মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

আমেরিকার সর্বদক্ষিণ পয়েন্ট কি ওয়েস্টে একদিন!

বুধবার, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

মো. মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পু: সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোটামুটি সপ্তাহ দুয়েক ছুটি পাওয়া যায়। আর ফল সেমিস্টারের পরে সেটা আরও কিছুদিন হয়ে যায়। এবারের ছুটিতে কোথাও না কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করি। যেহেতু আমি মায়ামি থাকি, তাই এর আশে পাশে দর্শনীয় কিছু স্পট নিয়ে আলাপ হল। অভি ভাই হঠাৎ করেই আমেরিকার সর্বদক্ষিনের স্থান ভ্রমণের প্রস্তাব দিল। সাথে সাথেই গুগল মামার কাছে চলে গেলাম। মামাও ইংগিত দিলেন, হ্যাঁ আমাদের এই দিকেই যাওয়া উচিৎ। ব্যাস, বাধন দা আর আবু বকর ভাইও রাজি হলেন। আমাদের এই ভ্রমণে বাধন দা সকালের নাস্তা আর দুপুরে খিচুড়ি-ভুনা মুরগির মাংস রান্না করার দায়িত্ব অর্পিত হল আমার উপর।

যেহেতু ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস, তাই আমরা এই ট্যুরের নাম দিলাম বিজয় দিবস ট্যুর। সব আয়োজন শেষে আমরা ২০ তারিখ বুধবার সকালে মায়ামী থেকে রওয়ানা দিলাম। অভি ভাই আমাকে ও বাধন দাকে পিক করে হোমস্টেডে আবু বকর ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল অভি ভাই মায়ামি টু হোমস্টেড পর্যন্ত, আর আবু বকর ভাই হোমস্টেড টু কী ওয়েস্ট পর্যন্ত ড্রাইভ করবেন। গাড়িতে উঠেই ফুল স্পীডে অভি ভাই গান বাজালেন। এটা নাকি তার ফুয়েল। লং জার্নিতে গান কার না ভালো লাগে?

৩৫ মিনিটের মধ্যে আমরা আবু বকর ভাইয়ের বাসায় পৌছে গেলাম। ভাইকে নিয়ে শুরু হল আমাদের যাত্রা। কী ওয়েস্টে এবার আমাদের প্রথম ভ্রমণ। তবে অভি ভাই ইতিমধ্যে দুই থেকে তিনবার ভ্রমন করেছন। কিন্তু এবারের ভ্রমণটা ব্যতিক্রম। হোমস্টেড থেকে আমাদের গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় ১৩০ মাইল। শহর পেরিয়ে ইউএস ১ রোড ধরে সোজা যেতে শুরু করলো আমাদের গাড়ি। বাধন দার দায়িত্ব লোকেশন অনুযায়ী আমাদেরকে গুগল মামার সাহায্য নিয়ে পথ দেখিয়ে দেওয়া। কী ওয়েস্টের রাস্তায় সর্বোচ্চ ৫৫ মাইল গতিবেগে গাড়ি চালাতে হবে। এখানে বেশী জোরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

কী লারগোতে পৌঁছামাত্র অপরূপ সৌন্দর্য্য আপনাকে বিমোহিত করবে। দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেল টেরই পেলাম না!ইসলারামোরাডা, লেইটন পার হয়ে ম্যারাথনে এসে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল। আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে সেভেন মাইল ব্রিজ। পাশাপাশি দুইটা সেতু। একটি পরিত্যাক্ত। তবে স্থাপনা রেখে দিয়েছে। পর্যটকদের পায়ে হাঁটার জন্য কয়েক মাইল উন্মুক্ত আছে এখনও। আমাদের গাড়ি যখন ব্রীজ পার হচ্ছিল, এক অন্যরকম ভাল লাগা কাজ করছিল।

বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু পদ্মা বহুমুখী সেতু অতিক্রমই ছিল আমার সেরা মূহুর্ত। কিন্তু আজ সেই ব্রীজের প্রায় দ্বিগুন সেতু অতিক্রম করলাম। এই সেভেন মাইল ব্রিজ নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৮-৮২ সালের দিকে। প্রথমে ফ্লোরিডার সাথে এই অঞ্চলের রেল যোগাযোগের জন্য একটি ব্রিজ ছিল; যা ১৯৩৫ সালের হারিকেনে বিধ্বস্ত হয়। ১৯৬০ সালে হারিকেন ডানার আঘাতে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রীজটি। আমাদের যাত্রার অন্যতম আকর্ষণ ছিল এটি। ও হ্যাঁ, ব্রিজ পার হতে কোন টোল দিতে হয় নাই।

ব্রিজ পার হয়েই আটলান্টিকের পাড়ে বসে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগীর মাংস দিয়ে জমিয়ে লাঞ্চ করলাম। দেরি না করে আবারো চলতে লাগলো আমাদের গাড়ি। প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমরা কী ওয়েস্টে ডাউন টাউনে পৌঁছালাম। আমাদের হাতে সময় বেশি ছিল না। প্রতি ঘণ্টা ৫ ডলার হিসেবে গাড়ি পার্কিং করে বের হলাম দর্শনীয় স্থান ভ্রমণে। আবহাওয়া ছিল চমৎকার। পর্যটকদের আনাগোনা বেশ ভালোই মনে হল। যোহর আর আছরের নামাজ আদায় করলাম জাহাজের জেটির কাছেই। এবার শহরটাকে এক্সপ্লোর করার পালা। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা যে কয়টি স্পট ভ্রমণ করতে পেরেছিলাম তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলাম-

সাউদার্ন পোস্ট পয়েন্ট:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ব দক্ষিণের স্থান হল কী ওয়েস্ট। এখানে একটি মনুমেন্টও আছে। এটাকেই সাউদার্ন পোস্ট পয়েন্ট অফ ইউএসএ বলে। এখান থেকে কিউবার হাভানা শহরের দূরুত্ব মাত্র ৩০ মাইল। তবে এই পয়েন্ট থেকে কিউবার দূরত্ব ৯০ মাইল। সকল পর্যটক এই মনুমেন্টের সাথে ছবি তুলেন। ছবি তোলার জন্য রীতিমত লম্বা এক লাইন দেখলাম। যদি লাইন অনুযায়ী ছবি তুলতে হয় তাহলে কমপক্ষে এক থেকে দেগ ঘন্টা লাগবে। তাই মনুমেন্টের সামনে এসে ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলেই দিলাম দৌড়। পরের গন্তব্য লাইট হাউজ।

লাইট হাউজ:
এটা ডাউনটাউনে অবস্থিত। বিশাল আকৃতির এই লাইট হাউজের উচ্চতা ৬৫ ফিট। ১৮২৫ সালে নির্মিত এই লাইট হাউজের চূড়া থেকে পুরা শহরের সৌন্দর্য্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। প্রাপ্তবয়স্ক একজনকে গুনতে হবে ১৭ ডলার।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি ও যাদুঘর:
নোবেল জয়ী আমেরিকার বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ের বসতবাড়ি যা এখন যাদুঘরে পরিনত হয়েছে। ১৯৩০ সালে নির্মিত এই বাড়িতেই তিনি লেখালেখি করতেন। গুণী এই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ১৯৫৩ সালে পুলিৎজার পদক ও ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরুস্কার অর্জন করেন। বর্তমানে এই বসতবাড়িতে পর্যটকরা লেখকের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র দর্শন করেন।

লিটল হোয়াইট হাউজ:
১৮৯০ সালে নির্মিত এই হাউজ মূলত ইউএস নেভী অফিসারদের জন্য। বিভিন্ন সময়ে আমেরিকান অনেক প্রেসিডেন্ট এই হাউজে অবকাশ যাপন করেছেন। ১ম বিশ্ব যুদ্ধের সময় নোবেল বিজয়ী টমাস আলভা এডিসিন এখানে অবস্থান করেছিলেন এবং যুদ্ধকালীন আন্ডার ওয়াটার বিভিন্ন অস্ত্রের পরীক্ষা করেছিলেন। এছাড়া ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় এই ভবনকে কমান্ড হেড কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করা হত। ৩৩ তম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান ১৭৫ দিন এই হাউজে অবস্থান করেন। এছড়া জন এফ কেনেডি, উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট, ডিউইট এইসেনহাওয়ার, জিমি কার্টার ও বিল ক্লিনটনের মত ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টও এই হাউজ ব্যবহার করেছেন। এত ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল স্থাপনা দেখার লোভ কে মিস করতে চায়? যদিও গোধূলি লগ্নে গিয়েছিলাম তাই ছবি তুলেই চলে আসতে হল।

ম্যালরি স্কয়ারে সূর্যাস্ত:
কী ওয়েস্ট ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ হল ম্যালরি স্কয়ারে সূর্যাস্ত। এটা ডাউনটাউনের অদূরে অবস্থিত। সূর্যাস্তের ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই পর্যটকরা এই স্থানে আসতে শুরু করে। বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট দোকানিরা তাদের পন্য নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন। বাংলাদেশে কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন কিংবা কুয়াকাটায় গেলে যেমন শামুকে নাম লেখানো একটা খুবই পরিচিত বিষয়। ঠিক এখানেও এই ধরনের দোকান দেখা গেল। দাম চাইল ১০ আর ১৫ ডলার প্রতি পিস। কিছু গণক বা তান্ত্রিক দেখলাম মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার কথা বলে দেদারছে ব্যবসা করছে।

কেউ কেউ আবার শারীরিক কসরত দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। পপকর্ন, বিভিন্ন আইটেমের স্ট্রিট ফুডের দোকানও ছিল চোখে পড়ার মত। এই স্থানটিকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। মনে হচ্ছিল এখানেই বসে থাকি। কিন্তু আবু বকর ভাই বিচে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা দুইজনই সমুদ্রস্নান করার জন্য কাপড় এনেছিলাম। অভি ভাই ম্যালরি স্কয়ারেই সূর্যাস্ত দেখে যেতে চেয়েছিলেন। অবশ্য দুই পক্ষের দোলাচলে আবু বকর ভাই আর বাধন দাই জয়ী হলেন। আমরা সেই সী বিচে যেতে যেতে সূর্যাস্ত হয়েই গেল।

ফোর্ট যাচারি টেইলর স্টেট পার্ক:
গোধূলিলগ্নে আমরা ম্যালরি স্কয়ার থেকে দিলাম দৌঁড়। যেহেতু সি বীচে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখব তাই রীতিমতো দম ফেলার সময় ছিল না। মোটামুটি ২০ মিনিট হাঁটার পর আমরা পৌঁছালাম। সূর্য দেখতে দেখতে আমরা আগাচ্ছিলাম। কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়লো ইউএস কোস্ট গার্ডের অফিস। আর পাশেই ছিল একটা গেইট। কিন্তু আমরা অবাক হচ্ছিলাম বিচে ঢুকতে গেইট কিসের? এখানে ঢুকতে আবার জন প্রতি ২ দশমিক ৫০ ডলার দিতে হবে। যাই হোক শেষ মুহুর্তে হওয়ায় গেটম্যান আমাদের ফি ছাড়াই ঢুকতে দিলেন। এই পার্কটা কিছুটা বাংলাদেশের ভাওয়াল বনের মত। বনের মধ্য দিয়ে গিয়ে সমুদ্র সৈকতে যেতে হয়। এখানে পৌঁছে আমাদের আক্ষেপ আরও বেড়ে গেল। কেন আগে আসলাম না, এই নিয়ে তর্কাতর্কি হল। আসলেই অসম্ভব সুন্দর এই বিচ। সূর্য অস্ত হয়ে গেছে কিন্তু রক্তিম আভা পেয়েছিলাম। মাগরিবের নামাজ পড়ে কিছু ছবি তুলতেই গার্ড এসে বের হতে অনুরোধ করলেন। অর্থাৎ সকাল ৮ টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থেকে এই বিচ।

অবশেষে ক্লান্ত শরীরে ক্ষুধার্ত পেটে নিয়ে চলে গেলাম সাবওয়েতে। এশার নামাজ পড়ে আল্লাহর উপর ভরসা নিয়ে বিদায় দিলাম কী ওয়েস্ট কে। সাথে রইল অল্প সময়ে মধুর কিছু স্মৃতি; যা আবারও আমাকে এখানে টেনে নিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।

লেখক:
ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পু

সাধারন সম্পাদক,
আটলান্টিস বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট লাইফ অর্গানাইজেশন, মায়ামি, ফ্লোরিডা।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন