শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শিরোনাম

পথ চলার ৫০ বছরে ঢাকা থিয়েটার

রবিবার, জুলাই ৩০, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

ঢাকা: এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ১৯৭৩ সালের দিকে স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক মুক্তির আনন্দ চিরস্থায়ী করতে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির পথ খুঁজছিল। সে সময় ‘মৌলিক নাটক মঞ্চায়নের মধ্যে বাংলা নাটকের মুক্তি’- এমন স্লোগান নিয়ে যাত্রা করেছিল দেশের অন্যতম সেরা নাটকের দল ‘ঢাকা থিয়েটার’। এটি এখন দেশের মঞ্চপ্রেমীদের কাছে অতি পরিচিত নাম। দেশের বাইরেও নাটক মঞ্চায়ন করে প্রশংসা কুড়িয়েছে ঢাকা থিয়েটার। দেশের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এ দলের ভূমিকা অনন্য। অনেক তারকা অভিনেতা, নির্দেশক উপহার দিয়েছে ঢাকা থিয়েটার; যাদের হাত ধরে দেশের সংস্কৃতিচর্চা বিকশিত হয়েছে কালে কালে।

১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই প্রথম নাটক মঞ্চায়নের দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু, সেদিন তুমুল বৃষ্টিতে পানি উঠে গিয়েছিল ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে। ফলে, মঞ্চায়ন সম্ভব হয়নি। পরে, সে বছরের নভেম্বরে দুই টাকা দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন শুরু করে ঢাকা থিয়েটার। তবে, দলটি ২৯ জুলাইকেই তাদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন হিসেবে পালন করে। দলটির পুরোধা ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করি ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে। তবে, ২৯ জুলাইকে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার দিন ধরি।’

সে হিসেবে ঢাকা থিয়েটারের ৫০ বছর পূর্ণ হল। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে নাট্যচর্চার মানসে যাত্রা করা একটি নাটকের দল পেশাদারি না থাকা সত্ত্বেও তিলে তিলে ৫০ বছর পার করেছে, বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্য রকম সাফল্যের।

এ ব্যাপারে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, এ বড় আনন্দের ক্ষণ। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে মঞ্চনাটকে ৫০ বছর পার করে দেয়া মুখের কথা নয়। কত প্রাণ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে এ দীর্ঘ যাত্রায়। তাদের স্মরণ করছি শ্রদ্ধাভরে। যারা আজো আমাদের সহযাত্রী সবাইকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনে আমরা আগের মতই ভূমিকা রাখব। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমবিলাসী শিল্পচর্চার বিপরীতে কমিটেড থিয়েটার চর্চার মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সূচনাকালের নাট্য সংগঠনগুলোর প্রতিষ্ঠাতার অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা-তরুণ প্রজন্ম। তাদের একজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধা তিনি। ঢাকা থিয়েটারের প্রধান পুরুষ। তিনি ও সংস্কৃতিমনা কয়েকজন মিলে নাটকের দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ দলের বেশিরভাগ নাটকের নাট্যকার ছিলেন সেলিম আল দীন। নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও সেলিম আল দীন কেবল ঢাকা থিয়েটারের নয়, বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে গুরুত্বপূর্ণ নাম। এ ছাড়া, ঢাকা থিয়েটারে এক সময় নিয়মিত নাটক করেছেন হুমায়ুন ফরীদি, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শমী কায়সার, শহীদুজ্জামান সেলিমসহ অনেক তারকা অভিনয় শিল্পী।

যুগল নাটক দিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে ঢাকা থিয়েটার প্রদর্শনী শুরু করেছিল। নাটক দুটি হচ্ছে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত ‘সংবাদ কার্টুন’ ও হাবিবুল হাসান নির্দেশিত ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’। ঢাকা থিয়েটার চার দশকের বেশি সময়ের পথচলায় বেশকিছু আলোচিত ও সাড়াজাগানো নাটক মঞ্চে এনেছে। তাদের প্রশংসিত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কীর্ত্তনখোলা’, ‘যৈবতি কন্যার মন’, ‘বনপাংশুল’, ‘ কেরামত মঙ্গ ‘, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘বিনোদিনী’, ‘প্রাচ্য’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘শকুন্তলা’, ‘ধূর্ত ওই’, ‘নিমজ্জন’, ‘চাকা’, ‘ধাবমান’, ‘হাত হদাই’, ‘দ্য টেম্পেস্ট’, ‘পঞ্চনারী আখ্যান’, ‘পুত্র’ ইত্যাদি।

ঢাকা থিয়েটারে সবচেয়ে বেশি মঞ্চায়িত হয়েছে ‘বিনোদিনী’। বিনোদনী চরিত্রে অভিনয় করে অনেক প্রশংসা পেয়েছেন শিমূল ইউসুফ।

কলকাতার মঞ্চেও নাটক প্রদর্শনী করে প্রশংসা পেয়েছে এ দলটি। এ ছাড়া, লন্ডনের গ্লোব থিয়েটারে বাংলা ভাষায় ‘দ্য টেম্পেস্ট’ মঞ্চস্থ হয়। নাসির উদ্দিন ইউসুফ নাটকটির নির্দেশক ছিলেন। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘গ্লোব থিয়েটারে নাটকটি মঞ্চায়ন করে ঢাকা থিয়েটার অনেকের প্রশংসা পেয়েছে। বিদেশে এটি ঢাকা থিয়েটার ও আমাদের দেশের নাটকের বড় অর্জন।’

এখনো ঢাকার মঞ্চে সরব ঢাকা থিয়েটার। করোনাকালেও দলটি নতুন নাটক মঞ্চে এনেছে। নাটকটির নাম ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’। এর নির্দেশনা দিয়েছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। এটি ঢাকা থিয়েটারের ৪৯তম প্রযোজনা। এরপর আর নতুন প্রযোজনা আসেনি দলটির।

১৯৮৩ সালে ঢাকা থিয়েটারের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রাম থিয়েটার। এটি দীর্ঘ দিনের পথ চলায় সফলতা ধরে রেখেছে। এ ব্যাপারে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা গ্রামে গ্রামে মঞ্চ গড়ে তোলা। জীবদ্দশায় হয়তো সব দেখে যেতে পারব না, আমার বয়স এখন ৭৩। সারা দেশে গ্রামগুলোয় আমরা যদি অন্তত ৫০০ মঞ্চ তৈরি করতে পারি, তাহলে তা নাটকের জন্য অনেক বড় কাজ হবে।’

অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম দলটির সাথে যুক্ত ৪০ বছর। তিনি বলেন, ‘ঢাকা থিয়েটারের ৫০ বছর বয়স হয়ে গেছে, এটা ভাবলেই নিজেকে গর্বিত মনে হয়। দীর্ঘ এ সময় ঢাকা থিয়েটার থেকে দেশের বিনোদনজগতে অসংখ্য কিংবদন্তির জন্ম হয়েছে। যারা দেশের নাম পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল করেছেন, সামনেও করে যাবেন। আমি তাদের সহযাত্রী হতে পেরে আনন্দিত। এখন পর্যন্ত আমাদের ৪৯টি নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। শিগগিরই নতুন নাটক নিয়ে কাজ শুরু করবে।’

এ সময় ঢাকা থিয়েটারের সাথে নিজের সম্পর্ক ও অবদানের কথা বলে সেলিম জানান, ‘আমি এ সংগঠনের সাথে ৪০ বছর ধরে যুক্ত। বলতে গেলে আমার জীবনের তিন ভাগের দুই ভাগ এখানে কেটেছে। আজকে একজন শহীদুজ্জামান সেলিম হওয়ার পেছনে ঢাকা থিয়েটারের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমি ১৯৮৩ সালে এখানে যোগ দেয়ার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার করতাম। সেখানে দুই বছর কাজ করে এখানে আসি। এরপর আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সামনে থেকে দেশের কিংবদন্তি শিল্পীদের অভিনয় ও নির্দেশনা দেখে নিজেকে আরও পরিপূর্ণ অভিনেতা হিসেবে গড়ে তোলার সাহস পেয়েছি। আজ নিজেকে দেখে নিজেরই গর্ব হয়। এ গর্বের পেছনের গল্প এ থিয়েটার থেকেই শুরু হয়েছিল। আরো হাজার বছর বেঁচে থাকুক আমাদের প্রাণের থিয়েটার।’

এ সময় ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন নিয়ে এ অভিনেতা জানান, ‘৫০ বছর উপলক্ষে আমাদের বেশকিছু পরিকল্পনা ছিল। কিন্ত, দেশের দুই দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকায় আমাদের আয়োজন সংক্ষিপ্ত করেছি। এবারে সেলিম আল দীনের পাঁচালি নাটক মঞ্চায়ন হবে। প্রায় দুই দশক পর নাটকটি মঞ্চে আনবে প্রাচ্যনাট।’

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে কামাল বায়জীদকে অপসারণের প্রতিবাদে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান থেকে গেল ২৩ মার্চ সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছে ঢাকা থিয়েটার। যা নাট্যচর্চার আঙিনায় বেশ আলোচিত ঘটনা। যে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার, সেই ঢাকা থিয়েটারকে বাধ্য হয়ে তাদেরই শ্রম ও মেধায় গড়ে ওঠা ফেডারেশন থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিতে হলো বলে সম্প্রতি এক খোলা চিঠিতে দুঃখ প্রকাশ করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আনন্দের এ মুহূর্তে এসব নিয়ে না বলাই ভাল। আমার গ্রুপ থিয়েটার চর্চার বয়স ৫১ বছর। আমাদের ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা ও নাট্যচর্চার বয়স ৫০ বছর। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের বয়স ৪১ বছর। সবাইকে নিয়ে, সবার সাথে নাট্যমঞ্চ ও রাজপথে জীবনের সিংহভাগ কেটে গেছে আমার ও ঢাকা থিয়েটারের। এটাকে আমি প্রাপ্তি হিসেবে দেখি। আগামী দিনগুলোয়ও যেন ঢাকা থিয়েটার সবার ভালবাসা নিয়ে চলতে পারে সেই শুভকামনা চাই।’

সিএন/এমএ

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন