আজিজুল রমিজ
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের কাঠামোগত সংকট। এ বছর যেমন পাসের হার কমেছে, তেমনি জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। কেউ বলছেন, ‘বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে’, কেউ মনে করছেন, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক ধাক্কা। এই বিপরীত প্রতিক্রিয়াগুলোই প্রমাণ করে, আমরা এখনো শিক্ষার ভিত মজবুত করতে পারিনি। শেখার আনন্দ নয়—পরীক্ষার ফলাফলই হয়ে উঠেছে একমাত্র মানদণ্ড।
যখন পাসের হার বেশি হয়, তখন বলা হয়, মান কমেছে। আবার হার কমে গেলে বলা হয়, শিক্ষার্থীরা কিছুই শেখেনি। এই দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া দেখায়, আমরা এখনো শিক্ষাকে সংখ্যার পরিসংখ্যানে বন্দি রেখেছি। প্রশ্ন হলো—শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আসলে কী? পাস-ফেল নামক এই রাষ্ট্রীয় খেলায় ইতি কবে ঘটবে? এই প্রশ্ন আমার নয়, জেগেছে বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্য দেখে।
ইংরেজি ও গণিতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবারও বেশি। এটা নতুন নয়। বহু স্কুলে এখনো গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। অনেক সময় অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকেরা গণিত ক্লাস নেন। আইসিটি পড়ান এমন অনেক শিক্ষক মাত্র তিন বা ছয় মাসের প্রশিক্ষণে নিয়োজিত হয়েছেন—বাস্তব দক্ষতার ঘাটতি স্পষ্ট। অথচ অন্যান্য বিষয়ের জন্য উচ্চতর ডিগ্রি আবশ্যক হলেও এই ব্যত্যয় একধরনের কাঠামোগত বৈষম্য তৈরি করছে।
শুধু শিক্ষকসংকট নয়, শেখানোর পদ্ধতিতেও রয়েছে সংকট। এখনো মুখস্থনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতিই প্রাধান্যে। প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল তুলে আনা যেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। বিশ্লেষণ, সৃজনশীলতা বা বাস্তবজ্ঞান যাচাইয়ের সুযোগ সীমিত। সৃজনশীল পদ্ধতি কাগজে-কলমে চালু হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ এখনো সীমিত। ক্লাসরুম হয়ে উঠেছে একঘেয়ে অনুশাসনের জায়গা, যেখানে শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালে নেওয়া কিছু ভুল সিদ্ধান্ত শিক্ষার পরিবেশকে আরও দুর্বল করে তুলেছে।
শিক্ষার সুযোগ-সুবিধায় শহর ও গ্রামের ব্যবধান স্পষ্ট। ব্যানবেসের ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামে। এসব প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত বিজ্ঞানাগার, ডিজিটাল সরঞ্জাম বা পাঠাগার। গ্রামীণ শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণও শহরের তুলনায় কম। এমনকি মাঠ, কমনরুম বা বাগানের মতো মৌলিক উপাদানেও রয়েছে অভাব—যা সরাসরি শিক্ষার পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
শিক্ষকসংকট নিয়ে বহুদিন আলোচনা চললেও কার্যকর সমাধান আজও অধরা। বহু প্রতিষ্ঠানে পাসের হার এখনো শূন্যের কোটায়। অনেক শিক্ষক নিয়োগ পান রাজনৈতিক বিবেচনায় বা সুপারিশে। বিশেষ করে কিছু নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এখনো এই রীতির বাইরে আসেনি। নিয়োগের আগে প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণ বা বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা যাচাই করা হয় না। ক্লাসে শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা, দায়বদ্ধতা বা স্বপ্ন দেখানোর মনোভাব অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত। তাঁদের অনেকেই কোচিং বাণিজ্য বা প্রশাসনিক কমিটিতে ব্যস্ত থাকেন।
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন। পরীক্ষার আগে ক্লাস মনিটরিং, অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন, পাঠদানের গুণগত মান যাচাই—এসব বহু প্রতিষ্ঠানে অনিয়মিত। শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়লেও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষার জন্য পড়ে, জীবনের জন্য নয়। অথচ শিক্ষা মানে শুধু সার্টিফিকেট নয়—জীবনকে বুঝে নেওয়া, মানুষ হয়ে ওঠা।
এই সংকটকালে আমি মনে করি, আমাদের একবার হলেও রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাওয়া দরকার। তাঁর চিন্তায় শিক্ষার অন্তর্নিহিত সত্য ও জীবনের ছোঁয়া রয়েছে। তিনি লিখেছেন—
“বিশ্বাস কর, জ্ঞান এক জায়গায় গিয়েই শেষ নয়; সে চলেছে সবখানে, সে রয়েছে সর্বত্র—মানুষের জীবনে, প্রকৃতির বুকে, সমাজের ব্যবস্থায়।”
কিন্তু আমাদের পাঠ্যক্রম এখনো চার দেয়ালে বন্দী। নদীর গতি শেখানো হয়, কিন্তু নদী দেখা হয় না। অর্থনীতির সংজ্ঞা মুখস্থ করানো হয়, কিন্তু বাস্তব আয়-ব্যয়ের অভিজ্ঞতা দেওয়া হয় না। এই বিচ্ছিন্নতা শিক্ষার মর্মবোধ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।
শিক্ষার মানদণ্ড যখন শুধু পাস-ফেল বা জিপিএতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন একদিকে শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে মেধার সঠিক মূল্যায়ন অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই বিপরীত চাপে একটি প্রজন্ম হারিয়ে ফেলছে আত্মবিশ্বাস ও সম্ভাবনার দিগন্ত।
তাই প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দূরদর্শী ও ন্যায়ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে শিক্ষার গুণগত মান, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আনন্দময়তা থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে। শিক্ষা হয়ে উঠবে জাতিগত উত্তরণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার।
আরও একবার রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি—
“সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তিদান করে।”
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন