বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শিরোনাম

দুর্নীতি উন্নয়নের অন্তরায়

সোমবার, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২

প্রিন্ট করুন

সেই স্বাধীনতার পর থেকে আজকের বাংলাদেশ। এ যেন এক নতুন পথের যাত্রা। যেখানে আছে উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ইতিহাস। আজকের বাংলাদেশ অনেকটা পরিণত, অনেকটা উন্নত। এদেশের শিক্ষা,স্বাস্থ্য, ব্যবসায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবদিকে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে দেশ আরও সামনে বাড়ছে। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় এই উন্নয়ন কি পর্যাপ্ত? যতটুকু হওয়ার দরকার ছিলো তা কি হয়েছে? বা যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ কি ততটুকু এগিয়েছে। উত্তর নিশ্চই না হবে।

এদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গেছে দুর্নীতির ঝাঁঝ। যে ঝাঁঝ কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষকরে এদেশের রাষ্ট্রীয় খাতগুলো আজ মারাত্মকভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ। যার ফলে সক্ষমতা থাকা সত্বরও আশানুরূপ অগ্রগতি সম্ভব না।

হরহামেশা খবরের কাগজে দেখা যায় সরকারি প্রকল্পে অত্যাধিক ব্যয়। আবার কোন কোন দপ্তরের নিম্নশ্রেণীর কর্মকর্তারা নিমেষেই হয়ে যাচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক। এর মূলে রয়েছে দুর্নীতি। একশ্রেণীর মানুষের এখন পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় টাকা ভাগিয়ে বড় বড় দালান নির্মাণ। ভোগবিলাসী জীবন যাপন তাদের উন্মাদ করে দিয়েছে।

শঙ্কাটা এখানেই। একটি জাতির সর্বক্ষেত্রে যদি নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে, তবে উন্নয়নের পথে চিতার গতি তো দূরের কথা, কচ্ছপের গতি পাওয়াও কঠিন। আমাদের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী অনেক পাকা রাজনীতিকের মতো কপট কথা বলায় হয়তো অভ্যস্ত হতে পারেননি, তাই মাঝেমধ্যে চরম সত্য কথা বলে ফেলেন। অতি সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছেন ‘প্রতিযোগিতা হলেই আমাদের অনেক এমপিকে পাস করতে বেগ পেতে হবে।’ কারণ হিসেবে তিনি তাঁদের সততার অভাবকেই দায়ী করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু রাজনীতির অঙ্গন কেন—নৈতিকতার স্খলন কোথায় না ঘটেছে! দুর্নীতি পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই কমবেশি আছে। তবে আমাদের দেশে দুর্নীতি—আরো নরম করে বললে অনৈতিকতার সংক্রমণটা যেন একটু বেশি। মানতে হবে রাজনৈতিক প্রশ্রয় এ দেশে দুর্নীতির সবচেয়ে বড় অনুঘটক।

রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্বে যারা আসীন হন, তাদের প্রধান কর্তব্যই হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের মতো দারিদ্র্যক্লিষ্ট ও সমস্যাক্রান্ত দেশের সরকার পরিচালকদের অসংখ্য বাস্তব সংকট আছে। আছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা। এর পরও রাষ্ট্র পরিচালনায় যদি জনকল্যাণের প্রশ্নটি সর্বাধিক গুরুত্ব পায়, তবে ধীরে হলেও সুন্দরের লক্ষ্যে পৌঁছা খুব কঠিন হয় না। আর এই সুন্দরের হাতছানিতে সাড়া দিতে প্রয়োজন নিখাদ গণতন্ত্রের পথে হাঁটা।

অনৈতিকতার ভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন তাতে আক্রান্ত হয় সব ক্ষেত্র। এখন তো বড় বড় খাতে দুর্নীতির কথা চাউর হচ্ছে। শতসহস্র কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। এ যেন থামছেই না। নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে চারদিকে। দুর্নীতির যে চিত্র দৃশ্যমান, সরকারি ভাষ্যে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তা উড়িয়ে দিতে পারছে না। নিয়োগ বাণিজ্য অথবা রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ—দুটিই দুর্নীতি। এখন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ দুটিই অতি বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অভিশাপ থেকে মুক্ত কে করবে তা আমরা বুঝতে পারছি না।

নৈতিকতা মুখ থুবড়ে পড়ছে না কোথায়? সাধারণ মানুষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে আইন-আদালত কোথাও কি আস্থা রাখতে পারছে? প্রতিকারের জন্য আজকাল থানায় যাওয়ার ভরসা পায় না সাধারণ মানুষ। প্রায়ই পত্রিকায় বেরোচ্ছে পুলিশ দ্বারা হয়রানির কথা। এখানে নাকি নানা ধরনের বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। বিচিত্র সব নামও আছে। পুলিশে যোগদানের আগে নিয়োগ বাণিজ্য। পুলিশ হওয়ার পর আছে গ্রেপ্তার বাণিজ্য, রিমান্ড বাণিজ্য, থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা বাণিজ্য—এমন সব নানা ধারার বাণিজ্য। আদালত নিয়ে বাণিজ্যের কথা ভুক্তভোগীরা বলেন। জামিন বাণিজ্য, সাজা কমবেশি বাণিজ্য ইত্যাদি কথাও এখন প্রকাশ্যে বলা হয়।

আগেও ছিল, এখন একটু বেশি করে পত্রিকায় আসছে দেশের বড় আমলাদের কথা। নিজেদের হাতে ক্ষমতা থাকায় প্রায়ই নিজেদের নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নিচ্ছেন। অবশ্য আমলাতন্ত্রের এটি পুরনো অভ্যাস। নৈতিকতার প্রশ্ন যদি সামনে থাকত, তাহলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে রাষ্ট্রের সব পেশাজীবীর সঙ্গে একটি ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নটি কাজ করত। আর সরকার যখন নানা কারণে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, দেশে বড় কোনো নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আমলাতন্ত্র নিজেদের সুবিধা আদায়ে সরকারকে অনেকটা বাধ্য করে। তাহলে ‘নির্বাচনের প্রয়োজনে’ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে!

অনৈতিকতা, অসাধুতা আর দুর্নীতি, সব যুগেই ছিল আর থাকবেও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর রাশ কতটা টেনে রাখা যায়। এই রাশ টানার সঙ্গে রাজনৈতিক শুদ্ধতার প্রশ্নটিই সবচেয়ে জরুরি। সামরিক শাসন না হলে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলে রাজনৈতিক দল আর রাজনীতিকরাই থাকেন। সেখানে যদি নৈতিকতার স্খলন ঘটে, তবে প্রশ্রয় পাবে সব ক্ষেত্র। এ দেশের বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা লোভী হয়ে পড়বে। দুর্বৃত্ত আচরণ করবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে না হাঁটতে পারলে নৈতিকতার স্খলন ঘটবে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে প্রশাসনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত কেউ নষ্ট ভাইরাসমুক্ত হতে পারবে না।

এ কারণেই আমাদের বক্তব্য, উন্নয়নের কথা প্রচার করে আমরা কি অন্য সব অন্ধকার ঢেকে রাখতে চাইছি? যদি তা-ই হয়, তবে দেশপ্রেমহীন এ ধারার রাজনীতি বহাল রেখে নব উত্থানের বৃত্তকে গতিশীল করা কঠিন হয়ে পড়বে। সব ক্ষেত্রে অনৈতিকতার বাড়বাড়ন্ত দেখতেই থাকব।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন