রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

শিরোনাম

আজ বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস: ‘মর্যাদার জন্য একতা’

রবিবার, জানুয়ারী ৩০, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ডাক্তার মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: দেশে করোনা মহামারীর এ পরিস্থিতির মধ্যেই বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস ২০২২ পালিত হচ্ছে রোববার (৩০ জানুয়ারি)। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সে হিসাবে এ বছর ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টি দেশে কুষ্ঠরোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এ দিবস পালন করা হয়। আর এ দিবসের উদ্দেশ্য হল কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করা। জনবিচ্ছিন্ন কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে পুনঃগ্রহণ, সব প্রকার কুষ্ঠজনিত কুসংস্কার দূরীকরণ, এ সকল লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে জনসাধারণ এবং কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য ও শিক্ষা দেয়াই হচ্ছে এ দিবসের লক্ষ্য।

এ বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মর্যাদার জন্য একতা’। যারা কুষ্ঠ আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মর্যাদাকে সম্মান জানানোর জন্য একতার প্রতি এ বছরের প্রতিপাদ্যে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কুষ্ঠবিরোধী সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ‘আইলেপ’, যা ১৩টি আন্তর্জাতিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত, এ দিবসটি পালনে উদ্যোগ নেয়। আইলেপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাউল ফোলেরো বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠরোগ বিষয়ক ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি কল্পে ও কুষ্ঠরোগের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৫৪ সালে দিবসটি উদযাপনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

কুষ্ঠ রোগের নাম শুনলে আজও আতঙ্ক ছড়ায়। কারো এমন রোগ হয়েছে শুনলে আজও অনেকে সেই ব্যক্তির চারপাশে ঘেঁষতে চান না, এড়িয়ে থাকেন। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক যন্ত্রণা তো থাকেই, পাশাপাশি ওই ব্যক্তি ও তার পরিবারকে নানারকম সামাজিক ও মানসিক সমস্যায় পড়তে হয়। মানসিক এ জন্য, কারণ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে অচ্ছূত হিসেবে গণ্য হন। এ রোগের কারণে ত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ত্বকে পচন ধরে। তাই কুষ্ঠ রোগীকে অনেকে ঘেন্না করে। কিন্তু মনে রাখা দরকার কুষ্ঠ কোন পাপ নয় এবং এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অপরাধী নন। কুষ্ঠ একটি জীবাণুবাহিত সংক্রামণ। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও উপযুক্ত চিকিৎসায় এ রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। তাই মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি। আর কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম যথা- হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলোতে এ রোগের উল্লেখ আছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত মিসর, চীন, গ্রিক, রোম, ভারত ইত্যাদি প্রায় সব কয়টি দেশের ইতিকথায় এর বিবরণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এ রোগের ইতিহাস চার হাজার বছরের পুরনো। এ রোগের সবচেয়ে পুরনো কংকাল-নির্ভর প্রমাণ মেলে ভারতবর্ষে, যা প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার সালের সময়কার। তবে, রোগটির সাথে মানুষের পরিচয় কয়েক হাজার বছর আগের হলেও, এর প্রকৃত কারণ তাদের জানা ছিল না। তেমনি এর কোন চিকিৎসাও তাদের জানা ছিল না। ফলে, শত সহস্র বছর ধরে এ রোগকে কেন্দ্র করে চলে আসে নানা অলীক ধারণা ও কুসংস্কার, যার নির্মম শিকার হয়ে সমাজে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়েছে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। কোথাও এটাকে মনে করা হয়েছে বিধাতার অভিশাপ, কোথাও বা পাপাচারের ফসল। এ রোগের কার্যকারণ বা প্রতিকারের বিষয়ে তেমন কিছু না জানলেও লোকজন এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, এ রোগ ছোঁয়াচে, জন থেকে জনান্তরে ছড়াতে পারে। ফলে, সমাজের স্বার্থপরতার বলি হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হতে হয়েছে অস্পৃশ্য, কোথাও সমাজচ্যুত, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে লোকালয় থেকে নির্বাসিত। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা কুষ্ঠের কারণ, এর উপসর্গ ও ক্রমধারা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। এর কার্যকর চিকিৎসাও আমাদের আয়ত্তে। এ ক্ষেত্রে মাইলফলক ছিল ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসেনের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এ কৃতী বিজ্ঞানী গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, কুষ্ঠ আসলে একটি জীবাণুঘটিত রোগ, যা একটি ধীরলয়ে বংশ বিস্তার করা ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে। এ ব্যাকটেরিয়াটি আজ আমাদের কাছে মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রে নামে পরিচিত। সেই থেকে এ রোগটিও হ্যানসেনস ডিজিজ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসাব মতে, প্রতি লাখে পাঁচজন বা তার অধিক কুষ্ঠ রোগী পাওয়া গেলে তাকে উচ্চ ঝুঁকি বলতে হবে।জাতীয় কুষ্ঠ রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সূত্র মতে, ১৯৮৫ সালে ৫২ হাজার ১৬১ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ ছিল প্রতিবন্ধী। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে।

হুর তথ্য মতে, প্রতি ১০ হাজার জনগোষ্ঠীর মধ্যে নথিভুক্ত কুষ্ঠ রোগীর হার একজনের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে। কয়েক বছর ধরে দেশে গড়ে প্রায় চার হাজার নতুন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ২০১৮ সালে দেশে তিন হাজার ৭২৯ জন এবং গত বছর তিন হাজার ৬৩০ জন নতুন করে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ২০১৯ সালে কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছিল তিন হাজার ৬৩৮ জন। ২০২০ সালে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ৭১৯ জন।আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হচ্ছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৪০০ রোগী সময়মতো ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন।

২০১৫ সালে হুর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট কুষ্ঠ রোগীর ৬০ শতাংশ রয়েছে ভারতে। তারপরেই রয়েছে ব্রাজিল, ১৩ শতাংশ। কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা অনুপাতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এ অনুযায়ী ১২ জেলা কুষ্ঠ রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো হল- রংপুর বিভাগের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী ও গাইবান্ধা। রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট, খুলনা বিভাগের মেহেরপুর, সিলেটের মৌলভী বাজার এবং পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এসব জেলায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে পাঁচজন বা তার অধিক কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।

কুষ্ঠ রোগ কী?

কুষ্ঠ রোগ বা হ্যানসেন রোগ হল মাইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রি নামক ব্যাক্টেরিয়ার কারণে সৃষ্ট দীর্ঘ মেয়াদি সংক্রমণ। এ ব্যাক্টেরিয়া ত্বকের উপর দ্রুত সংক্রমণ ছড়ায়। তাছাড়াও সংক্রমণটি স্নায়ু, শ্বাস প্রশ্বাসের নালী ও চোখের ক্ষতি করতে পারে। কুষ্ঠ রোগের কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে। যথা- টিউবারকুলার লেপ্রসি; ইন্টারমিডিয়েট লেপ্রসি ও লেপ্রোমাটাস লেপ্রসি। সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুষ্ঠ রোগ হাতের চামড়ায় হয়ে থাকে। সংক্রমণের ফলে ত্বকে ক্ষত, স্নায়বিক ক্ষয় এবং শরীর দুর্বল ও অসাড় বোধ হতে পারে। বাচ্চা থেকে বয়স্ক, যে কোন বয়সের ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ:

কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রাথমিক যে লক্ষণগুলি দেখা দেয় সেগুলি হল- ত্বকের রঙ পরিবর্তন, ফ্যাকাশে দাগ ও ছোপযুক্ত ত্বক। ত্বকের উপর জ্বালা, যন্ত্রণা অনুভব হয় ও প্রচণ্ড গরম লাগে। মাংসপেশী দুর্বল হয়ে পড়ে। হাত ও পায়ে ঘা এবং অসাড় হয়ে যায়, চল উঠে যায়, রুক্ষ ও শুষ্ক ত্বক, পায়ের পাতার নীচের অংশে ঘা, নাক বন্ধ ও নাক দিয়ে রক্ত পড়ে।

জটিলতা:

মিউটিলেশান, দৈহিক বিকৃতি, বন্ধ্যাত্ব, লেপ্রাফিভার, দেহের আভ্যন্তরীণ যন্ত্রসমূহের ক্রিয়া বিকৃতি, শ্বাসকষ্ট যেহেতু নেরিংস ও ট্রেকিয়া আক্রান্ত, বার বার মূর্ছাভাব ও নাক দিয়ে রক্ত স্রাব, টিউবার কিউলোসিস বা নেফ্রাইটিস, মিউরাইটিস, ইরাইটিস ও ক্ষত।

হোমিও সমাধান:

রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। ১৮৭৪ সালে ডাক্তার হ্যানিম্যান এ জীবাণু আবিস্কার করেন। সর্বাধুনিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন সফল হোমিওপ্যাথিক ওষুধ লক্ষণ সদৃশ নির্বাচন করিয়া চিকিৎসা দিলে বিনা ক্লেশে অল্প সময়ে রোগটি সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়। বিশেষজ্ঞ হোমিওপ্যাথিরা সাধারণত যে সব ওষুধ কুুুষ্ঠ রোগীর জন্য ব্যবহার করে থাকেন, সেগুলো হল- আর্সেনিক, আর্সেনিক আয়োড, হোয়াংনাম, পাইপার-মেথিষ্টি, ক্যালি-বাই, ব্যাডিয়েগা, চালমোগড়া তেল, হাইড্রোকোটাইল, ল্যাকেসিস, সিপিয়া, সালফার, ব্যাসিলিনাম, হিপার, সাইলিসিয়া, স্কুকুম-চক, কমোক্লেডিয়া, ক্যালোট্রেপিস ইত্যাদি। চালমোগড়া মাদার ওষুধটি এ রোগের মহা উপকারী। এটার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিক প্রয়োগ। ১০০ আউন্স পানি ১ আউন্স কার্বলিক অ্যাসিড মিশিয়ে ঐ পানি আক্রান্ত স্থান ধৌত করলে ও বাহ্যিকভাবে চালমোগড়া তেল লাগালে উপকার পাওয়া যায়। গর্জন তেল ও চালমোগড়া তেল মালিশ করলেও উপকার পাওয়া যায়। ক্যালোট্রেপিস জাইগানটিকা একটি মুল্যবান ভারতীয় ওষুধ। এ ওষুধটি গোদ, কুষ্ঠ ও তরুণ আমাশয় রোগে খুব ভাল কাজ করে। এটা চর্মের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ও একটি উৎকৃষ্ট ঘর্মকারক ওষুধ। এমন কি ঘর্মহীনতার লক্ষণ প্রকাশ পায়, সেখানে যে কোন রোগে ক্যালোট্রেপিস জাইগানটিকাসহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে। তাই ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে, আসুন আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই এক সাথে কাজ করি ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে একটি কুষ্ঠমুক্ত দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য, প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি,
স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন