শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শিরোনাম

বিশ্বাসের জৌলুস হারিয়েছে খাতুনগঞ্জ

শুক্রবার, অক্টোবর ৮, ২০২১

প্রিন্ট করুন
Halkhata 1@2x 1
Halkhata 1@2x 1

শারমিন রিমা:

বিভূতি রায় চলে যাওয়ায় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের আস্থায় চিড় ধরেছে!

‘দিন যায় কথা থাকে’ — দিন-বদলের স্লোগানে পরিবর্তনই ধর্ম। তবে একুশ শতকের এ যুগে মুখের কথার দাম মুখে থাকলেও, কাগজের যুগে তা বিলীন হয়ে গেছে। পারস্পরিক আস্থার সংকটে ধুঁকছে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারী বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। এক সময় শুধু মৌখিক বিশ্বাসের ওপর প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার লেনদেন হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেটি এখন হারিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে লেনদেনের সহজ মাধ্যম চেক, ব্যবসায়ীদের বড় ভরসা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে লেনদেনের পরিমাণ বাড়ায় বেড়েছে প্রতারণা। কয়েক বছর আগেও সেখানে দৈনিক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। বর্তমানে খাতুনগঞ্জে চেক প্রতারণা এবং পাওনাদারের টাকা বকেয়া রেখে ব্যবসায়ীদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার ঘটনায় সেই বিশ্বাসেও ছেদ পড়তে শুরু করেছে। ফলে অনেক ব্যবসায়ী অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র স্থানান্তর করেছেন। যার কারণে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী এ খাতুনগঞ্জ বাজার বিশ্বাসের জৌলুসতা হারাতে বসেছে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। ব্যাংকের লেনদেনের পাশাপাশি এরমধ্যে আবার বেড়েছে চেক প্রতারণা ও ঋণ খেলাপির সংখ্যা। এক ব্যবসায়ী অপর ব্যবসায়ীর পাওনা মিটাতে চেক দেয়া হলেও ব্যাংক থেকে অনেক সময় সেই চেক প্রত্যাখাত হচ্ছে। ফলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আদালতে মামলা ঠুকে দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ীই প্রথমে বিশ্বাস অর্জন করে, পরে বড় অংকের ঋণ খেলাপি হয়ে পালিয়ে যায় অন্যত্র। অথচ এই খাতুনগঞ্জেই একসময় হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেনে বিশ্বাসের কারবার চলতো।

এদিকে, এখানকার ব্যবসায়ীরা সেই মান্ধাতার আমলের সনাতন পদ্ধতিতেই ব্যবসায়িক হিসাব সংরক্ষণ করেন। তবে ব্যবসায়িক বিশ্বাস ভরসার সেই পুরাতন ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি কেউই। যদিও পাওনাদারের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার শুরুটা হয় ১৯৮৬ সালে। গত ২২ বছরে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ৫০টিরও বেশি বড় ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে।

প্রতারকরা লুটে নিয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা জানান, গত ১০ বছর আগেও খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন হতো। নিছক মুখের কথায়, টেলিফোন বা চিরকুটের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাসের ব্যবসা চলতো এখানে। কিন্তু গত দুই দশক ধরে এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।

ভারত-বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক বিভূতিভূষণ, উত্তম সাহা, শান্তি বাবু, সুনীল রাজগরিয়া, মিলন বাবু, দয়াল বাবু, বিক্রম সাহা, উত্তম সাহা, লিয়াকত আলী, কামাল উদ্দিন, নিরাঞ্জনহুরসহ বেশ কয়েকজন মাড়োয়ারির হাত ধরে কয়েক শত প্রতারক ব্যবসায়ী গত দুই যুগে শত কোটি টাকা নিয়ে দেশের বাইরে লাপাত্তা হয়। বিশ্বাসের ব্যবসা ধস নামার পর ব্যবসায়ীরা ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তারা এ ব্যবসাকে নিরাপদ বলে মনে করতে থাকে। কিন্তু সেখানেও শেষ রক্ষা নেই।

প্রতারক চক্র ডিও স্লিপ নকল করার মাধ্যমে লুটে নিতে থাকে কোটি কোটি টাকা। খাতুনগঞ্জে গত ১০ বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার অধিক চেক, ডিও ও আর্থিক প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোগল আমলে খাতুনগঞ্জে ব্যবসা বাণিজ্যের গোড়াপত্তন হয়। এক সময় বিদেশ বিভূঁইয়েও এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

শুধু মুখের কথায় এই বাজারে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। ব্যবসায়ীরা টাকা বকেয়া রেখে উধাও হয়ে যাওয়ার কারণে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়িক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যেও ভাটা পড়তে শুরু করেছে। এভাবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যে সৃষ্টি হচ্ছে অচল অবস্থা। নগদের পরিবর্তে চেক গ্রহণে ভয় পাচ্ছেন। ২০০৩ সালের পরে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। আবার খাতুনগঞ্জে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) ব্যবসাকে ঘিরে রাতারাতি কেউ কেউ হয়েছেন বড়লোক। অনেকেই হয়েছেন নিঃস্ব। ব্যবসায়ীদের অধিকাংশের স্থায়ী ঠিকানা নেই, কেবল ডিওর কাগজ হাত বদল করেই চলছে তাদের ব্যবসা। প্রতিটি ডিও স্লিপের হাত বদলেই কোটি কোটি টাকা আয় করছে ব্যবসায়ীরা। তাই ডিও ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ছে ব্যবসায়ীরা।

এদিকে ডিও ব্যবসায় সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে প্রতারকরা। খাতুনগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বিশ্বাসই খাতুনগঞ্জের লেনদেনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বছরের পর বছর এই প্রথাই চলে আসছিলো। বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) বা চেকের বিনিময়ে বাকিতে দৈনিক ৮০০ থেকে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন চলে এই ভোগ্যপণ্যের বাজারে। তবে এখন আর সেই ঐতিহ্য নেই। চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি মো. সোলায়মান বাদশা বলেন, ‘চাক্তাই খাতুনগঞ্জে ছোট বড় প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। বাপ দাদার আমল থেকেই এখানে দেখে আসছি বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে এই বাজারের ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এরমধ্যে নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পাওনা টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। এখন তাই আগের মতো বিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে যেমন খাতুনগঞ্জ বিশেষত্ব হারাচ্ছে।

অন্যদিকে বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চাক্তাই শিল্প বণিক সমিতির সভাপতি মো. হারুনুর বলেন, ‘ আমি ১৯৬৩ সাল থেকে এখানে ব্যবসা করছি। মৌখিক বিশ্বাসের ওপর আমরা লেনদেন করে আসছি। কিন্তু আরেক ব্যবসায়ীর টাকা মেরে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় মৌখিক বিশ্বাসের এই প্রথা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

এছাড়া ব্যবসায়ীদের বাকি দেয়ার ক্ষেত্রে আরেকটু সতর্ক থাকা দরকার। এখন অনেকেই ট্রেডারদের বাকিতে পণ্য দিয়ে দেয়। দেখা যায়, ওই লোকের বাকিতে পণ্য নেয়ার সক্ষমতা আছে ৫ লাখ টাকার, তাকে বাকি দেয়া হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা। এতে কোনো কারণে পণ্যের দরপতন হলে ওই ব্যবসায়ীর পক্ষে লোকসান সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যায়। তখন এক পর্যায়ে সেই ব্যবসায়ী টাকা মেরে দেয়ার পরিকল্পনা করে।

বিগত বছরগুলোতে চেক প্রতারণার চিত্রঃ

সালঘটনা  টাকার পরিমাণ
১৯৮৬ ২টি   ছয় কোটি ৩ লাখ
১৯৯০১টিদেড় কোটি
১৯৯২        ১টি  তিন কোটি
১৯৯৩        ১টি  চার কোটি
১৯৯৪        ৭টি ১৩ কোটি ৫০ লাখ
১৯৯৫          ১টি  এক কোটি
২০০০        ৮টি  ১৮ কোটি ৫০ লাখ
২০০৪         ৬টি  ১৩ কোটি ৫০ লাখ

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন