ইরানের সামরিক বাহিনী গত মাসে পারস্য উপসাগরে তাদের নৌযানে সামুদ্রিক মাইন উঠিয়েছে—এমন তথ্য পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ বেড়ে যায়। মার্কিন কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছিল, বিভিন্ন স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার জবাবে সে সময় হরমুজ প্রণালি অবরোধ করার প্রস্তুতি হিসেবে এ পদক্ষেপ নিচ্ছিল তেহরান।
যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। গোপন গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দুই কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, আগে থেকে অজানা এ প্রস্তুতির বিষয়টি গত ১৩ জুন ইরানে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর শনাক্ত করা হয়।
হরমুজ প্রণালিতে এসব মাইন এখনো ব্যবহার করা হয়নি। তবে এ প্রস্তুতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এ বাণিজ্যপথ বন্ধ করার বিষয়ে ইরান এবার সত্যিই অগ্রসর হতে চেয়েছিল। পথটি বন্ধের পদক্ষেপ নিলে সেটি ইরান–ইসরায়েল চলমান উত্তেজনা আরও জটিল করে তুলত ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা দিত।বিশ্বের মোট জ্বালানি তেল ও গ্যাস পরিবহনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই হরমুজ প্রণালি দিয়ে যায়। এটি বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যেত হু হু করে। তবে এর উল্টোটা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। বিশ্লেষকদের মতে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ না হওয়ায় বাজারে স্বস্তি ফিরেছে।
২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় ওই হামলা চালায়। এর পরপরই ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা নিয়ে এক প্রস্তাবের পক্ষে রায় দেয়। যদিও এটি মানা বাধ্যতামূলক ছিল না। ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদই প্রণালি বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ইরান এর আগেও বহুবার প্রণালি বন্ধের হুমকি দিলেও তা কখনো কার্যকর করেনি।
ইসরায়েল-ইরান পাল্টাপাল্টি হামলার সময় তেহরান ঠিক কবে মাইন উঠিয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারেনি রয়টার্স। মাইনগুলো পরে নামানো হয়েছে কি না, তা–ও অজানা।
যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে মাইন বোঝাইয়ের বিষয়টি শনাক্ত করেছে, সেটি বিস্তারিত জানাননি মার্কিন দুই কর্মকর্তা। তবে সাধারণত এ ধরনের তথ্য স্যাটেলাইট চিত্র বা মনুষ্য গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা উভয়ের সমন্বয়ে সংগ্রহ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের (ট্রাম্প) চমৎকার দক্ষতায় পরিচালিত অপারেশন “মিডনাইট হ্যামার” (ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের চালানো হামলা), হুতিদের (ইয়েমেনের বিদ্রোহী) বিরুদ্ধে সফল অভিযান ও সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের (ইরানের ওপর) কৌশলের কারণে হরমুজ প্রণালি এখন উন্মুক্ত। সেখানে অবাধে নৌ চলাচল নিশ্চিত হয়েছে এবং ইরান ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়েছে।’
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। জাতিসংঘে ইরানি মিশনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
কৌশলগত গুরুত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তা আরও বলেন, ইরানের এ মাইনবোঝাই পদক্ষেপ শুধু চাতুর্যের কৌশলও হতে পারে। তেহরান হয়তো বোঝাতে চেয়েছে যে হরমুজ প্রণালি বন্ধে তারা প্রস্তুত অথচ আসলে তা করতে চায়নি। আবার ইরানের সামরিক বাহিনী হয়তো শুধু শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশের অপেক্ষায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেটিও হতে পারে।
হরমুজ প্রণালি ওমান ও ইরানের মধ্যবর্তী জলসীমা, যা পারস্য উপসাগরকে গালফ অব ওমান ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। প্রণালির সবচেয়ে সরু অংশের প্রস্থ মাত্র ২১ মাইল (৩৪ কিমি)। এর মধ্যে জাহাজ চলাচলের জন্য দুই দিকেই মাত্র দুই মাইল চওড়া পথ রয়েছে।
তেল রপ্তানিকারণ দেশ তথা ওপেকভুক্ত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাক তাদের অধিকাংশ অপরিশোধিত তেল এ প্রণালি দিয়ে রপ্তানি করে। এ তেল যায় মূলত এশিয়ায়। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ কাতারও তাদের প্রায় সব তরল গ্যাস এ পথেই পাঠায়।
আবার ইরানও তাদের বেশির ভাগ অপরিশোধিত তেল এ পথেই রপ্তানি করে। ফলে প্রণালি বন্ধ করলে তেহরানের নিজেরই ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরপরও ইরান বহু বছর ধরেই প্রণালি বন্ধের প্রস্তুতিতে বিপুল সম্পদ ব্যয় করে যাচ্ছে।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের কাছে পাঁচ হাজারের বেশি সামুদ্রিক মাইন ছিল। এগুলো ছোট ও দ্রুতগামী নৌযানের মাধ্যমে দ্রুত স্থাপন করা সম্ভব।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন