ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র: বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ-আমেরিকান নির্বাচিত কর্মকর্তা, মানবাধিকার, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের বিশিষ্টজনরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্দেশ্যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। শনিবার (১ জুলাই) প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সম্পর্কে এ বিবৃতি দেয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা নিম্ন স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-আমেরিকান নির্বাচিত কর্মকর্তা, মানবাধিকার, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলকে জোরালোভাবে সমর্থন করি। বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমরা আপনার প্রশাসনের উদ্বেগের প্রশংসা করি। তবে, মার্কিন নীতিকে অবশ্যই বাংলাদেশে ব্যাপক সন্ত্রাসবাদের ঘটনা বিবেচনা করতে হবে; যা সরাসরি বিএনপি-জামায়াত জোট ও জোটের পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে।’
এতে বলা হয়, ‘মুসলিম দেশ ও অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক মাত্রা বিবেচনা না করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বার বার ব্যর্থতার বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতার উজ্জ্বল উদাহরণ। আমরা বাংলাদেশে তা চাই না।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অনুগ্রহ করে আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আপনাদের সাথে শেয়ার করার অনুমতি দিন। বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে চারটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও ভাল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানই উদার গণতান্ত্রিক ফলাফলের নিশ্চয়তা দেয় না। বিশেষ করে, ২০০১ ও ২০০৮ সালের দুটি অবাধ নির্বাচনের মধ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো ইঙ্গিত করে ২০২৪ সালে একটি অবাধ (এবং তথাকথিত সুষ্ঠু) নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে পরিবর্তন করবে না যদি না অংশীজনদের নিরাপত্তা, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে একটি টেকসই সমাধান খুঁজে পাওয়া এবং সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দেয়া।’
উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সালের অক্টোবরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থি জোট জয়লাভ করে। বিজয়ের পরপরই জোটটি বাংলাদেশের ১১টি পশ্চিম জেলাজুড়ে হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব আক্রমণ চালায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার জন্য হিন্দু ও বিরোধী কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছিল। সহিংসতার ফলে ব্যাপক লুটপাট এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া, হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও হিন্দুদের উচ্ছেদ করা হয়। এটি ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে চলতে থাকে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে জোট নেতাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এসব কাজ সংঘটিত হয়।’
হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোট নেতাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়।
২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় বড় ধরনের সহিংসতার কয়েকটি বড় ঘটনা: ২০০৪ সালের ২৪ মে বাংলাদেশের হরকাত-উল-জিহাদ আল-ইসলামী ওরফে হুজি তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর ব্যাপক গ্রেনেড হামলা চালায় এতে তিনজন নিহত ও হাইকমিশনারসহ ৫০ জন আহত হয়। মুফতি হান্নান ও অন্য দুইজনকে ২০০৮ এর ২৩ ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সন্ত্রাসী ঘটনা হুজি দ্বারা সংঘটিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ ২৪ জন নিহত ও ৫০০ শতাধিক লোক আহত হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট শুধু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়নি, বরং একজন দরিদ্র জজ মিয়া ও একজন আওয়ামী লীগ কর্মী শৈবাল সাহা পার্থকে মিথ্যাভাবে জড়িয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। জঘন্য অপরাধের কথা স্বীকার করার জন্য দুইজনকেই নির্যাতন করা হয়েছিল, যে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না। পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান হামলার নেপথ্যের কথা স্বীকার করেন এবং সেই ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রমাণিত।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের ফাঁসির দণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ৬৪টি জেলাজুড়ে একযোগে ৪৫৯টি বোমা বিস্ফোরণ করে ব্যাপক বোমা হামলা চালায়। এতে দুইজন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হয়। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বাংলা ভাই নামে পরিচিত শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম। বাংলা ভাই কলেজে পড়ার সময় সাবেক ইসলামী ছাত্র শিবির (জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন) ছিলেন। ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেএমজেবি এবং হুজি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে।
ওপরে বর্ণিত উদাহরণ ২০০১ সালের অবাধ নির্বাচন গণতান্ত্রিক ফলাফল নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এখন, সন্ত্রাসী ঘটনা ও অন্যান্য অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত তারেক জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আমাদের উদ্বেগ হল, তারেক জিয়া ও অন্য আসামিরা কোনভাবে পেছনের দরজা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হলে কোন ধরনের গণতন্ত্র নিরাপদ হবে?
এত দিন রাজনৈতিক কার্যালয়ের বাইরে থাকার পরও বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের সহিংস পথ ছেড়েছে বলে মনে হয় না। ২০১৩ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করার পর জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা এক অভূতপূর্ব বছরব্যাপী দেশব্যাপী সহিংসতা চালায়; যার ফলে শত শত প্রাণ যায়। এ সহিংসতার কারণে দেশের ইতিহাসে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের হাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। তারপর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বিএনপি-জামায়াত বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটি ব্যাপক সন্ত্রাসী প্রচারণা চালায়। বোমা হামলায় ৬০ জনেরও বেশি প্রাণ নিয়েছিল ও শতাধিক আহত হয়েছিল। ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন প্রচারণার কঠোর সমালোচনা করে এ বলে যে, ‘যেভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভগুলি পরিচালিত হচ্ছে তা স্পষ্টতই দেখায় যে; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা সহিংসতার পুনরাবৃত্তির প্যাটার্ন।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালে বিপত্তি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি হয়েছে। আমরা পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক কামনা করি।’
এতে আরো বলা হয়, ‘সম্প্রতি আমরা আপনার প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপ ও কিছু আইন প্রণেতাদের বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য লক্ষ্য করছি এবং এ পদক্ষেপগুলো যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমরা এসব ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও বিনীতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে প্রতিফলিত করে- এমন পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করছি, যা বাংলাদেশকে সহিংসতামুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্র দুটি বিরোধী শক্তিতে ভরপুর, একটি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ উদার আদর্শের সাথে এবং অন্যটি রাজনৈতিক জঙ্গিবাদের সাথে মিশ্রিত ধর্মীয় উগ্রবাদে। বর্তমান শেখ হাসিনা প্রথমটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ও অপরটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি-জামায়াত পক্ষ। সাম্প্রতিক মার্কিন নীতি ও বক্তৃতা শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রাণিত করছে ও উদারপন্থি শক্তিকে বিভ্রান্ত করছে।’
এছাড়াও এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জন্য সহিংসতামুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আমরা আপনাকে বর্তমান কর্মপন্থা পরিবর্তন করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।’
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন কাউন্সিলম্যান নুরুন নবী (এমজে), মেয়র মাহাবুবুল আলম তৈয়ুব (পিএ) রাজ্য প্রতিনিধি আবুল খান (এনএইচ), কাউন্সিলম্যান আবু আহমেদ মুসা (এমআই), কাউন্সিলম্যান নুরুল হাসান (পিএ), অধ্যাপক এবিএম নাসির (এনসি), প্রকৌশলী রানা হাসান মাহমুদ (সিএ), প্রকৌশলী স্বীকৃতি বড়ুয়া (এনওয়াই), গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ (ইউএসএ ইনকর্পোরেটেড), নজরুল আলম (ক্যালিফোর্নিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ), ফাহিম রেজা নূর (ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ইউএসএ, এনওয়াই), ইঞ্জিনিয়ার আহাদ আহমেদ (মিশিগান বঙ্গবন্ধু পরিষদ), জাকারিয়া চৌধুরী (ইউএসএ কমিটি ফর ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড সেক্যুলার বাংলাদেশ), মাহাবুবুর রহমান ভূঁইয়া (জর্জিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ), খুরশীদ আনোয়ার বাবলু ( বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, ইউএসএ), দস্তগীর জাহাঙ্গীর (গ্রেটার ওয়াশিংটন ডিসি বঙ্গবন্ধু পরিষদ), আব্দুল বাতেন (মুক্তিযোদ্ধা সংসদ), সফেদা বসু (ম্যাসাচুসেটস বঙ্গবন্ধু পরিষদ), মোরশেদ আলম, (গণতান্ত্রিক নেতা, এনওয়াই), আবু তাহের বীর প্রতীক (পেনসিলভানিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ), প্রফেসর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (একাডেমিক গ্রুপ, পিএ), প্রফেসর মিজান আর মিয়া (আইএল), প্রফেসর জামিল তালুকদার (ডব্লিউআই), প্রফেসর শাহাদাত হোসেন (এনওয়াই), নূরন্নবী চৌধুরী (দক্ষিণ নিউ জার্সি বঙ্গবন্ধু পরিষদ)।
সিএন/এমএ
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন