ইফতেখার ইসলাম: যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ট্রাম্প। এ ঘটনায় হামলাকারীসহ ২ জন নিহত হয়েছেন, আরেকজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শনিবার (১৩ জুলাই) সন্ধ্যায় পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে এ ঘটনা ঘটে। রোববার (১৪ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
হামলার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা গেছে হামলায় ট্রাম্পের কান ও মুখমন্ডল বেয়ে রক্ত পড়ছে। এরপর দ্রুত পাশে থাকা এক গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাম্পকে। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। তার প্রচার শিবির জানিয়ছে, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সুস্থ আছেন। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, পেনসিলভানিয়ায় সহিংসতার ঘটনায় সবার নিন্দা জানানো উচিত।
বাইডেন আরও বলেছেন, হামলা সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। শিগগিরই ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে তার খোঁজখবর নিতে পারবেন বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এ ধরনের ঘটনা ঘটতেে দিতে পারি না। আমরা এটা সহ্য করতে পারি না’
এক্সে এক পোস্টে সিনেটের শীর্ষ ডেমোক্র্যাট চাক শুমার বলেছেন, পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের সমাবেশে যা ঘটেছে তাতে তিনি আতঙ্কিত। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিরাপদে আছেন বলে স্বস্তি বোধ করছেন।
ট্রাম্পের ওপর হামলা: যা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে রিকো এলমোর নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, শনিবারের ওই হামলার পর তিনি ব্যারিকেড টপকে এক ব্যক্তিকে সেবা দিতে থাকেন। হামলার পর ওই ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। পরে যখন তিনি সেখান থেকে সরে আসেন, তখনও তার সাদা শার্টে রক্ত লেগেছিল। রিকো জানান, তিনি ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে চিনতেন না বলেও জানান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র ও একজন পুলিশের কর্মকর্তা জানান, একটি ভবনের ছাদের ওপর থেকে হামলা চালানো হয়। ওই ভবনটি সমাবেশস্থলের ঠিক বাইরে ছিল। সূত্র জানায়, হামলার পরপরই ভবনটিতে ব্যাপক পরিমাণ পুলিশের উপস্থিতির কথা জানায় সিএনএন। ট্রাম্প যে পজিশনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, সেই অবস্থান থেকে ভবনটি তার ডান দিকে ছিল।
সমাবেশস্থলে সামনের সারিতে বসেছিলেন সিনেটে রিপাবলিকান প্রার্থী ডেভ ম্যাককরমিক। তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের ওপর তাৎক্ষণিক হামলা’ হতে দেখেছি। তার পেছনে এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়। এই রাজনীতিবিদ বলেন, ট্রাম্প একটু আগেই আমার নাম ঘোষণা করেন। তিনি আমাকে মঞ্চে ওঠার আহ্বান জানান। এর প্রায় এক মিনিট পর ‘সাত থেকে আটটি’ গুলির শব্দ শুনতে পাই। সিক্রেট সার্ভিস তাৎক্ষণিক ট্রাম্পকে ঘিরে ধরে বলেও জানান তিনি।
জোসেফ মেয়ন নামে একজনের পাশেই এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। তিনি সিএনএনকে জানান, খুবই চমকে ওঠার মতো ঘটনা। অনেকেই ভেবেছিল আতশবাজি হচ্ছে। কিন্তু আমি তখনই বুঝেছিলাম এটা বন্দুকের গুলির শব্দ। মেয়ন পেশায় একজন সার্জন। তিনি জানান, আহত ব্যক্তিকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিতে সাহায্য করেন তিনি। মেয়নের ভাষায়, মাত্র দুই থেকে তিন সেকেন্ডের মধ্যে সাতটি গুলির শব্দ শুনতে পান তিনি।
ট্রাম্পের ওপর হামলাকারী কে?

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, ট্রাম্পের ওপর হামলাকারীর পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইন্টিলিজেন্স (এফবিআই) তার পরিচয় শনাক্ত করেছে।
বিবিসি জানিয়েছে, হামলাকারীর নাম থমাস ম্যাথিউ ক্রুকস। ২০ বছর বয়সী এ সন্দেহভাজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
এফবিআই জানিয়েছে, সন্দেহভাজন এ হামলাকারী ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশ থেকে মাত্র ১২০ মিটার দূরে একটি বাড়ির ছাদে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন।
ট্রাম্পের সর্বশেষ অবস্থা

হামলার পর সামাজিক প্লাটফর্ম ট্রুথে একটি পোস্ট করেছেন সাবেক এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প জানান, হামলাকারী নিহত হয়েছেন।
ট্রাম্প জানান, আমার ডান কানের উপরের অংশে গুলি লেগেছে। আমি তাৎক্ষণিক বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা উল্টোপাল্টা ঘটতে চলেছে। আমি তখন ঝাঁকুনির শব্দ আর গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং সাথে সাথে বুলেটটি ত্বক ছিঁড়ে গেল। এ সময় আমার অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, তাই বুঝতে পারলাম কি হচ্ছে। ঈশ্বর আমেরিকার আশীর্বাদ করুন!
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, হামলার পরপরই তাকে দ্রুত পাশে থাকা একটি গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ট্রাম্পের প্রচার শিবির জানিয়েছে, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সুস্থ আছেন। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সমাবেশে হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করায় সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। এছাড়া গুলিতে নিহত সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের প্রতিও সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, পেনসিলভানিয়ায় সহিংসতার ঘটনায় সবার নিন্দা জানানো উচিত।
হামলার শিকার হয়েছিলেন আরও যারা

কেবল ট্রাম্পই নন, বেশ কয়েকজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এছাড়া হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল আরও বেশ কয়েকজনকে। তবে তারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট অ্যান্দ্রো জ্যাকসন : সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্দ্রো জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তিনি হত্যাচেষ্টার শিকার হন। এ সময় তাকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি ছোড়া হয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
থিওডোর রুজভেল্ট : ডোনাল্ড ট্রাম্পের ন্যায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। ১৯১২ সালে নির্বাচনী প্রচারণাকালে তাকে গুলি করা হয়। এক সেলুনের কর্মী তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেন।
হামলার পর রুজভেল্ট বলেন, তার সঙ্গে থাকা ৫০ পৃষ্ঠার বক্তৃতার অনুলিপি বুলেটটিকে ধীরগতির করে দেয়। এটি তাকে নিজের শরীরে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। হামলার পরও সমাবেশে বক্তব্য দেন তিনি।
ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট : সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৯৩৩ সালে হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। এ সময় তিনি হামলা থেকে কোনোক্রমে রক্ষা পেলেও শিকাগোর মেয়র আন্তন সেরমাক গুলিতে নিহত হন।
হ্যারি এস ট্রুম্যান : ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের পর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন হ্যারি এস ট্রুম্যান। ১৯৫০ সালে তিনিও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। পুয়ের্তো রিকান জাতীয়তাবাদীরা তাকে লক্ষ্য করে বন্দুক হামলা চালিয়েছিল।
জর্জ ওয়ালেস : যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যের চার বার নির্বাচিত গভর্নর ছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। এ সময় ওয়াশিংটন ডিসির বাইরে একটি নির্বাচনী প্রচারণায় তাকে গুলি করা হয়। এর ফলে তিনি প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন।
জেরাল্ড ফোর্ড : সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৫ সালের দুবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। এরমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে হামলার আগেই একবার তা রুখে দেওয়া হয়। এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর সান ফ্রান্সিসকোতেও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তবে সেবার এক পথচারীর কারণে তিনি বেঁচে যান।
রোনাল্ড রিগান : ১৯৮১ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে হিলটনের বাইরে একটি বক্তৃতা দেওয়ার পরে গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় তার প্রেস সেক্রেটারি জেমস ব্র্যাডি তার চেয়ে গুরুতর আহত হন। তার হামলাকারীকে চার দশকের বেশি সময় একটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আটক রাখা হয়। ২০২২ সালে তিনি আদালতের তত্ত্বাবধানে মুক্তি পান।
বারাক ওবামা : সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও হত্যাচেষ্টা করা হয়। ২০১১ সালে হোয়াইট হাউসে তিনি হত্যাচেষ্টার শিকার হন।
গুপ্তহত্যার শিকার ৪ মার্কিন প্রেসিডেন্ট

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক চার প্রেসিডেন্ট হত্যার শিকার হয়েছিলেন। রোববার (১৪ জুলাই) এক প্রতিবেদনে নিহতের বিষয়টি তুলে আনা হয়েছে। তারা হলেন—
আব্রাহাম লিঙ্কন : যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম গুপ্তহত্যার শিকার হওয়া প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহম লিঙ্কন। ১৮৬৫ সালে ওয়াশিংটন ডিসির ফোর্ডস থিয়েটারে তাকে মাথার পেছন থেকে গুলি করা হয়।
জেমস গারফিল্ড : ১৮৮১ সালে ওয়াশিংটন ডিসির একটি ট্রেন স্টেশনে আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হন প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘটনায় তিনি নিহত না হলেও একমাস পর আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় নিউজার্সিতে মারা যান এ প্রেসিডেন্ট।
তাকে হত্যার ঘটনায় চার্লস গুইটিউ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। মানসিকভাবে অসুস্থ এ ব্যক্তিকে গারফিল্ডের প্রশাসনে চাকরি না পেয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাকে বছরের মধ্যেই ফাঁসি দেওয়া হয়।
উইলিয়াম ম্যাককিনলে: ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে আততায়ীর হাতে নিহত হন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলে।লিওন সিজলগোস নামের এক নৈরাজ্যবাদী তাকে হত্যা করেন। তার এ হত্যাকারী বাফেলোতে থাকা অবস্থায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান।
জন এফ কেনডি : ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে ডালাসে স্নাইপারের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনডি নিহত হন। লি হার্ভে অসওয়াল্ড নামের এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেন। এ হামলার কয়েকদিন পর তার হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। কেননা দুইদিন পরেই জ্যাক রুবি নামক একজনের গুলিতে হার্ভি নিহত হন।
Read moreট্রাম্পকে দায়মুক্তি দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট
বিতর্কে একে অন্যকে ঘায়েল করার প্রাণপণ চেষ্টা বাইডেন-ট্রাম্পের
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন