন তারা আতঙ্কে আছেন। টোভার মনে করেন, ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অভিবাসন এজেন্টদের সক্রিয় করবেন এবং বিপুল সংখ্যক অনথিভুক্ত অভিবাসীকে বিতাড়িত করবেন।

টোভার বলেন, আমার বন্ধুদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরাও নথিভুক্ত নন। তাদের জন্যও ভয় লাগছে। কারণ আমরা জানি ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসীদের লক্ষ্যবস্তু করতে চায়।

এই আতঙ্ক ব্রুকলিনের বুশউইক ও কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। জনসন নামে কুইন্সের অপর এক বাসিন্দা বলেন, আমি ভীত! আমার সন্তান ও নাতি-নাতনি রয়েছে। আমি কঠোর পরিশ্রম করি। আমাদের নির্বাসন করা অন্যায় হবে।

নিউইয়র্ক সিটির ব্যবসায়ী ও সংগঠক ক্যাথরিন ওয়াইল্ড বলেন, অভিবাসীরা কর দিয়ে আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। প্রায়শই এখানে ১০-২০ বছর ধরে আইনি মর্যাদা ছাড়াই রয়েছেন। কোনো নীতি এই জনসংখ্যাকে বিঘ্নিত করলে তা আমাদের অর্থনীতি ও শহরের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।

বন্ধ হচ্ছে নিউইয়র্কের অভিবাসীদের ‘খাদ্য ভাউচার’

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামসের প্রশাসন ঘোষণা শহরের অভিবাসী পরিবারগুলির জন্য খাদ্য ভাউচার সরবরাহ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রোগ্রামটি শহরের হোটেলে আশ্রয় নেওয়া অভিবাসী পরিবারগুলোকে তাদের প্রয়োজনীয় খাবার ও দৈনন্দিন সামগ্রী কেনার জন্য প্রিপেইড ডেবিট কার্ড দিতো। তবে বছরের শেষ পর্যন্ত অভিবাসী পরিবারগুলোকে এই সুবিধা দেওয়া হবে এবং এরপর থেকে শহর কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে সরাসরি খাবার পৌঁছে দেবে।

মেয়র অ্যাডামস এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা আশ্রয়প্রার্থী প্রোগ্রামের জন্য আরও কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি প্রয়োগের লক্ষ্যে কাজ করছি। গত দুই বছরে ২ লাখ ২২ হাজারেরও বেশি অভিবাসীকে সহায়তা প্রদান এবং আশ্রয় ব্যবস্থাপনায় প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছি।

মেয়র অ্যাডামস এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে সাম্প্রতিক আলোচনার পর এমন সিদ্ধান্ত আসে। যেখানে তারা নিউইয়র্ক সিটির অবকাঠামো, জননিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। অ্যাডামস বলেন, নিউইয়র্ক সিটিকে এগিয়ে নিতে আমাদের অবশ্যই ফেডারেল প্রশাসনের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

এই প্রোগ্রামটি চালুর পর থেকে প্রায় ২ হাজার ৬শ অভিবাসী পরিবারকে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন ডলারের প্রিপেইড ডেবিট কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। চার সদস্যের একটি পরিবারকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩৫০ ডলার মূল্যের ভাউচার দেওয়া হয়। যা তাদের স্থানীয় বাজার থেকে খাবার কেনার সুযোগ করে দেয়।

অভিবাসী দিয়েই গড়া যুক্তরাষ্ট্র, ফেরত পাঠালে ধস নামতে পারে অর্থনীতিতে

অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের অভিভাবক অভিবাসিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী শক্তির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, স্বাস্থ্যখাত এবং প্রযুক্তি শিল্পে অভিবাসীদের ভূমিকা অপরিসীম। যদিও রাজনৈতিকভাবে অভিবাসন একটি বিতর্কিত ইস্যু, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ‘অভিবাসন নীতি’আরও কঠোর হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভয়ের মধ্যে আছেন লাখ লাখ নথিহীন অভিবাসী। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, অভিবাসীদের ফেরত পাঠালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামতে পারে।

২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪.৭৮ কোটি অভিবাসী বাস করছেন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪.৩ শতাংশ। তালিকায় সবার প্রথমে রয়েছে মেক্সিকো থেকে আসা মানুষ। সেখানকার এক কোটি ছয় লক্ষ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। অন্যদিকে, সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ২৮ লক্ষ এবং চীন থেকে আসা মানুষের সংখ্যা ২৫ লক্ষ।

এই অভিবাসীরা শুধু শ্রমশক্তি হিসেবে নয়, দেশের উদ্ভাবনী শক্তি, কর রাজস্ব এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, অভিবাসীদের সংখ্যা কমলে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু জিডিপি ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অর্থাৎ, অভিবাসীদের বাদ দিলে দেশটির অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি, নির্মাণ, স্বাস্থ্য এবং প্রযুক্তি খাতগুলোতে অভিবাসী শ্রমিকদের অনুপস্থিতি পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খাতের ৭০ শতাংশ শ্রমিকই অভিবাসী এবং এরা সাধারণত কম বয়সী, শক্তিশালী শ্রমশক্তি প্রদান করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যবসাগুলোর ৪৫ শতাংশই অভিবাসী বা তাদের সন্তানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জিওভান্নি পেরি বলছেন, অভিবাসীরা নতুন ব্যবসা তৈরি করে, উচ্চ প্রযুক্তির উদ্ভাবন আনতে সহায়তা করে এবং কর পরিশোধের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বৃদ্ধি করেন। ২০২২ সালে অভিবাসী পরিবারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মোট করের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ জমা দিয়েছে। তবে, কিছু রাজনীতিবিদ ও নাগরিক অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে, তাদের মতে এটি দেশে শ্রমবাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।

আমেরিকান ইমিগ্র্যান্ট কাউন্সিলের (এআইসি) গবেষণা নির্দেশকের দায়িত্বে রয়েছেন নান ব্যু। তিনি অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটা সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। তার মতে, অভিবাসীদের সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো কৃষিকাজ করা, ফল এবং শাক সবজি তোলা আর উৎসবের মৌসুমে ক্রমবর্ধমান বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক পাবেন না ক্ষেতের মালিকরা।

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতামত, অভিবাসন যদি কঠোরভাবে সীমিত করা হয় বা অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তা গভীর প্রভাব ফেলবে। অনেকের মতে, এটি শুধুমাত্র শ্রমিক সরবরাহকেই সংকুচিত করবে না বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকেও বিপন্ন করতে পারে।

অর্থনীতির এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে, অভিবাসন সংক্রান্ত নীতি ও সমাধান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতাদের আরও যুক্তিসঙ্গত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রসঙ্গত, দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারে অভিবাসনকে তার এজেন্ডার শীর্ষে রেখেছিলেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প অঙ্গীকার করেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম দিনেই তিনি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবৈধ অভিবাসী বহিষ্কার অভিযান শুরু করবেন।

এদিকে নির্বাচিত হতে গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প একটি গণ নির্বাসন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, আমার প্রথম কার্যদিবস থেকে আক্রমনাত্মক অভিবাসন নীতি প্রয়োগে অভিযান শুরু করা হবে। তখন থেকে বিষয়টি নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন সংক্রান্ত আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের এই নির্দেশনা মার্কিন সংবিধানবিরোধী এবং যদি ক্ষমতা গ্রহণের পর সত্যিই এই নির্দেশনা কার্যকর হয়, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘনের মতো গুরুতর ঘটনা ঘটবে।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন