আবছার উদ্দিন অলি: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’। গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা ও সুরকার আলতাপ মাহমুদের সুরে এ কালজয়ী গানটি একুশের চেতনায় আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আমাদের সাহস, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ যুগিয়েছে। এ একটি গান এত জনপ্রিয় যে, যাকে এখনো অন্য কোন গান জনপ্রিয়তার দিক থেকে অতিক্রম করে যেতে পারিনি। তাইতো একুশের গান বাংলা ভাষার অহংকার। বিনম্র শ্রদ্ধায় পালিত হবে একুশে ফেব্রুয়ারী। তবে এবার একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রেক্ষাপটটা একেবারেই ভিন্ন। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারির আমেজ ও অনুভূতি একেবারেই অন্যরকম। একুশের চেতনায় জুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা। পুরো বাংলাদেশের প্রায় ২০ কোটি লোক বাংলা ভাষা ব্যবহার করে ও হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে সাহায্য করে এটিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উন্নীত করেছে। ভাষার জন্য আন্দোলনের অর্ধ শতাব্দীকাল পরেও বাংলা ভাষার শহীদরা সে দিন যে স্বপ্ন দেখে নিঃশেষে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, তার কতটা পূরণ হয়েছে? সেই প্রশ্ন উচ্চারিত হয়ে আসছে জনে জনে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা সংবিধান অনুযায়ী বাংলা ভাষা হলেও তার কতটুকু জাতীয় জীবনে প্রবর্তিত হয়েছে বা তার প্রাপ্য মর্যাদা অর্জন করেছে এ প্রশ্ন এখনো অমিমাংসিত।
বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে সে দিন পূর্ববঙ্গের সরকার প্রধান সমীপে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত যে স্মারকপত্র পেশ করা হয়েছিল, বাংলা ভাষা ভারত বর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী ভাষা ও বিশ্বে প্রধান প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকার। সুরকার ও সংগীত পরিচালক তাপস চৌধুরী বলেন, ‘একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের গৌরব। গানে গানে, সুরে সুরে চেতনায় একুশ ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার প্রতিটি পথে প্রান্তরে।’ গীতিকার এস আনিস আহামদ বাচ্চু বলেন, ‘বাঙালীর মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে বাঙালীর রক্তে রাঙা ‘একুশ’ এখন ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ ইউনেস্কোর মূল্যায়ন।’ সংগীত শিল্পী ইফতেখার সাদী বলেন, ‘সর্বস্তরে আজও বাংলা চালু হয়নি। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো ইংরেজির প্রাধান্য বেশি।’
১৯৫২ থেকে ২০২২ ছয় দশকের এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা দেখলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। সেই ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে বাঙালি তরুণেরা মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ঢাকার রাজপথে যে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, এ ফেব্রুয়ারির সেই রক্তেরই ডাক শুনেছে পুরো বাংলাদেশ। এবারের ডাক ন্যায়বিচারের, মানবতার ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম অপরাধের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান।
৫২’র শহীদ, তোমাকে সালাম। মাতৃভাষার দাবিতে বাঙালি তরুণদের সে দিনের আত্মবলিদান শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার দানা বেঁধেছিল। সে স্বপ্নই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে। তাই ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা, মুক্তি, সাম্য, গণতন্ত্র-আধুনিক বাঙালির সব শুভ চেতনার মাস। তারপর আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ দিবসটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। সত্য, ন্যায়, শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ় অঙ্গীকারের বার্তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় এ দিনে। অনুপ্রাণিত ভোরের হাওয়ায় মর্যাদা সুমন্নত রাখতে বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রাঙিয়ে দেয়ার দিন অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। একুশ মানেই মাথা নত না করা। একুশ মানেই আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিরোধ।
বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের এ দেশেও সংখ্যার দিক থেকে ছোট অনেক জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয় পরিপুষ্টির সুযোগ অবারিত রাখা অত্যন্ত জরুরি। শুধু আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃভাষায় মর্যাদা নেই, সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন ঘটলেই কেবল তার মর্যাদা পায়। শিক্ষাসহ জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। প্রথমে প্রয়োজন একটি জাতীয় ভাষা পরিকল্পনা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কিছু স্থায়ী প্রতিষ্ঠান ও মানুষ, যারা বাংলা ভাষার বিকাশের লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাবেন।
গীতিকার খোদেজা খুরশিদ অপরাজিতা বলেন- ‘ফাগুণ আসিলে আগুন জ্বলে বাঙালী জাতির মনে’ বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার আসে সংগোপনে।’ সংগীত শিল্পী বৈশাখী দাশ বলেন, ’কাগজে-কলমে বাংলা বাংলাদেশের মাতৃভাষা রাষ্ট্র ভাষা। বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। এক দিন ঘটা করে ২১ফেব্রুয়ারী পালন করলাম, আবার পরদিন ইংরেজি বাবু হয়ে গেলাম, এটা যেন না হয়। গীতিকার দিলীপ ভারতী বলেন, শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমের প্রসার ঘটে চলেছে, সাধারণ বিদ্যালয়গুলোয় বাংলার প্রতি অবহেলা বাড়ছে। শুধু আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃভাষার মর্যাদা নেই; সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন ঘটলেই কেবল তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায়। শিক্ষাসহ জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শিল্পী আহসান হাবীবুল আলম বলেন, ‘একুশ আমার অস্তিত্ব ফাগুনের কত কথা, একুশ আমার বাঙালীত্বের সোচ্চার বাস্তবতা।’ সুরকার আবু তাহের চিশ্তী বলেন- ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা আমাদেরকে দিতে হবে। সম্মান করতে হবে বাংলা ভাষাকে। কারণ যে ভাষায় ‘মা’ ডাকতে শিখেছি সে ভাষার আদর কদর আমাদের অবশ্যই এগিয়ে নিতে হবে। সংগীত শিল্পী কায়সারুল আলম বলেন- মহান ভাষা শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। এই মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল মাতৃভাষাকে একটি সম্মান জনক স্থান প্রদানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গুরুত্ব লাভ করেছে।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক। ১৯৫২ সালের এ দিনে ভাষার মর্যদা রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ আরও অনেকে। আজ সারা বিশ্বের সব নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সব ভেদাভেদ ভুলে একুশের উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার শপথ নেই। একুশের গান বাংলা ভাষার অহংকার, বিষয়টি আমাদেরকে সবার আগে মনে রাখতে হবে। একুশের গানই আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রাম, চেতনার উৎস। আমাদের সংস্কৃতিতে একুশের ভূমিকা ও গুরুত্ব অতুলনীয়। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে পারলেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথচলা সহজ ও সুন্দর হবে।
লেখক: গীতিকার ও সাংবাদিক, চট্টগ্রাম
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন