অভ্র বড়ুয়া: সাংবাদিক ও লেখক মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘আজ থেকে বিশ বছর পর আপনি এই ভেবে হতাশ হবেন যে, আপনার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল তা করতে পারেননি। তাই, নিরাপদ আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুন। আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করুন, স্বপ্ন দেখুন আর শেষমেশ আবিষ্কার করুন।’
জীবনে শুধুমাত্র অর্থ সবকিছু কিছু নয়, তার পাশাপাশি নিজেকে ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত, সমৃদ্ধ করে তোলাটাও ভীষণ প্রয়োজন। ভ্রমণ আমাদের অচেনাকে জানার ও বোঝার দিগন্তকে প্রসারিত করে।
গেল সপ্তাহে ভারত সরকারের মর্যাদাপূর্ণ আইসিসিআর বৃত্তি (২০২৪-২৫) পাওয়া আমরা শিক্ষার্থীরা আইসিসিআরের আয়োজনে গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান অবলোকন করতে যাই। প্রথমেই আমরা রওনা দি ভারতের সর্বপ্রথম বুলেট ট্রেন প্রজেক্ট দেখার উদ্দেশ্য। যা ‘মু্ম্বাই-আহমেদাবাদ হাই-স্পিড রেল করিডর’ হিসেবে পরিচিত। এটিই হতে চলেছে ভারতের সর্বপ্রথম বুলেট ট্রেন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৬ সাল নাগাদ জাপান দ্বারা তৈরিকৃত বুলেট ট্রেনটি ভারতে এসে পৌঁছবে। (শিনকানসেন ই-৫) মডেলের বুলেট ট্রেনটি ঘন্টায় ৩২০ কিলোমিটার বেগে আহমেদাবাদ থেকে মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্য ছুটে চলবে। দুই শহরের মধ্যে যাত্রার সময় যেমন কমবে, তেমনি সহজ হবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এছাড়াও, বুলেট ট্রেন পরিবহন প্রযুক্তিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে চিহ্নিত হবে। দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে নানাভাবে গতিশীল করবে।
পরবর্তী গন্তব্য ছিল আহমেদাবাদের অন্যতম আকর্ষণ গান্ধী আশ্রমে। গান্ধীজি সবরমতী নদীর তীরে সাধু দধীচির আশ্রমের অনতিদূরে জেলখানা ও শশ্মানের কাছাকাছি এই জায়গা বেছে নেন। তার মতে ‘সত্যের সন্ধান ও নির্ভীকতা বিকাশের জন্য আমাদের কার্যকলাপের জন্য এটিই সঠিক জায়গা’ কয়েকটি প্রয়োজনীয় কাঠামো নির্মাণের পর, আশ্রমের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯১৭ সালে। মূলত গান্ধীজি এই আশ্রম থেকে স্বাধীনতার সব প্রধান কর্মকার্ন্ড পরিচালনা করেছিলেন দেশ, সমাজ ও মানুষের কল্যাণে।
মহাত্মা গান্ধী সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করে ২৪ দিনে ৩৯০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করেন। বিশাল সংখ্যক ভারতীয় তার সঙ্গে ডান্ডিতে আসেন। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ছয়টার সময় গান্ধীজি লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। সেই সঙ্গে তার লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে তাৃর সাথে এই আন্দোলনে একাত্মতা করেন। এই আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই বদলে যায়।
বর্তমানে গান্ধী স্মারক সংগ্রহালয় ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি পাবলিক ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। জাদুঘরের নতুন প্রাঙ্গণটি ১৯৬৩ সালে নির্মিত হয়েছিল। যাদুঘরের মূল উদ্দেশ্য হল মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্নকে বাঁচিয়ে রাখা। ফলস্বরূপ, প্রদর্শনীগুলি গান্ধীজীর জীবনের প্রাণবন্ত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিকে চিত্রিত করে। বই, পাণ্ডুলিপি ও তার চিঠিপত্রের ফটোকপি, তার স্ত্রী কস্তুরবা এবং আশ্রমের অন্যান্য সহযোগীদের সাথে গান্ধীজির ছবি, তৈলচিত্র ও তার লেখার ডেস্ক ও চরকার মত মূল্যবান সংগ্রহ রয়েছে। রয়েছে মূল্যবান অসংখ্য স্মৃতি।
এরপর আমরা রওনা দিই সুভাষ সেতু হয়ে পরবর্তী গন্তব্যে। সুভাষ সেতু হল আহমেদাবাদের সবরমতী নদীর উপরের একটি সেতু, যা ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়েছিল। গান্ধী আশ্রম সুভাষ সেতু থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা। ভারতের স্বাধীনতা-অর্জন আন্দোলনে তিনি হলেন এক অতি-উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র, যিনি এই মহাসংগ্রামে নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি নেতাজি নামে সমধিক পরিচিত।
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল হুথিসিং জৈন মন্দির। মূল্যবান সাদা মার্বেলে তৈরি এই অসাধারণ কারুকার্যমন্ডিত মন্দিরটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম জৈন পরিবারের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ১৫তম জৈন তীর্থঙ্কর, শ্রী ধর্মনাথের উৎসর্গ হিসেবে একজন ধনী বণিক শেঠ হুথিসিং দ্বারা আনুমানিক দশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল। নকশার কাজ করা কারিগরেরা সোনপুরা ও সালাত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মন্দিরটি বৃহৎ চূর্ণবিশিষ্ট গম্বুজ দ্বারা আবৃত। যা মূলত ১২টি অলংকৃত স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি নির্মিত একটি ৭৮ ফুটের মহাবীর স্তম্ভ রাজস্থানের চিতোরের বিখ্যাত টাওয়ারের পরে তৈরি, সম্মুখের প্রবেশদ্বারের বাইরের উঠোনের পাশে অবস্থিত। নকশায় ব্যবহৃত কিছু মোটিফ মুঘল আমলের সুলতানি মিনারের কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের।
বিকালের ক্ষণে আমরা যাত্রা করেছি সিদ্দী সাঈদ মসজিদে। এই মসজিদটি সিদ্দী সাঈদ ১৫৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। অলংকৃত জালিকাটা নকশা মসজিদের প্রায় দশটি অর্ধবৃত্তাকার জানালাকে শোভিত করে, কিছুতে জটিল জ্যামিতিক নকশা দেখানো হয়েছে এবং গাছ ও পাতার সাথে খোদাই করা নকশাও সকলের নজড় কাড়ে। আমাদের সর্বশেষ স্থান ছিল স্বামীনারায়ণ অক্ষরধামে। ‘অক্ষরধাম’ আক্ষরিক অর্থে ঈশ্বরের ঐশ্বরিক বাসস্থান। ভক্তি ও অনন্ত শান্তি অনুভবের প্রকৃত স্থান। পবিত্র মন্দিরটি যোগীজি মহারাজ (১৮৯২-১৯৭১) দ্বারা অনুপ্রাণিত, পরম পবিত্র প্রমুখ স্বামী মহারাজ (১৯২১-২০১৬) দ্বারা তৈরি হয়।
বোচাসনবাসি শ্রী অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামীনারায়ণ সংস্থা দ্বারা পরবর্তী নির্মিত হয়। এই ঐতিহ্যবাহী শৈলীর মন্দিরটি ১৯৯২ সালের ৩০ অক্টোবর এইচএইচ প্রমুখ স্বামী মহারাজের আর্শীবাদে এবং দক্ষ কারিগর ও স্বেচ্ছাসেবকদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয়। আপনি যতই ভেতরের দিকে ঢুকবেন, ততই মন্দিরের আশপাশের পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে, আপনি আশ্চর্য হতে বাধ্য হবেন।
সর্বশেষ আকর্ষণ ছিল সাত-চিত-আনন্দ জল ফোয়ারা প্রদর্শনী। মূলত নচিকেতার একটি উপনিষদিক গল্প তুলে ধরা হয়।একটি নয় বছর বয়সী বালক, যিনি সাহসিকতার সাথে মৃত্যুর দেবতা যমরাজের মোকাবিলা করেন এবং তার কাছ থেকে সেই জ্ঞান লাভ করেন; যা ভারতকে আলোকিত ভূমিতে পরিণত করেছে। এটি মানব সম্প্রীতি ও অভ্যন্তরীণ শান্তির একটি অর্থবহ বার্তা বহন করে। যা জল, অগ্নি, লাইট দ্বারা থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়। ১৩০-ফুট চওড়া ও ৭০-ফুট উচ্চ জলের পর্দা, দুই হাজার আলো, ১০০টিরও বেশি পাম্প। আগুন (জলের উপর ছড়িয়ে পড়া আগুন) সাথে বেশ কয়েকটি ফায়ারবল, তিনটি শক্তিশালী লেজার, সবগুলোই সাত দশমিক এক চারপাশের সাউন্ড সিস্টেম দ্বারা উন্নত। অত্যন্ত দক্ষ শিল্পী দ্বারা নির্ভুলতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত হয় প্রদর্শনীটি।
অজানাকে জানতে হলে, জীবনটাকে ব্যস্ততার মাঝে উপভোগ করতে, নিজেকে জানতে ভ্রমণের গুরত্ব অপরিসীম।বইয়ের পাতা থেকে বহু সময় বেড়িয়ে আসতে হয় জানা বিষয়টাকে স্বচক্ষে আরও বেশি করে জানার জন্য, উপলব্ধি করতে সর্বোপরী সে বিষয় বা জায়গা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা এবং চলচ্চিত্র পরিচালনা বিভাগ, গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।
সিএন/আলী
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন