মুফতি আরিফ খান সাদ: ইসলামের বিশ্বাস ও ইতিহাস অনুযায়ী পৃথিবীর সব মানুষ এক আদমের সন্তান। মহান আল্লাহ আদম-হাওয়া দম্পতি থেকে বিস্তার ঘটিয়েছেন পৃথিবীর মানবসম্প্রদায়ের। এ দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর সব মানুষই একই বংশের ও একই পরিবারভুক্ত। সব মানুষ একই পরিবারের হলেও মানুষের মধ্যে রয়েছে বিপুল বৈচিত্র্য। পৃথিবীর কোনো মানুষের সঙ্গেই অন্য মানুষের পূর্ণ সাদৃশ্য নেই। মিল নেই মানুষের চেহারায়, কণ্ঠে, চিন্তায়, বিশ্বাসে, মননে আঙুলের ছাপে। ফলে মানুষে মানুষে সংঘাত-সংঘর্ষ খুবই স্বাভাবিক বিষয়। একটি গাছে যেমন অসংখ্য ডালপাতা থাকে, বাতাসে পরস্পরে ধাক্কা খায়, আঘাত ও সংঘাত হয়, তেমনি মানুষের মধ্যে পরস্পরে আঘাত-সংঘাত, বিবাদ ও বিসংবাদ ঘটতে পারে। তখন প্রয়োজন শান্তি, সন্ধি, সমঝোতা ও মীমাংসা। জীবন, সমাজ ও পৃথিবীর জন্য ‘সমঝোতা’ খুবই জরুরি। ইসলাম পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করে দিতে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা করে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার অনুমোদনও দিয়েছে ইসলাম।
মুমিনদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে তা উত্তম উপায়ে সংশোধনের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে বলেছেন, ‘যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর যদি তাদের এক দল অন্য দলের ওপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দেবে এবং ইনসাফ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।’ (সুরা হুজরাত: ৯)। মিথ্যা হচ্ছে সব পাপের মূল। এতদসত্ত্বেও পরস্পরবিরোধী দুই ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ মেটানোর ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলাও শরিয়তে জায়েজ করা হয়েছে। কেননা মিথ্যা কথা বলেও যদি পরস্পরবিরোধী দুজনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখা যায়, তবুও সেটা হবে কল্যাণকর। এ সম্পর্কে উম্মে কুলসুম (রা.) বলেছেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কল্যাণ হাসিল করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলে যে ব্যক্তি পরস্পরবিরোধী দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, সে কখনোই মিথ্যাবাদী নয়। সে কল্যাণই বৃদ্ধি করে অথবা সে কল্যাণের কথাই বলে।’ (বুখারি: ২৬৯২)
সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমরা রাসুল (সা.)-এর জীবনী থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা যদি রাসুল (সা.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির দিকে তাকাই, তাহলে সেখানে দেখতে পাব কাফেরদের সঙ্গে সাময়িক সময়ের জন্য সমঝোতা করার ফলে ইসলামে পরবর্তী সময়ে সুবিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। নবীজি (সা.) ষষ্ঠ হিজরিতে ১ হাজার ৪০০ সাহাবির দল নিয়ে ওমরাহ পালনের জন্য মক্কার দিকে রওনা হন। হুদায়বিয়া নামক স্থানে গেলে মুশরিকদের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হন। সেখানে উভয়পক্ষের সম্মতি অনুযায়ী ছয়টি শর্তে সন্ধি চুক্তি হয়। প্রত্যক্ষভাবে সন্ধিগুলো ছিল মুসলমানদের বিপক্ষে। প্রসিদ্ধ অনেক সাহাবি এ সন্ধি চুক্তির বিরোধী ছিলেন। কিন্তু ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এ সন্ধির মাধ্যমে পরবর্তীকালে মক্কা বিজয় হয়েছিল। ইসলামের চিরন্তন শান্তির পতাকা মক্কার আকাশে উড্ডীন হয়েছিল। সন্ধি সমঝোতা একটা জাতিকে পৃথিবীবিখ্যাত বিজয় দিয়েছে। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল সাড়ে চৌদ্দশ। কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে পরবর্তীকালে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দশ হাজার পরিমাণ। সেদিন কাফেরদের সঙ্গে সন্ধির পরিবর্তে যুদ্ধ হলে হয়তোবা এমন সুবিজয় নিশ্চিত হতো না। কেননা যুদ্ধবিগ্রহ ডেকে আনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা। পক্ষান্তরে একে অন্যের প্রতি সমঝোতা ও সন্ধি ডেকে আনে শান্তি ও শৃঙ্খলা। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘সন্ধি সর্বাবস্থায় উত্তম।’ (সুরা নিসা : ১২৮)
পরস্পরবিরুদ্ধ দুটি মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা হওয়া সম্ভব। সম্পর্ক স্থাপনকারীকে আল্লাহর রহমতের আকীর্ণ চাদরে আবৃত করবেন; এটা আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনরা পরস্পরে ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের পারস্পরিক সম্পর্ক যথাযথভাবে পুনর্গঠিত করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি রহম করা হবে।’ (সুরা হুজরাত : ১০)। হিংসা, গিবত আর সমালোচনায় অষ্টপ্রহর ডুবে থাকে মানবসমাজ। গোলটেবিল বৈঠক, আড্ডার মহল, ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুকে চুমুকে, ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে এমনকি একান্ত কথার ফাঁকেও আমরা অন্যজনের সমালোচনা করতে ভুল করি না। গিবত আর সমালোচনা যেন মানুষের সব আড্ডার প্রতিপাদ্য বিষয়। একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে ফুঁসলে দিয়ে অলীক আত্মশান্তিতে ভুগি আমরা। ঝগড়ার আগুনে ‘কেরোসিন তেল’ ঢেলে দিয়ে মজা পাই। অন্যজনকে সুন্দরের এ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, তার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে আমরা সব ধরনের কলাকৌশল অবলম্বন করি। গোপনে গোপনে শলাপরামর্শ করি। এসবে সাময়িক ভালো লাগা থাকলেও গভীরে রয়েছে হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়ার উপকরণ। মানুষের উপকারে জীবনকে উৎসর্গ করার নামই তো জীবন।
মানুষের জন্য নিজেকে ভালোবাসাঘেরা ছায়াদার আকাশ, নিবেদিতপ্রাণ, হৃদয়কে উদার, তৃষিত মনের জন্য সিক্তবারি হতে হবে। যুক্তি-পরামর্শে মানুষের কল্যাণ কামনা করতে হবে। মানুষকে ভালোবেসে মানুষের হৃদয়ে সুখের পুবালি হাওয়া বইয়ে দিতে পারলে জীবন আলোকিত পৃথিবীর। এ জীবন পৃথিবীর সব মানুষের। এ জীবনের প্রেমে পড়েন জগতের সৃষ্টিকর্তা মহান প্রভু। তাকে সংগোপনে স্মরণে এনে শান্তি পায় ধরার সব সৃষ্টি। তার সঙ্গে অভিসারে সময় যাপন করতে চায় মনওয়ালা। মানুষের শলাপরামর্শের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘লোকদের গোপন শলাপরামর্শে প্রায়ই কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে না। অবশ্য কেউ যদি গোপনে কাউকে দানখয়রাত করার জন্য উপদেশ দেয়, অথবা কোনো ভালো কাজের জন্য অথবা লোকদের পরস্পরের কাজকর্মের সংশোধন করার জন্য কাউকে কিছু বলে, তবে তা নিশ্চয়ই ভালো কথা। আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য যে কেউ এমন করবে তাকে আমি বিরাট প্রতিদান দেব।’ (সুরা নিসা: ১১৪)
ভালো কাজ অন্তরে প্রশান্তি আনে। হৃদয়ে সুখের দোলা দেয়। মানুষের পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে অনুপ্রাণিত করে। সুন্দর কাজেরা জগতের ফ্রেমে সুভাসিত প্রাণ নিয়ে বন্দি থাকে অনেক দিন। তাদের কর্ম এবং তাদের মানুষ স্মরণ রাখে যুগ থেকে যুগান্তর পর্যন্ত। দুটি বিরোধী মনকে এক ডুরে গেঁথে দেওয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে একটি। মানুষের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা করে দেওয়া সদকা। সদকায় সওয়াব। সদকায় আমলের পাল্লা ভারী হয়। প্রাপ্তির ঝুলি পূর্ণ হয়। সদকা চিরস্থায়ী জীবনে সুন্দর বাসস্থান তৈরি করে। সুতরাং দুই ব্যক্তির মধ্যে ইনসাফসম্মত সমঝোতা বিধান তৈরি করে সদকার সওয়াব নিজের আমলের ডায়েরিতে যুক্ত করা কর্তব্য। হাদিসে এসেছে—‘দুই ব্যক্তির মাঝখানে ইনসাফ সহকারে সমঝোতা স্থাপন করে দেওয়া সদকা হিসেবে গণ্য।’ (বুখারি : ২৯৮৯)। তাই আসুন, আমরা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবরকম হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখতে নববী আদর্শে জীবন গঠন করি। এতে সমাজ হবে সুন্দর। মানবসভ্যতার এগিয়ে চলা হবে সুখময়। পৃথিবীতে বিরাজ করবে সংঘাতহীন শান্তির পরিবেশ।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ (লেখা: সংগৃহীত)
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন