ইফতেখার ইসলাম: রাজধানীসহ সারাদেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সূচক ক্রমেই ওপরে উঠে যাচ্ছে। পাড়া-মহল্লার গলিপথ থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট সর্বত্র এখন ছিনতাই আতঙ্ক ভর করেছে। সন্ধ্যা নামলেই চারদিকে ছিনতাই-ডাকাতির আতঙ্কে সাধরণ মানুষ বাইরে বের হতে ভয় পায়। খোদ রাজধানীতে শত শত মানুষের সামনে রামদা দিয়ে রিকশা আরোহীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি বাসের মধ্যেও কেউ এখন নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। ডাকাতি করে সর্বস্ব লুট করা ছাড়াও ধর্ষণের মতো পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিনই সারা দেশে এ রকম অপরাধ চিত্র বাড়ছে। তবে এত পুলিশ থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কেন এত অবনতি হচ্ছে-সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আর প্রশ্নের শেষ নেই।
দেশের বড় শহরগুলোর পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকারও নাগরিকরা এখন শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ প্রায় সব এলাকায় এসব অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে, এবং এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশি কার্যক্রম যথেষ্ট কার্যকরী হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইকারীরা পথচারী, যাত্রী এবং দোকানদারদের লক্ষ্য করে নানা কৌশলে তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা এখন খুবই সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় এক মহিলা ছিনতাইয়ের শিকার হন। ছিনতাইকারী তার মোবাইল ফোন এবং গহনা নিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ জানায়, এই ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে, কিন্তু অপরাধীরা দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার কারণে তাদের ধরতে সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে, ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আতঙ্ক আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত শহরতলির ও গ্রামীণ এলাকায় ডাকাতরা মানুষদের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট চালাচ্ছে। গত মাসে চট্টগ্রামের বাকলিয়া এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী পরিবার ডাকাতির শিকার হয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা হারান। এছাড়া, খুলনায় এক দোকান থেকে কয়েক লাখ টাকার লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ছিনতাই এবং ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে অপরাধীদের দ্রুত পালানোর সক্ষমতা এবং পুলিশের নজরদারির অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। বেশিরভাগ এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হলেও, অপরাধীরা দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে এবং প্রযুক্তির চেয়ে নিজেদের কৌশলে এগিয়ে থাকে। বিশেষত রাতের বেলা অপরাধীদের তৎপরতা বাড়ে, আর এই সময় রাস্তায় যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষের জন্য তা একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা শহরের একাধিক এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ এখন রাস্তায় চলাচলে ভয় পাচ্ছে। বিশেষ করে মহিলারা এবং বৃদ্ধরা এই ধরনের অপরাধের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহে ঢাকার উত্তরায় এক মহিলা একাই গাড়িতে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়। এ ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
তবে, শুধু শহরেই নয়, দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষও এর থেকে পিছিয়ে নেই। বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামীণ এলাকায় ডাকাতির ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে, তবে অপরাধীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে উঠেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সড়ক ও দোকানগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও পেট্রোলিং টিমের মাধ্যমে অপরাধ দমন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরা ও টহল পুলিশের উপস্থিতির পরও কিছু অপরাধী দ্রুত পালিয়ে যায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সড়কদ্বারে পুলিশের টহল চললেও ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন কৌশলে তাদের অপরাধ সংঘটিত করছে এবং নিরাপদে পালিয়ে যাচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র সব সময় বোঝা যায় না। পুলিশ যে ঘটনাগুলোতে তাদের কাছে অভিযোগ যায় কিংবা মামলা হয়, সেগুলোই নথিবদ্ধ করে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে যান না ঝামেলার ভয়ে। থানাগুলো কখনো কখনো চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা না নিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র বা টাকা হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেয়। অবশ্য পুলিশ বলছে, তাঁরা এখন আর মামলা নিতে অনীহা দেখায় না। এ কারণে মামলার সংখ্যা বেশি হতে পারে।
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, অপরাধ পরিস্থিতির উন্নতির অন্যতম নির্দেশক হলো, মানুষ ঘরে বাইরে কিংবা চলাচলে নিরাপদ বোধ করছে কি না। মানুষ এখন নিরাপদ বোধ করছে না।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক কালে ডাকাতি ও দস্যুতার (ছিনতাই) ঘটনায় মামলা বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি। যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৯টি বেশি (৬৯ শতাংশ)। ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় গত ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ২৩০টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৫টি (৭০ শতাংশ) বেশি।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৭১টি ডাকাতি, ১৭১টি ছিনতাই, ২৯৪টি খুন, ১০৫টি অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে ৮টি ডাকাতি, ৫৪টি ছিনতাই, ৩৬টি খুন এবং ৩১টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২০২৪ সালে সারা দেশে ৪৯০টি ডাকাতি, ১৪১২টি ছিনতাই, ৩৪৩২টি খুন এবং ৬৪২টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। গত এক বছরে ডিএমপিতে ৪১টি ডাকাতি, ২৪৮টি ছিনতাই, ৩৩৯টি খুন ও ১৩২টি অপহরণের মামলা রেকর্ড হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধের মাত্রা মূলত পরিসংখ্যানের কয়েকগুণ বেশি।
এদিকে, স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, পুলিশ বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও ভালো করতে স্থানীয় জনগণকে সহায়তার জন্য পাড়া-মহল্লা কমিটি গঠনের পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা আরও তৎপর থাকবেন। কিন্তু অপরাধীরা যে কৌশল অবলম্বন করছে, তা মোকাবিলা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে, বিশেষ করে রাতে ছিনতাই। এ নিয়ে বিশেষ একটি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, র্যাব, পুলিশের অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ও ডিএমপি ঢাকায় একসঙ্গে বিস্তৃত টহল কার্যক্রম চালাবে। তিনি বলেন, ‘দেখি, এভাবে পরিস্থিতি উন্নতি হয় কি না। এরপরও যদি না হয়, তাহলে বিকল্প চিন্তা করব।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন