নতুন অধ্যায়ের সূচনার পথে ইউক্রেন। সুইডেনের তৈরি অত্যাধুনিক গ্রিপেন যুদ্ধবিমান শিগগিরই যোগ হতে পারে ইউক্রেনের বিমানবাহিনীতে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের মধ্যেই এই বিমানগুলো ইউক্রেনের আকাশে দেখা যেতে পারে।
সম্প্রতি সুইডেন ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার আওতায় ইউক্রেন ১০০ থেকে ১৫০টি জেএএস-৩৯ মডেলের গ্রিপেন-ই যুদ্ধবিমান কিনবে। এটি সুইডেনের অন্যতম আধুনিক মাল্টিরোল ফাইটার জেট।
সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন বলেছেন, এই প্রকল্পটি ১০ থেকে ১৫ বছরের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং এর ডেলিভারি তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়।
ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর যোগাযোগ বিভাগের প্রধান ইউরি ইহনাত জানান, যুদ্ধবিমান কেনা সহজ বিষয় নয়। এসব চুক্তি হয় আন্তঃসরকার পর্যায়ে, যা সময়সাপেক্ষ ও জটিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইউক্রেন দ্রুত গ্রিপেন ই নয়, বরং এর পুরোনো সংস্করণ সি/ডি মডেলগুলো পেতে পারে। তবুও তারা বলছেন, এই বিমানগুলোর সংযোজন ইউক্রেনের বিমান সক্ষমতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে।
গ্রিপেন জেট তার গতি, বহুমুখী তৎপরতা, উন্নত রাডার ও কম রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের জন্য পরিচিত। এটি আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে স্থলে এবং নজরদারি মিশনে সমানভাবে কার্যকর। জেটটির সর্বশেষ সংস্করণ গ্রিপেন ই, জেনারেল ইলেকট্রিকের এফ৪১৪জি ইঞ্জিনে চালিত, যা ঘণ্টায় প্রায় ২ হাজার ১৩০ কিলোমিটার গতিতে (ম্যাক ২) উড়তে সক্ষম। উন্নত রাডার, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এবং বিশাল প্যানোরামিক ডিসপ্লে যুক্ত এই বিমান বাস্তব সময়ের যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্ণ চিত্র পাইলটকে দেয়।
২০২৫ সালের মে মাসে গ্রিপেন ই প্রথমবারের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা চালিত হয়ে ইতিহাস গড়ে। ‘সেন্টোর’ নামে পরিচিত এই এআই পাইলট তিনটি ফ্লাইট মিশন সম্পন্ন করে। এর মাধ্যমে বিমানের উন্নত বিয়ন্ড ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ, যুদ্ধ ক্ষমতা প্রদর্শন করে।
পুরোনো গ্রিপেন সি/ডি তুলনামূলকভাবে কম উন্নত, তবে এখনো শক্তিশালী মাল্টিরোল ফাইটার। এটি ভলভো আরএম১২ ইঞ্জিনে চলে, ওজন ও জ্বালানি ধারণক্ষমতা কিছুটা কম হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর।
গ্রিপেনের অন্যতম শক্তি এর বহুমুখী অস্ত্রসজ্জা। এটি মেটিওর ও এআইএম-১২০ এএমআরএএম ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে দূরপাল্লার আক্রমণ চালাতে পারে, আবার আইআরআইএস-টি ও সাইডউইন্ডার দিয়ে কাছাকাছি লড়াইয়েও সমান কার্যকর।
সামরিক বিশেষজ্ঞ আন্দ্রি খারুক বলেন, ‘গ্রিপেনের বড় সুবিধা হলো এটি মেটিওর মিসাইল বহন করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নেই।’ এছাড়া সুইডিশ এই বিমানগুলোর তথ্য বিনিময় ব্যবস্থা মার্কিন লিংক-১৬ সিস্টেমের চেয়েও উন্নত।
গ্রিপেনের আরও একটি বড় সুবিধা হলো, এটি ছোট রানওয়ে বা সাধারণ সড়ক থেকেও উড়তে ও নামতে পারে। এটি রক্ষণাবেক্ষণে সহজ এবং দ্রুত পুনরায় উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত করা যায়। আদর্শ পরিস্থিতিতে মাত্র ১০ মিনিটেই একটি গ্রিপেন দ্বিতীয়বার আকাশে উঠতে পারে।
এই বিমানটির নকশায় একটি কৌশলগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে- এর ইঞ্জিনের বায়ুগ্রহণ পয়েন্টগুলো ফিউজলেজের পাশে অবস্থিত, ফলে রুশ আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত রানওয়ে থেকে উড্ডয়নকালে ধ্বংসাবশেষ ইঞ্জিনে ঢোকার ঝুঁকি অনেক কমে। তবে গ্রিপেন ই/এফ সংস্করণে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একাধিক যন্ত্রাংশ রয়েছে, যার ফলে এর রপ্তানি ও ব্যবহার নিয়ে ওয়াশিংটনের অনুমোদন প্রয়োজন হতে পারে।
রুশ অস্ত্র এখন ক্রমেই ফ্রন্টলাইনের পেছনে আঘাত হানতে সক্ষম হচ্ছে। বিশেষ করে গ্লাইড বোমা ঠেকাতে গ্রিপেনের মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সামরিক বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন, ‘শুধু মেটিওরই ৬০-১০০ কিলোমিটার দূরে রুশ সু-৩৪ বোমারু বিমানগুলোকে আঘাত করার মতো কার্যকর।’
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে রাশিয়ার ব্রিয়ান্স্ক, কুরস্ক, বেলগোরদ ও রোস্তভ অঞ্চলের লক্ষ্যবস্তুতেও পৌঁছাতে সক্ষম। তবে খারুক সতর্ক করে বলেন, ‘গ্রিপেন কোনো অলৌকিক অস্ত্র নয়, এটি কেবল ইউক্রেনের জন্য আরেকটি শক্তিশালী হাতিয়ার।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রিপেনের প্রভাব নির্ভর করবে কতগুলো বিমান ইউক্রেন পায় এবং কত দ্রুত তা সরবরাহ হয় তার ওপর। বর্তমানে সুইডেনের বিমানবাহিনী প্রায় ১০০টি গ্রিপেন পরিচালনা করছে, যার মধ্যে নতুন ও পুরোনো মডেল উভয়ই রয়েছে।
ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা দেখায়, এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। দেশটি ২০১৪ সালে গ্রিপেন কেনার চুক্তি করলেও ২০২৫ সাল পর্যন্ত হাতে পেয়েছে মাত্র ১০টি বিমান।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানিয়েছেন, সুইডেনের সঙ্গে গ্রিপেনের স্থানীয় উৎপাদনেও চুক্তি হয়েছে। যদিও সময়সূচি বা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখনো প্রকাশ করা হয়নি। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী এক বছরের মধ্যেই ইউক্রেন পুরোনো সংস্করণের প্রায় এক ডজন গ্রিপেন যুদ্ধবিমান পেতে পারে। ইতোমধ্যে সুইডেন গত সেপ্টেম্বরে এর যন্ত্রাংশ পাঠিয়েছে।

 
          
 প্রিন্ট করুন
                                প্রিন্ট করুন
                             
                    
 
  
  
  
 
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন