সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

শিরোনাম

‘আমার যত কথা’ – একটি আনন্দ-বেদনার কাব্য

শনিবার, অক্টোবর ২৬, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

সামিনা চৌধুরী: জীবন বয়ে চলা নদীর মতো। এই নদীর কূলে কূলে কতনা মানুষ বাস করে; আর সেই মানুষদের সাথে কত হাসি আনন্দ দুঃখ বেদনার সম্পর্ক। সেই মানুষদের ভালোবাসা, অভিমান, রাগ, দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কাটানো জীবনের আখ্যান লিখেছেন ড. ইসমেত আরা মুন তার ‘আমার যত কথা’ গ্রন্থে । ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ হিউবার্ট স্যামুয়েল বলেছিলেন, “এন অটোবায়োগ্রাফি ইজ দ্যা স্টোরি অফ হাও এ ম্যান থিংক্স হি লিভড।” ড. মুন তার ‘আমার যত কথা’ গ্রন্থে নিজের জীবনের গল্প বলে পাঠকের চোখে নিজের জীবনটাকে মুল্যায়নও করেছেন। গ্রন্থটিতে লেখকের জন্ম থেকে শুরু করে, তার শৈশব, কৈশোর, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষাকালীন সময়ের খুব আনন্দময় বর্ণনা দেয়া হলেও লেখকের জীবনসঙ্গী রনী বাকিরের সাথে কাটানো সময়ের গল্পটাই এই গ্রন্থের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে জীবনসংগী হিসেবে লেখক আব্দুল বাকির রনিকে নির্বাচন করেন। রনির সাথে লেখকের প্রণয়, পরিণয়, জীবনযুদ্ধ, মান, অভিমান, সন্তান প্রাপ্তি, বিভিন্ন দেশে কর্মজীবন এবং তারপর রনির অকাল মৃত্যুর সাথে সাথে গ্রন্থটির সমাপ্তি টানা হয়েছে। লেখকের মেধা, যোগ্যতা, প্রাপ্তি, ত্যাগ, হতাশা, দুঃখ আর আনন্দের চিত্রায়নে গ্রন্থটি পড়তে পড়তে পাঠকও আবেগ তাড়িত হয়ে উঠবেন। কথায় বলে জীবনের গল্প দিয়েই সাহিত্য হয়। ‘আমার যত কথা’ গ্রন্থে ফুটে ওঠা লেখকের জীবনের গল্পটি সাহিত্যের উপ্যনাসের মতই। আত্মজীবনীটি নিজ ভাষায় বলা উপন্যাসের ঢং-এ লেখাও হয়েছে।

বর্তমানে আত্মজীবনী বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও একটি বিশেষ স্থান তৈরি করেছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এবং ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে আলাওল আকারে ইঙ্গিতে তাদের নিজ পরিচয় তুলে ধরলেও সেগুলোকে আত্মজীবনী হিসেবে ধরা যায় না। পনেরো শতকের শুরুর দিকে মুঘল সম্রাট বাবর লিখেছিলেন ‘বাবরনামা’। এই গ্রন্থটিতে বাবরের জীবনের গল্পের চেয়েও তৎকালীন সময়ের রাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ভৌগলিক তথ্যাবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ‘বাবরনামা’-কে পুরোপুরি আত্মজীবনী বলা যায় না। উনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক আত্মজীবনী রচনা করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। এই মুল্যবান গ্রন্থটি দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর প্রথমে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং ১৯০৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে কার্তিকেয়চন্দ্র খুব বিশ্বস্ততার সঙ্গে উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক চিত্র ও সামাজিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন বলে ইতিহাসবিদদের কাছেও এটি একটি মূল্যবান গ্রন্থ। আত্মজীবনী লেখার সময় বিভিন্ন লেখক তাদের জীবনের বিভিন্ন বিষয় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কেউ বাল্যস্মৃতি, কেউ কর্মজীবন, কেউ তাদের জীবনের আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক আবার কেউ জীবনে ঘটে যাওয়া বিশেষ কোনো ঘটনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বাল্যস্মৃতি নিয়ে লেখা কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর বাল্যস্মৃতি, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর আমার বাল্যকথা উল্লেখ করা যেতে পারে । অস্ট্রেলিয়ান লেখক এলবার্ট ফেসি ১৯৮১ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তার সামরিক জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘এ ফরচুনেট লাইফ’ । এই গ্রন্থটিতে লেখক তার যুদ্ধের স্মৃতিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন, যা মুলতঃ তার কর্মজীবন। জীবনের অভিজ্ঞতা এবং অর্জনগুলিকে চিত্রিত করে লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকেই আত্মজীবনী লেখ হয়। উল্লেখ করা উচিত যে অনেক সফল আত্মজীবনীর লেখক কখনো কোনো সাহিত্য কর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৬৬ সালে তার আত্মজীবনী রচনার কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তিতে ২০১২ সালে গ্রন্থটি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে প্রকাশিত হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ১৯১৩ সালে ‘থিওডোর রুজভেল্ট –এন অটোবায়োগ্রাফি’ নামে আত্মজীবনী লিখেছেন।

ড. ইসমেত আরা মুন –এর লেখা ‘আমার যত কথা’ গ্রন্থটি তার জন্ম সময় থেকে শুরু হয়েছে। বইটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম অংশে লেখকের বাল্যকালের স্মৃতি; দ্বিতীয় অংশে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও আব্দুল বাকির রনির সাথে প্রণয়; এবং শেষাংশে রনির সাথে কাটানো জীবন এবং রনির প্রয়াণ বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অংশে লেখকের শৈশব- কৈশোরের যে বিবরণ দেয়া হয়েছে সেটি খুব আনন্দময় স্মৃতি। বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে চাঁদের হাটের মাঝেই লেখকের বেড়ে ওঠা। জন্মের আগে হারানো দাদীকে নিয়ে তার দাদার মাঝেমাঝে বলা কিছু বিচ্ছিন্ন কথা আর আক্ষেপ ছাড়া লেখকের জীবন কেটেছে আনন্দ আর ভালবাসার স্রোতে। তার জীবন জুড়ে বাবা মায়ের আদর-যত্ন, ভাইবোনের আহলাদি খুনশুটি, দাদাবাড়ি- নানাবাড়ির হুল্লোড়, আর বন্ধু- শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রীতিময় উপস্থিতি পৃথিবীর অনাদর আর অবহেলা লেখককে কখনো হয়তোবা বুঝতেও দেয়নি।

লেখক জন্মসুত্রে একটি ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার দাদা ছিলেন সাত গ্রামের মোড়ল এবং নানা ছিলেন চিকিৎসক। লেখকের বাবা ছিলেন একজন যুগ্মসচিব আর মা ছিলেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ডাইরেক্টর। সব মিলিয়ে লেখকের পরিবারে লক্ষীর ভাঁড় উপচে পড়ছিল। লেখক তার আত্মীয় বন্ধুদেরও অনেক পরামর্শ ও সহায়তা পেয়েছেন। এ প্রসংগে সানোয়ার মামা ও হালিম কাকার কথা লেখক শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন। (পৃষ্ঠা ৮৫) লেখকের সানোয়ার মামা তাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। সেই অনুপ্রেরণার অংশ হিসেবে তিনি লেখককে রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছিলেন এবং একটা ডাক্তারের এপ্রোনও কিনে দিয়েছিলেন।(পৃষ্ঠা ৪০) হালিম কাকাও লেখকের পড়াশোনা বিষয়ে অনেক যত্ন নিয়েছেন। নিজের বাসায় রেখে ড. মুনের জন্য পড়াশুনার সুবিধা নিশ্চিত করেছেন। (পৃষ্ঠা ৪২)

লেখক ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী এবং অনুসন্ধিৎসু। তিনি পঞ্চম শ্রেনীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। এস এস সি এবং এইচ এস সি- তে প্রথম বিভাগে পাশ করে জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও অনার্স ও মাস্টার্স এ প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। পরবর্তীতে মালেশিয়ার পুত্রা ইউনিভার্সিটিতে তিনি পি এইচ ডি করে জাপানে পোস্ট ডক্টরেট করেন। একটা সময় তিনি সৌদি আরবের কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। শিক্ষাজীবন থেকে কর্মক্ষেত্র, সবখানেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। অনুসন্ধিৎসু লেখক ছোট বেলা থেকেই অনেক প্রশ্ন করতেন। যেমন বিন্দু বাসিনী বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় তিনি তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘বিন্দুবাসিনীও কি এই স্কুলে পড়ে?’ (পৃষ্ঠা ৮) মাটি আর গাছের প্রতি লেখকের ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল। পরবর্তী জীবনেও তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন এবং মাটি নিয়ে গবেষণা করে ২৮টি নতুন প্রজাতির এক্টিনোমাইসিটিস ব্যাকটেরিয়া পুন:আবিষ্কার করেছেন (পৃষ্ঠা ১৮৮) লেখাপড়া ছাড়াও ড. মুন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে এবং খেলাধুলায় সমান পারদর্শী ছিলেন।

ড. মুন ছিলেন বাবাঅন্ত প্রাণ। ছেলেবেলায় যখন বাবা দূরে থাকতেন, তখন লেখক তার কথা, নালিশ জমিয়ে রাখতেন বাবা এলে জানাবেন বলে। বাবা এলে লেখকের মনে যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতো। লেখকের ভাষায়, ‘যে কয়দিন বাবা বাড়িতে থাকেন সেই দিনগুলোকে আমার ঈদের মতো মনে হয়।’ (পৃষ্ঠা ১১) লেখক তার সব পুরস্কার জমিয়ে রাখতেন বাবা এসে খুলবেন বলে।(পৃষ্ঠা ১৯) লেখক ছেলেবেলা থেকেই অনেক জ্ঞানী আর গুণী মানুষদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের বাবা খুব যত্নশীল ছিলেন। লেখকের ছেলেবেলায় তার বাবা আয়োজন করে লেখককে মাওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করতে নিয়ে যান। (পৃষ্ঠা ৪৫) লেখকের বাবা লেখককে এইসব মনীষীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলতেন যাতে মহা মনীষীদের জীবনাচরণ লেখককে প্রভাবিত করে। মাওলানা ভাসানী ছাড়াও বংগবীর কাদের সিদ্দিকীর পরিবারের সাথেও তাদের যোগাযোগ ছিল। চিত্র নায়ক মান্না এবং বাংলাদেশের শিল্পপতি ওয়াল্টন পরিবারের সাথেও লেখক পরিবারের আত্মীয়তা ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখক আব্দুল বাকির রনি নামে এক যুবকের প্রেমে পড়েন। রনি ছিল তার সহপাঠী। লেখক এবং রনি একই স্টাডি গ্রুপের হওয়াতে তাদের ঘনিষ্ঠতা ও প্রেম খুব দ্রুতই ঘটে যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষে পরিবারের বড় সন্তান রনির দায়িত্ববোধ ও কঠোর বাস্তবতা দু’জনের মধ্যে দুরত্ব তৈরি করে। কিন্তু চোখে ভালবাসার কাজল আঁকা লেখক সব বাঁধা পার হয়ে রনির হাতে হাত রাখেন। রনির সংসারের দায়িত্ব যেন লেখকেরও মহান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। এসময় রনির স্নেহময় পিতা অনন্তলোকে পাড়ি জমান এবং একই সাথে লেখক ড. মুন তার শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর অনুভব করতে শুরু করে। তাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পর পরই ড. মুন মালেশিয়াতে পি এইচ ডি গবেষণার সুযোগ পান। পরবর্তিতে রনিও মালেশিয়াতে পি এইচ ডি -র সুযোগ পান।

দু’জনের পি এইচ ডি শেষ হওয়ার পর নক্ষত্রের বেগে ছুটে গেছে ড. মুন আর রনির জীবন। মালেশিয়া থেকে জাপান, জাপান থেকে সৌদি আরব তারপর কানাডায় এসে পাকিপাকি ভাবে থাকতে শুরু করে তারা। অবসরের গান কবিতায় জীবনান্দ লিখেছিলেন…..”আমাদের অবসর বেশি নয়–/ ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয়/ দূরের নদীর মত সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ – অবসাদ আমাদের ডেকে লয়,” ড. মুনের জীবনেও ভালোবাসার সময় শেষ হয়ে আসে। অর্থ নয় কীর্তি নয়, অন্য কোনো এক বিপন্ন বিস্ময় রনির মনে খেলা করতে শুরু করে। বিষন্ন রনি নিজের শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি হয়ে যায় উদাসীন। এই উদাসীনতা ডেকে আনে হার্ট এটাক। অনন্তলোকে পাড়ি জমায় রনি। রনির মৃত্যুর পর প্রচন্ড শোকের মাঝে লেখক ড. মুনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের দায়িত্ব নিয়েই গ্রন্থটি পূর্ণতা পায়।

লেখক দেশে এবং বিদেশে অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। কিছু কিছু জায়গার বর্ণনা ও ইতিহাস পাওয়া যায় তার ‘আমার যত কথা’ বইটিতে। একবার লেখকের সুযোগ হয় চিটাগাং- এ ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি’ দেখতে যাওয়ার। গ্রন্থটিতে লেখক ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি’ সম্পর্কে অনেক মুল্যবান তথ্য উপস্থাপন করেছেন। একইভাবে রাঙ্গামাটি শহর, শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, কক্সেবাজার, কাপ্তাই লেক, খান জাহান আলীর মাজার, সুন্দরবন সহ অনেক স্থানের ইতিহাস গ্রন্থটিতে পাঠকের জন্য দেয়া হয়েছে। কাজেই বইটি পড়তে পড়তে পাঠক ড. মুন সম্পর্কে জানার পাশাপাশি অনেক ঐতিহাসিক তথ্য জেনেও সমৃদ্ধ হবেন।

গ্রন্থটির ভাষা খুব কাব্যিক। অনেক গান ও কবিতারও যথাযথ ব্যবহার পাওয়া যায় গ্রন্থটিতে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত নিয়ে লেখক লিখেছেন, “আমরা লাবনি বিচে বালুকা বেলার উপর দিয়ে হাঁটছি। সামনে বঙ্গোপসাগর। সকালের সোনালি সুর্যের আলোয় সমুদ্রের পানি চকচক করছে। সফেন ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে!” (পৃষ্ঠা ৫৭) লৌহজং নদীর বর্ণনায় লেখক লিখেছেন, “আমি একমনে নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। জোনাকিরা বুদবুদ আকারে আলো ছড়াচ্ছে।” (পৃষ্ঠা ১৬) লেখকের এই কাব্যিক ভাষা ব্যবহার বইটিকে করেছে সুপাঠ্য।

‘আমার যত কথা’ গ্রন্থটিতে ড. মুনের ছেলেবেলায় স্কুলগুলোর অসচেতন শিক্ষকদের কথাও উঠে এসেছে, যেটি তখনকার সমাজের একটি দর্পণ বলেই সমালোচকের মনে হয়েছে। লেখক যখন টাংগাইলের পি টি আই স্কুলে শিশু শ্রেনীতে শিক্ষাজীবন শুরু করেন, তখন একজন শিক্ষক ড. মুনকে ‘ডিম’ নামে ডাকতেন। মুনের বাবা জানতেন যে হয়তোবা ছোট লেখককে আদর করেই শিক্ষক এই নামে ডাকছেন কিন্তু মনোবিজ্ঞানের চোখে বিষয়টি অসম্মানজনক। এটি শিশুদের আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে এবং তাদের মনে হীনমন্যতা ও বিষন্নতা সৃষ্টি করে। তাই তিনি লেখককে বিন্দুবাসিনী স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু এখানেও লেখককে আরেক জন শিক্ষক ‘পটেটো গার্ল’ বলে ডাকতেন। এতে বোঝা যায় যে সে সময়ের শিক্ষকবৃন্দ কাউকে হাস্যকর নামে সম্বোধন করার ভয়াবহ দিকটি সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন বা অজ্ঞ ছিলেন।

ড. ইসমেত আরা মুনের ‘আমার যত কথা’ বইটি প্রকাশ করেছে রাদ্ধ প্রকাশ। বইটির প্রচ্ছদে দেয়া আছে লেখকের নিজের একটি মনোরম ছবি। আত্মজীবনী গ্রন্থে নিজের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত বলেই সমালোচক মনে করেন। এটি লেখকের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। লেখক খুব বিনয়ের সাথে বইটির ভুমিকায় সেকথা জানিয়ে বলেছেন, “জীবনের চলমান ঘটনায় ভালোমন্দ নিয়েই মানুষের জীবন। আমি কেবল ভালো দিকটি উপস্থাপনার চেষ্টা করেছি।” রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।” জীবন কখনো ফুলের বিছানা নয়। জীবন একটি যুদ্ধ। এখানে বিজয় বলে কিছু নেই, রণকৌশলই এখানে জয়টীকা। জীবনের সংগ্রাম, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি-র মাঝেই জীবন মহিমান্বিত হয়। আমরা কামনা করবো ড. ইসমেত আরা মুনের জীবন ভালোর আলোয় মহিমান্বিত হয়ে উঠুক। বইটি পাঠকদের উপহার দেয়ার জন্য ড. মুনকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ।

Views: 0

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন