দর্পণ কবীর »
অপ-সাংবাদিকতা বা সাংবাদিকতায় নৈতিকতা বিবর্জন-এমন অভিযোগ অনেকদিন ধরে শুনছি। এই অভিযোগ বিগতদিনে খন্ডন করা যায়নি। আর এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, ‘সাংবাদিকতা’ অবক্ষয়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অপ-সাংবাদিকতা বা অনৈতিক সাংবাদিকতা নিয়ে দহন ও গøানি নিয়ে বাংলাদেশ বা দেশের বাইরে বসবাসকারী সাংবাদিকরা বিব্রতবোধ করতেন আগে, তারা এখন চরম লজ্জায় কুকড়ে থাকেন। কারণ, এ পেশা অবক্ষয়ের স্রোতে ধাবমান।
অথচ এই পেশাটি ‘মহান’ তকমায় উজ্জ্বল। যারা সাংবাদিকতা করতেন, তাদের প্রতি সমাজের সকল স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল। এখনও আছে, তবে গাছের চেয়ে আগাছা বেশি এবং কলম সৈনিকের চেয়ে ‘ছুরি চালানো’ বিশারদদের কারণে মানুষ দিনদিন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। যে ব্যক্তিরা সাংবাদিকতা পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে মানুষকে সন্ত্রস্ত করছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মাবে কেন? অপ-সাংবাদিকতার কারণে পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকদের এর জের সইতে হচ্ছে। এ পেশার সম্মান ও শ্রদ্ধা এখন প্রশ্নের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর জন্য দায়ী কে বা কারা? মিডিয়া হাউজ থেকে রাষ্ট্রকে এর জন্য দায়ী করা যায়। সমাজ বা নাগরিক অসচেতনতাও দায়ী। যে কেউ যে কোন কারণে এ পেশায় সম্পৃক্ত হতে পারছেন সহজভাবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া, যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়া বা মেধা ও মননের ম‚ল্যায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার প্রতিযোগিতা চলছে দেশের মিডিয়া জগতে। এতে অপ-শিক্ষিত ও অর্ধ-শিক্ষিতরা নানা কৌশলে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তারাই ম‚লতঃ সাংবাদিকতা পেশার অবক্ষয় সৃষ্টি করে চলেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিভিন্ন দেশে বাংলা মিডিয়ায় একই চিত্র।
সর্বত্র মিডিয়া জগতে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, প্রভাব বিস্তার বা মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোক এ পেশায় বিনিয়োগ বা চাকুরি করছে। তারা বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির যেমন স্বার্থ রক্ষা করে আবার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপ-সাংবাদিকতার ছোরা চালায়। বিনিময়ে টু-পাইস হাতিয়ে নেয় তারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও শহরে বিগত দু’দশকে অপ-সাংবাদিকতার সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে। স্থানীয় সাংবাদিকরা নিজ নিজ এলাকায় একাধিক প্রেসক্লাব গঠনও করেছেন। অনেক শহর বা উপ-শহরে স্থানীয় সাংবাদিকরা বø্যাক-মেইলিং করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় থানা-পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সু-সম্পর্ক রয়েছে।
গত কয়েকবছরে বিভিন্ন স্থানে মাদক ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকতা পেশা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। তারা হয়তো সাংবাদিকের মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে অর্থ লেনদেন করে ব্যবসা করছে অথবা কেউ কেউ অন-লাইন পোর্টালে বিনিয়োগ করে ‘মিডিয়া কর্মী’ হয়ে অবৈধ মাদক ব্যবসা জোরে-সোরে করছে। ঢাকার আশে-পাশে শহরগুলোতে এমন ঘটনা এখন ওপেন সিক্রেট।
উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করছি, ঢাকার সন্নিকটে নারায়ণগঞ্জ শহরে ২০ এর অধিক দৈনিক পত্রিকা বের হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে অনুমোদিত ছাড়াও ঢাকা জেলা প্রশাসনের অনুমোদিত দৈনিকগুলো নারায়ণগঞ্জে হামলে পড়েছে। ঐ দৈনিকগুলোর অধিকাংশটি পরিচালিত বা সম্পাদিত হচ্ছে অপেশাদার ব্যক্তি দ্বারা। ডিশ ব্যবসায়ী, বিয়ে পড়ানো কাজী, জুট-কাপড় ব্যবসায়ী, হাটের হাজারাদার, রাজনৈতিক দলের চাঁদা উত্তোলক ইত্যাদি পরিচয় যাদের ছিল, তারা এখন এই শহরে দৈনিক পত্রিকা বা পোর্টালের সম্পাদক বা মালিক। একাধিক ‘সম্পাদক’ পরিচয়দানকারী রয়েছেন, তারা মেট্রিক পাশও করেননি। অপ-শিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত ব্যক্তিরা মিডিয়ার মালিক হয়ে আছেন অর্থের জোরে। তারা জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা বা এমপি’দের সঙ্গে বৈঠক করার সুযোগ পান। চ্যালা-চামচারা সালাম দেয়।
সামাজিকভাবে মিডিয়ার মালিক পরিচয় দিয়ে আত্ম-প্রসাদে ভোগেন। তারা সাংবাদিকতায় ‘পেশাদারিত্ব’ বলতে কিছু বোঝেন না। বোঝেন শুধু, কতজন তাকে সালাম দিল-এর হিসাব। আর এ সব মিডিয়ায় কাজ করা কতিপয় ‘দ‚র্বৃত্ত’ সমাজে এই পেশার সম্মানকে ভ‚-লুণ্ঠিত করে চলেছে। তারা আজকে একজনের বিরুদ্ধে লিখে, কালকে অর্থ হাতিয়ে ঐ ব্যক্তির পক্ষে লিখে। একজন অর্থ দিয়ে গেলে সত্য-মিথ্যা’র যাচাই না করে সম্মানিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও কালিমা লেপন করা রিপোর্ট ছেপে দেয়।
পত্রিকার চেয়ে অন-লাইন পোর্টালগুলো এ অপকর্মে এক ধাপ এগিয়ে। এই উদাহরণ, শুধু নারায়ণগঞ্জেই নয়, দেশের অধিকাংশ জেলা ও শহরে একই চিত্র। খোদ ঢাকা শহরে কমপক্ষে দু’হাজার সাংবাদিক পরিচয়দানকারী ব্যক্তি ‘সাংবাদিকতা’ পেশায় জড়িত নেই। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও জাতীয় প্রেসক্লাবের শত শত সদস্যের পরিচয় হাতালেও এমন নেতিবাচক চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি।
প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও অনেক সাংবাদিক নেতা এই অভিযোগ তুলে নিজেদের মধ্যে আক্ষেপ করেন। এরমানে সাংবাদিকতা পেশায় যে অনিয়ম, অরাজকতা বা অবক্ষয়ের অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে, এর জন্য সাংবাদিকদের সংগঠনকেও দায়ী করা যায়। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বা জাতীয় প্রেসক্লাবের পরিচালনার ক্ষমতা পেতে বা আগলে রাখতে ‘সদস্য’ সৃষ্টির অপ-কৌশল দেখে আসছেন সাংবাদিকরা। এভাবেও সাংবাদিকতা পেশার সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে।
এ ছাড়া রয়েছে ‘দলদাস’ সাংবাদিকদের জোট। আওয়ামী লীগ সমর্থনকারী এবং বিএনপি-জামাত সমর্থনকারী সাংবাদিকরা নিজেদের মধ্যে বিভক্তি ও বিবাদ নিয়ে পড়ে আছেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন আওয়ামী ও বিএনপি শিবিরে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। আজ অব্দি এই বিভক্তিতে সাংবাদিক সমাজ। বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি পুরো দেশব্যাপী। এতে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পেরেছে ‘দলদাস সাংবাদিক নেতা’। আর ঐ দলদাস নেতাদের কেউ কেউ সরকারি দলের মদদপুষ্ট হয়ে সম্পদ গড়তেও পারছেন। ঢাকায় একাধিক সাংবাদিক নেতা এখন ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এ ছাড়া নৈতিক ম‚ল্যবোধহীন সাংবাদিকরাও ধন-সম্পদ গড়েছেন।
২০০০ সাল অব্দি ঢাকায় কর্মরত হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল। বর্তমানে কয়েক শ’ সাংবাদিক গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন। যদিও বেতন কাঠামো পরিবর্তন হয়েছে এবং সাংবাদিকদের বেতনও ঈর্ষণীয়রকম বেড়েছে, তারপরও অনেকের জীবন-যাপন এবং সম্পদের পরিমাণের কথা শুনলে বিস্মিত হতে হয়। এ কথা লেখার অন্যতম কারণ, সৎ সাংবাদিকতার চর্চা না থাকলে এবং সাংবাদিকদের চরিত্র নির্লোভ ও নৈতিকতায় অটুট না হলে মিডিয়া জগতে যে অধঃপতনের অশনি সংকেত শুনছি, তা আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। চলমান অবক্ষয়ের স্রোত ঠেকাতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যত কী হবে-তা ভাবলে উৎকণ্ঠা চরমে পৌঁছায়।
এবার রাষ্ট্রের ভ‚মিকার কথা তুলছি। সমাজ পরিবর্তনে রাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাখে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি মিডিয়ার অনক‚লে না থাকে অথবা মুক্ত সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলে ঐ সমাজ তথা রাষ্ট্রে সাংবাদিকরা বিপদগ্রস্থ হতে পারে। সাংবাদিকতায় ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ একটি খারাপ লক্ষণ। দেশে তা চলছে-ফিসফাস কণ্ঠে বলছেন সাংবাদিকরা।
টিআইবি’র তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ গত ৩০ বছরে দুর্নীতিতে ৫বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিগত জোট সরকার থেকে বর্তমান সরকারের আমলের চিত্র লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দুর্নীতি দিনদিন বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এখন তো শত কোটি বা হাজার কোটি টাকা লোপাট বা পাচার হওয়ার ঘটনা প্রায় ফাঁস হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ড্রাইভারের কাছে শত কোটি টাকার সম্পদ পাচ্ছে দুদক। একটি জেলার ছাত্রলীগের সভাপতিকে গ্রেফতার করা হয়েছে দু’হাজার কোটি টাকা পাচারের সুনির্দষ্ট অভিযোগে। উদাহরণ আরো আছে। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে যায়, সে দেশের সাংবাদিকরা ‘সাধু’ সেজে থাকবে-এমনটা আশা করা যায়না। দুর্নীতির ছোবল সর্বত্র পড়ে। কালো টাকা প্রশাসনে যেমন ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি মিডিয়া জগতেও ছড়ায়।
এরওপর রয়েছে, সরকারি দলের তোষণনীতির প্রতিযোগিতা। সরকারি দলের নেতারা সৎ সাংবাদিকতা চান কিনা-এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে তারা তোষণনীতির সাংবাদিক পছন্দ করেন-এটা বলা যায়। ‘সমালোচনা নয়, লুটো এবং চুপচাপ থাকো’ এমন এক ঘোষণা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের মুখে-অপ-সাংবাদিকতা রোধের কথা থাকলে বাস্তবে অপ-সাংবাদিকতা রোধে কঠোর ভ‚মিকা নিতে দেখা যায় না। তবে বর্মতান সরকার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে অপ-সাংবাদিকতা রোধে একটি ঐতিহাসিক ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।
যদিও এ আইনের কিছু ধারা ‘মুক্ত ও অবাধ সাংবাদিকতা’র জন্য প্রবলভাবে অন্তরায়। নতুন আইনটির কয়েকটি ধারা-উপধারা সংশোধন করা হলে মুক্ত সাংবাদিকতায় যেমন প্রতিবন্ধকতার কথা উঠতো না, তেমনি অপ-সাংবাদিকতা রোধে তা প্রশংসা পেতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, জ্ঞাত বা অজ্ঞাত পোর্টাল বা সোস্যাল মিডিয়ায় অশুভ বা বিকারগ্রস্থরা বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও কুৎসা রটায়। এই আইনের কারণে এ ধরনের ন্যাক্করজনক কাজ প্রতিহত হবে বাংলাদেশে। এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল দেশে, তবে আইনটিকে ‘মুক্ত সাংবাদিকতা’র বাধা হিসাবে দেখা হচ্ছে। এ কারণে, বলতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে অপ-সাংবাদিকতা প্রতিরোধে। পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সুস্থ সাংবাদিকতার।
মিডিয়া জগতে লেখার স্বাধীনতা অবাধ ও নিশ্চিত করে সাংবাদিকতা পেশার উজ্জ্বলতা বাড়াতে হবে। মিডিয়ার বিকাশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাও গুরুত্বপ‚র্ণ। গণতান্ত্রিক পরিবেশ বহাল থাকলে মিডিয়ার গুরুত্ব ও কদর বাড়ে। এতে সাংবাদিকতা পেশার সম্মানও বাড়ে। সাংবাদিকদের সম্মান ও সম্মানী যথাযথ হলে তাদের মধ্যে ঐক্য এবং সৌহার্দ্য বিরাজ করে। আর এর মধ্য দিয়ে অপ-সাংবাদিকতা রোধে সৎ সাংবাদিকরাই মাঠে নামে। এ সবের সমন্বয় না ঘটলে, যে অবক্ষয়ের স্রোত মিডিয়া জগতে বইছে, তা কতদ‚র যাবে, দেখতে হলে তাকিয়ে থাকতে হবে ভবিষ্যতের দিকে।
লেখক পরিচিতিঃ সম্পাদক, দেশকণ্ঠ ডটকম ও সাবেক সভাপতি, আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন