রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

শিরোনাম

সকলই ফুরায়ে যায় মা!

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

একদা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধরিত্রী মাতার অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিদগ্ধ কাব্যরসে সিঞ্চিত হয়ে রচনা করেছিলেন তাঁর নান্দনিক কবিতা। তাঁর লেখনী সেদিন বিশ্ব বন্দনায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল,
‘আমার পৃথিবী তুমি বহু বর্ষের। 
তোমার মৃত্তিকা সনে 
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে 
অশান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ।’
(বসুন্ধরাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আর আজ! কবির মননের সেই বিশ্বমাতা ‘পৃথিবী’ আছে। কিন্তু তাঁর বৈষয়িক সবকিছুই যেন হারিয়ে যাচ্ছে! এই মায়ের সন্তান যে মানুষ, যারা তার রূপ রস পেয়ে তারই অপত্যস্নেহে লালিত হয়ে আসছে, তারাই নিষ্ঠুর হাত উঁচিয়ে মায়ের সবকিছু ধ্বংস, লোপাট করে দিচ্ছে! মানুষ হয়ে মানুষের শান্তির নিবাস, তার হিরণ্ময় পরিবেশ বিষাক্ত ক’রে তুলছে। কী প্রাকৃতিক, কী সামাজিক, সবকিছুকে আজ মানুষের করাল থাবা রাহুর মত জেঁকে ধরেছে। যেন সবকিছুর অনিবার্য ধ্বংসই আজ সকলের কাম্য। সকলের সাধনা।

চিরায়ত সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই গ্রহ। এই পৃথিবী। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শূন্যে মহাশূন্যে বিজ্ঞানীরা আজও হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন, আর কোথাও অন্য একটি এ রকম বাসযোগ্য পৃথিবী খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। যেখানে আছে ঠিক এখানকার মত প্রাণদায়ী মৃত্তিকা, অম্লজান আর জলের সামষ্টিক সুদূরবিস্তারি উপস্থিতি। যেখানে অনায়াসেই বীজেরা অঙ্কুরিত হয় প্রাণিত উচ্ছ্বাসে। যেখানে নৈসর্গিক লীলাভূমিতে বিচরণ করে যত প্রাণীকুল। পাখিরা মেতে ওঠে কলকাকলিতে। আছে কি এমন অসীম নির্ভরতায় পরিপূর্ণ আরেকটি পৃথিবী, অন্য কোথাও? অন্য কোন গ্যালাক্সিতে? 

আছে কি? বিজ্ঞানীরা তো হন্যে হয়েই খুঁজে মরছেন! এ যাবত তাঁরা যা কিছু তাঁদের অভিজ্ঞানের আয়ত্তে পেয়েছেন, পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ আর প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলের অনেক তথ্য-উপাত্ত। পেয়েছেন সেখানে পাষাণময় বিস্তীর্ণ প্রান্তরের সন্ধান। বিস্তর শিলা, পাথরখন্ড, পাহাড়-পর্বত, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের সন্ধান। আরও কত কী! আবার, সম্প্রতি মঙ্গলে বরফের অস্তিত্বও নাকি আবিষ্কৃত হয়েছে! তো, এতকিছু মানুষের জন্য অনেক প্রাপ্তি। ভবিষ্যতে অনেক সাফল্যের উজ্জল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে কোথাও কি আছে আমাদের পায়ে চলার মেঠোপথ? পাশে যে চরম অবহেলায় অতি সাধারণ দূর্বা-ঘাস তার নিজস্ব স্বতস্ফুর্ততা নিয়ে  বেড়ে ওঠে তার কোন বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব? আছে কি শাপলা, গোলাপ, জবা, জুঁই, চামেলির মনোরম মুগ্ধতা?  মৎস্যকূলের, পাখ-পাখালির অবাধ বিচরণ কোথাও আছে কি? জীর্ণ দালানের স্যাঁতস্যাঁতে কার্নিশে বেড়ে ওঠা বটবৃক্ষের ছোট্ট চারাগাছ? আছে? শোনা যাচ্ছে খুব শিগগিরই মানুষ নাকি চাঁদে, একান্ত নিরালায় তাদের অবকাশ-যাপনকেন্দ্র গড়ে তুলবে। অর্থ, প্রযুক্তি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন কোন দেশ নাকি, চাঁদে হোটেল তৈরি করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। তা হতেই পারে। তাতে, সহসাই আমাদের প্রতিবেশী চাঁদের একাকীত্ব ঘুচে যাবে। সৌখিন পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে তার কক্ষপথ ! নর-নারীর হাস্য-কলকাকলিতে, মারদাঙ্গা মিউজিকে এবং খাবার টেবিলের টুংটাং শব্দে মুখরিত হয়ে উঠবে চাঁদের ধূসর, নির্জন প্রাঙ্গণ!  বোধ করি, সেদিনও খুব বেশী দূরে নেই!

এখন প্রশ্ন, আজ মানুষের প্রকৃত অবস্থান কোথায়? পিছনের একটি শতাব্দী অতিক্রম ক’রে আর একটি শতাব্দীর সিকি ভাগে দাঁড়িয়ে, মনের পাখা মেলে মানুষ, মুহুর্মুহু গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে ঊর্ধ্বে ছুটে চলার। পৃথিবীর সীমান্ত পেরিয়ে, মাধ্যাকর্ষণের, অভিকর্ষের নাগালের বাইরে হবে এই পার্থিব মানুষের অবস্থান। মহাশূন্যে শুধুই ভেসে বেড়ানো। ঠিক মাছ যেমন জলে ভেসে বেড়ায়। পাখী যেমন অবাধে আকাশে উড়ে বেড়ায়। তাই মানুষও স্বপ্ন দেখে, অন্য আরেকটি গ্রহে নিজের ঠিকানা ভিত রচনা করতে। এই যেমন সে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছুটে যাচ্ছে মহাকাশের খোলা জানালায়। এত কিছুর পর, সে কি অন্য আর একটি গ্রহে তার আবাস গড়বে না? তবে এ কথা ঠিক তার জানা, সে চাঁদ বা অন্য কোন গ্রহ যা ই হোক না কেন; এই পৃথিবীর মতো সে আর হচ্ছে না! আকাঙ্ক্ষিত সেই গ্রহান্তরে থাকবে না গাছ থেকে, উঁচু দালানের ছাদ থেকে মাটিতে পড়ে অপমৃত্যুর সমূহ ভয়। কারণ সেখানে তো মানুষ সন্তানকে মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নেবার মত পৃথ্বীমাতা নেই। আছে চন্দ্রমাতা! অথবা হতে পারে মঙ্গলমাতা! তো, সেই মায়েরা অভিকর্ষের তাড়নায় মানুষকে কেবল, দূরেই ঠেলে দিতে চাইবে! এই আমাদের পৃথ্বী মায়ের মত, বোধ করি চন্দ্র, মঙ্গল মাতৃস্নেহে অতি দ্রুত মানুষকে নিজেদের বুকে টেনে নেবে না!

হ্যাঁ। পৃথিবী আমাদের মা! এটিই সত্য। আমরা মানুষ, জন্ম নিয়েই ভর করেছি এই মায়ের কোলে। পরম আদরে নির্বিঘ্ন আশ্রয়ে ঠাঁই মিলেছে আমাদের, এই তারই বুকে। তার আঁচলেই আমরা শান্তির পরশ লাভে ধন্য হয়েছি! অন্ন, জল, আলো, বাতাস, আশ্রয় … প্রয়োজনে সবকিছুই পেয়ে পরম নির্ভরতায় বেড়ে উঠেছি ক্রমাগত এই মায়ের কোলেই। এভাবেই অনাদিকাল থেকে মানুষের পৃথিবী তার সন্তানদের, পরম স্নেহে লালন-পালন করে আসছে মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে।  

তো, আমরা কী দেখছি এখন? কিছু মানুষ এই মাকেই অবহেলা করছে! পৃথিবী-মাতার চির সৌন্দর্যে নির্মম গাইতি চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে সবকিছু! যেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই মানুষের কাছে, একান্ত অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছে। একেবারেই বাহুল্য, পরিত্যাজ্য মনে ক’রে দূরে ঠেলে, ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে পৃথিবীর সৌন্দর্য সব! এই যেমন, চোখের নিমেষেই বন-বাদাড়, টিলা-পাহাড়, নদী-বিল সব উজাড় হয়ে যাচ্ছে দ্রুত! সোনালি শস্যদানায় পরিপূর্ণ বিস্তীর্ণ জমি এখন, নগরায়নের ধাক্কায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বনের হরিণী, অমিততেজী ব্যাঘ্র-সিংহ, বিশালাকায় হাতী আর অজগর, কচ্ছপ-সজারু, বানর-খরগোশ … প্রাণভয়ে তারা সব কোথায় পালিয়ে যাচ্ছে! আবার, মানুষের থাবার সামনে টিকতে না পেরে সমূলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে! মানুষের তৈরি যানবাহন, কল-কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, যতসব বর্জ-আবর্জনা পৃথিবীর বাতাস ভারী করে তুলছে। সভ্যতার বর্জ-আবর্জনায় প্রাণের অবাধ বিচরণক্ষেত্র নালা-খাল, বিল-নদী এমনকি সাগর-মহাসাগর কলুষিত হয়ে পড়ছে! 

আবার দেখি মাছ সহ অন্য সমস্ত জলজ প্রাণী, এমনকি উদ্ভিদ সমূলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে! বনের বৃক্ষরাজি যা মানুষ অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে রোপণ করেছে পরম আদরে এই ধরিত্রীকে বাঁচাবো বলে, কতক মানুষ আবার হিংস্র হায়েনার মত এগুলোকে নির্বিচারে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়-টিলা, বন-বাদাড় কেটে উজার করে দিচ্ছে! 

শুধু কি তাই? এই পৃথিবীর বুক বিদীর্ণ করে মানুষ এখন, নিঃসীম সুদূরের অন্তরিক্ষে থাবা মেলছে! বলতে গেলে, বিস্তীর্ণ অবারিত মহাকাশও এখন নিরাপদ নয়। নীচের পৃথিবীকে কেন্দ্র ক’রে, দ্রুত ধাবমান বিমানের, মহাকাশযানের এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ধোঁয়ায়, শব্দে মহাকাশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে! যত সমস্ত সচল, বিকল উপগ্রহ সব মিলে মহাকাশ এখন, সুবিশাল ভাসমান আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে! আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রাখা ওজোন-স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি অবাধে সরাসরি নেমে আসছে ভূ-মণ্ডলে। ফলে ওজোন-স্তর সূর্যের ক্ষতিকারক অতি বেগুনী রশ্মি থেকে পৃথিবীকে ঢালের মতো সুরক্ষা করতে পারছে না। এখন এই ওজোন-স্তরের ভঙ্গুরতার কারণেই, পৃথিবী আক্রান্ত হচ্ছে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে। তার অধিবাসী মানুষ হচ্ছে প্রভাবিত। ক্যানসার সহ নতুন নতুন রোগ-ব্যাধি এবং মহামারীর শিকার হচ্ছে তারা। 

এই সকল অনাচার-ব্যভিচারের মর্মন্তুদ পরিণতি এই জগতের অধিবাসী সকলে প্রত্যক্ষ করছে! এই অনিবার্য, দুর্লঙ্ঘ পরিণতির প্রভাব সবুজ নিসর্গের উপর দ্রুতই বিস্তার লাভ করছে। দিনে দিনে প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র, চিরায়ত সৌন্দর্য হারিয়ে চূড়ান্ত ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে! ইতোমধ্যে অগণিত বিচিত্র উদ্ভিদের, প্রাণীর বর্ণিল প্রজাতি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এবং অগ্রসরমান সভ্যতার অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার  এই চলমান প্রক্রিয়ার দ্রুতধাবমান চাকার নীচে কালে কালে পিষ্ট হয়েই যাচ্ছে অসহায় প্রকৃতি-জীব-প্রাণীকুল! স্বার্থান্ধ এবং দুর্বিনীত চরিত্রের কিছু অর্বাচীন মানুষের দূর্বৃত্তপনার কারণেই পৃথিবীতে নেমে আসছে, যত প্রাকৃতিক ঝঞ্জা। রোগ-ব্যাধি। মহামারি। এই সমস্ত অপঘাতের কারণে, অসহায় সাধারণ মানুষকে বেঘোরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, এই পৃথিবীর  আসন্ন অন্তিম-দশাটাই দেখতে চায় এই দুর্বৃত্তরা! এই জগতের সকল অধিবাসীকে নির্বিবাদে, তাও প্রত্যক্ষ করতে হবে!

যে বিজ্ঞান মানুষের দুঃখ মোচন করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম, সেই বিজ্ঞানই মানুষকে আজ চরম অনিরাপত্তায়; রোগের শোকের আর যন্ত্রণার মৃত্যুকূপে ঠেলে দিচ্ছে! তথাকথিত ‘পরাশক্তি’ অভিধায় পরিচিত দেশগুলো এবং তাদের প্রতিপক্ষ ছোট-খাটো দেশগুলোও নিজেদের অর্জিত শক্তির মহড়া দেখাতে গিয়ে, মারণাস্ত্রের ঝনঝনানিতে এই পৃথিবীকে করে তুলেছে উত্তাল এবং বিপদসংকুল। কোথায় একজনের বিপদে আর একজন ছুটে আসবে মানুষ, তা না ক’রে তারা মানব বিধ্বংসী প্রযুক্তি উন্নয়নে দিনরাত খেটে মরছে। যুদ্ধপ্রযুক্তি উন্নয়নে তারা, পুরোটাই আত্ননিয়োগ ক’রে ব্যস্ত রাখছে নিজেদের। দূরপাল্লার সুপার পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করতে, আবার আকাশেই তাকে প্রতিহত করতে যত গবেষণায় জনবল, অর্থবল ও মানব-কল্যাণে ব্যবহার্য সম্পদের লগ্নি করছে বিস্তর! দিনে দিনে মানবতার ধ্বজাধারী পরাশক্তিগুলো মানবিক না হয়ে পারমানবিক হয়ে পড়ছে! বলা যায়, বিশ্বের মোড়ল শ্রেণীর তাবৎ মানুষ নৈতিকতায় মণ্ডিত মানবীয় জগত থেকে ছিটকে গিয়ে দানবের পোশাক পরিধান করেছে। 

তারা শান্তিবাদী মানুষের মনোজগতেও আঘাত হানছে অনবরত! তাতে বিশ্ববাসী সকলেই চরম উতকন্ঠা নিয়ে অস্থির জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।শান্তিবাদী অসহায় মানুষ, কোথাও নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারছে না। জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাই তারা, নিজেদের আপন ঠিকানা প্রিয় দেশ, আবাস এবং আত্মীয়-পরিজন পরিত্যাগ করে যে যেমন পারছে হন্যে হয়ে অন্য দেশে ছুটে পালাচ্ছে। তারা সমস্ত স্থাবর-অস্থাবরের মূল্য দালালদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। তারপরেও তারা পৌঁছাতে পারছে না আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। পথিমধ্যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে তারা।  

দেশে দেশে আজ রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা গোটা মানবসভ্যতাকে বিপর্যস্ত ক’রে তুলছে। রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবর্গ যাদেরকে সাধারণ জনগোষ্ঠী সরল মনে বিশ্বাস করে, যাদের উপর রয়েছে তাদের সীমাহীন অকুণ্ঠ নির্ভরতা; তারাই আজ সাধারণ মানবকুলকে বিপথগামী করছে। তাদের দখলদারত্ব সর্বত্র। মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেণীর লালসার শিকার হচ্ছে, হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, প্রান্তিক জনগণ। কারও কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার জোরে চলছে সমাজ, রাস্ট্র। তারা ফতোয়াবাজ, ধর্মশাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যাদানকারী। তারা নারী শিশু অসহায়দের উপর নির্যাতনকারী। তারা নারী, শিশু, অবৈধ অস্ত্রের ও মাদক, সোনা, অর্থ পাচারের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয় দেশে দেশে। সব কিছুর গডফাদার হয়ে তারা মানব-সম্পদ, প্রাকৃতিক-সম্পদ জবর-দখল ক’রে ঐশ্বর্যের পাহাড় গ’ড়ে তুলছে। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষের লাশের উপর গ’ড়ে তোলে স্বপ্নের অট্টালিকা। শিক্ষাঙ্গনে চৌর্যবৃত্তি, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই-খাতা-কলমের পরিবর্তে মাদক, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তুলে দেয়া, সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত ক’রে সন্ত্রাসীদেরকে লেলিয়ে দেয়া, মানুষের সম্পদ বিনষ্ট করা ইত্যকার মুষ্টিমেয় এই কয়েকজনেরই কাজ। শান্তিবাদী সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, কী চায় তারা? তারা কি চায়, শুধু তারা বাদে পৃথিবীর আর সমস্ত দুর্বল মানুষ ম’রে যাক? শুধু বেঁচে থাকবে তারা?’

প্রকৃত চিত্র তাই। সমাজের ও রাষ্ট্রের এই দুর্বৃত্তদের বসতবাড়ি, বিনোদনকেন্দ্র, সম্পদের পাহাড় আলিশান হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ এভারেস্টের মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায়!  দেশে দেশে চলে তাদের অবাধ প্রমোদ-বিচরণ। সমাজের, রাষ্ট্রের ধনিক এই তারাই সিংহভাগ সম্পদ লুটে নিচ্ছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। লুটেরা এই ধনিক শ্রেণীর লাঞ্ছনার, বঞ্চনার শিকার হচ্ছে ভাগ্য বিড়ম্বিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কালে কালে তারা, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর পর্যায় নেমে আসছে। এখন তারা, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে তাদের সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে। 

এই যদি হয় আমাদের পৃথিবীর অবস্থা, তবে এই পৃথিবীর প্রকৃতিও আর মানুষের পক্ষে থাকবে না। ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তার ‘বিট্রে’ করার পালা। এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে বুঝি পৃথিবী-মাতার। সে এখন ক্ষুব্ধ! প্রতিশোধ পরায়ণা হয়ে উঠেছে! অতি-বৃষ্টি, খরা, বন্যা, দাবানল’ ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, ভূমিধস ইত্যাদি মাতিয়ে তুলছে এই পৃথিবীকে। মানুষের সভ্যতাকে, প্রকৃতি সে আজ করতে চাচ্ছে দলিত-মথিত। অনাদরে যেখানে মানুষ শাণিত গাইতি চালায় প্রকৃতির বুকে, আর সেখানে কত নীরবে চোখের জল ফেলা মায়ের? মা কি আর নীরব থাকতে পারে?

তাই পৃথিবী-মাতা আজ অস্থির! বিশ্ব-প্রকৃতি চরম বিরক্ত হয়ে উঠেছে মানুষের উপর! এখন সে, মেতে উঠতে চাইছে তান্ডবলীলায়। চূড়ান্ত ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে তার! তার চরম আক্রোশ নিয়ে ভেঙ্গে চুরমার, ধূলিস্যাত ক’রে দিতে চায় সে মানুষের দর্পকে! বিজ্ঞানের নামে অজ্ঞানের যত হোলিখেলা, সামাজিকতার অবক্ষয়, রিপুর যন্ত্রণায় তাড়িত এই মানুষকেই আজ অজ্ঞাত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ভুগে ভুগে জীবন দিতে হচ্ছে অকালে! এই কি তবে সভ্যতার চরম বিকাশ ও পরম প্রাপ্তি? 

কেউ কেউ সন্ত্রাসকে লালন করছে। তারা অন্তরালে, সন্ত্রাসীদের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের যোগান দিচ্ছে। নানান ইস্যুকে পুঁজি ক’রে, এ বিশ্বকে অস্থির ক’রে তোলার ষড়যন্ত্র করে।  আবার কিছু মানুষ, সরব হয়ে উদাত্ত-কণ্ঠে শান্তির ললিত-বাণী দিনরাত প্রচার ক’রে যাচ্ছেন। এই পৃথিবীকে, প্রকৃতিকে, মানব সভ্যতাকে সুরক্ষা করার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা। প্রশ্ন, এখন আমরা কী করব? মানবতার কাছে, এই সমস্ত অশুভ শক্তির পরাজয় কি হবে না কোনদিন? মানব কি তার দানবীয় চরিত্র ছুঁড়ে ফেলে; মানব হয়ে উঠবে না? 

এই চিত্র আমাদের আগামী পৃথিবীর এবং প্রজন্মের জন্য সুখকর নয়! মনে রাখতেই হবে আমাদের, আমরা ভবিষ্যতের এবং আমাদের উত্তর-প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি, একটি অনাবাদি, জরাগ্রস্ত ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবী! এই সময়ের জন্য, এটাই আমাদের জন্য চরম বাস্তব! তাই, এই পৃথিবীর অধিবাসী, আমাদের সবাইকে এখন এক কাতারে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, না! এ ভাবে আর নয়! আমাদের এই পৃথ্বী মাতাকে, এই মানব সভ্যতাকে আসন্ন ধ্বংস থেকে রক্ষা করতেই হবে। প্রতিহত করতে হবে সকল ষড়যন্ত্র। এই সময়, সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। 

অন্যদিকে এখন শুনি, বিশ্বমানবের কণ্ঠে আহাজারি, ‘আমাদের মা এই পৃথিবীর, সব কিছুই কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? নিঃশেষ হতে হতে কি এক পর্যায়, এই পৃথিবী মহাশূন্য থেকে ছুটে আসা কোন উল্কাপিণ্ডের আঘাতে জ্বলে পুড়ে ভেঙ্গেচূরে ছাই হয়েই যাবে? তখন কোথায় থাকবো মানুষ আমরা? কোথায় থাকবে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বপ্ন-সাধনা-সভ্যতা?’

তাই তারা, সকলেই একযোগে আজ কেঁদে কেঁদে আমাদের পৃথিবী মাকে উদ্দেশ করে বলছে,

‘মা, আমার সাধ না মিটিল
আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা!’

Views: 2

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন