রুদ্র ইকবাল: পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে রঙিন কালিতে ছাপানো সারা দেশে মৃত্যুর সংখ্যা। ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা, কোথাও বেশি কোথাও দুয়েকজন কম। পত্রিকার প্রথম পাতা যেন বাংলাদেশের মৃত্যুর বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে। বাকি পাতাগুলো উলটালে ক্রমান্বয়ে সামনে আসে গুলিতে আহত হওয়ার খবর, হাসপাতালে আহত মানুষের আর্তনাদ ও মৃত মানুষের স্বজনদের আহাজারির খবর, জাতীয় সম্পদ পুড়ে যাওয়ার খবর, সাধারণ মানুষের ভোগান্তির খবর, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির খবর ও ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষের নানা ক্ষেত্রে ভোগান্তির খবর।
কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোয় শিক্ষার্থীদের ওপর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের দমন-পীড়নের পর পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের রেশ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশালসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে; যুক্ত হয় স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চাকরির পরীক্ষা পর্যন্ত যেতে সময় লাগত প্রায় ছয়-সাত বছর। কিন্তু তারা জানে তাদের বড় ভাইবোনরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তারা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পড়েছেন, পড়েছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বৈষম্যের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয় তা শিখেছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। সেই পথ ধরেই তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। এ রাজপথেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর পাশাপাশি স্কুল-কলেজপড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী, আহত হয় অনেকে। শিক্ষার্থীদের নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ঘোষণা দেয়া হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। দ্বিতীয় দিন পরই কারফিউ জারি করা হয়। এর পরই ক্রমান্বয়ে শুরু হয় মানুষের ভোগান্তি। হাসপাতালে আহতদের ভোগান্তি, আন্দোলনে নিহতদের স্বজনদের আহাজারি, বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের চেহারায় হতাশার ছাপ, ইন্টারনেট ও বাস না থাকায় সাধারণ মানুষের যোগাযোগে ভোগান্তি।
ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলো সাক্ষী হয়েছে এক অন্য রকম পরিবেশের। একসঙ্গে এত আহত ও নিহত মানুষ হাসপাতালগুলো আগে দেখেনি। সবচেয়ে বীভৎস চিত্র হাসপাতাল দেখেছে, যখন আহতরা চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেলে যায় তখন আহতদের ওপর উপর্যুপরি হামলা করা হয়। এ আন্দোলনে মারা যায় ২০ বছরের নিচে অনেক শিক্ষার্থী। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক কামরুন নাহার শীলার ছেলে মেঘ গুলিবিদ্ধ হয়। বাচ্চাটা সম্ভবত সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। আন্দোলন কতটুকু বোঝে তার চেয়ে বড় বোধ ছিল চাকরির জন্য পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফায়াজ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ঠিক এভাবে মারা যায় অনেক স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এ ভিডিওগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। যে দেখছে তার চোখের কোনায় জমা হয় অশ্রু। এই ছোট ছোট সন্তানদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের আহাজারিতে মানুষ স্তব্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশ হয়তো একসঙ্গে এত শিক্ষার্থীর মরদেহ আগের কোনো আন্দোলনে দেখেনি। স্বাধীনতার পর হয়তো বাংলাদেশ এমন অন্ধকারের সাক্ষী হয়নি।
রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় শহরে যানবাহন চলাচলের ওপর নির্ভর করে অনেক পরিবার। বাসচালক, সিএনজিচালক ও রিকশাওয়ালারা তাদের নিজ নিজ গাড়ি নিয়ে বের হতে পারেন না। কোনোভাবে বের হলেও সারা দিন উৎকণ্ঠায় থাকেন কোন সময় কারফিউর বিধিনিষেধের কারণে ঝামেলায় পড়ে যাবেন। অনেক ড্রাইভার ভয়ে গাড়ি নিয়ে বের হন না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ড্রাইভার, সিএনজিচালক ও রিকশাওয়ালাদের পরিবারে। অনেক পথশিশু রয়েছে যারা বাসে সহকারীর কাজ করত এবং দিনশেষে কিছু টাকা উপার্জন করে তার পরিবারকে দিত কিন্তু বাস চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে এখন তাদের অল্প রুজিরোজগার যা হতো তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সাংবাদিক হিসেবে বেশ কয়েকবার বাজারের পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম। বাজার ঘুরে দেখি, ক্রেতা-বিক্রেতা সবার মুখে হতাশার ছাপ লেগে আছে। ক্রেতারা বলছেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। কেনার সাধ্য নেই। আবার বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ জটিলতায় জিনিসপত্র আসছে না। দাম বেশি না রাখা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। কারণ আমাদেরই বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আগে সারা দিনে যা বিক্রি করতাম এখন তার অর্ধেকও করতে পারছি না। সবজি বিক্রেতারা বলছেন, আমাদের জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মামা। লোকসানে সব ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের আবার দোকানের ভাড়াও দিতে হচ্ছে নিয়মিত। বড় ধরনের লোকসান হয়ে যাচ্ছে। এ লোকসান গোছাতে আমাদের সময় লাগবে। পরিবারে গেলে সবার অবস্থা দেখে হতাশা কাজ করে।
যারা পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে ফুটপাতে ছোট ছোট দোকান নিয়ে বসতেন তারা দোকান খুলতে পারেননি কারফিউর দিনগুলোয়। অথচ এ মানুষগুলোর রোজগারের ওপর নির্ভর করে পুরো পরিবার। শুধু ফুটপাতের দোকানিরা নন, রয়েছেন শ্রমিকরা, ভ্যানগাড়ি চালকরা, টং দোকানিরা। তাদের সবাই এক নীরব যাতনা সহ্য করে যাচ্ছেন চোখ বন্ধ করে। দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষরা আয়-রোজগার করতে না পারার যাতনা পুরো পরিবারের মানুষকেও সহ্য করতে হয়।
এত মানুষের আহাজারি দেখে বাংলাদেশ হয়তো বলতে চাইছে, আমি বাঁচতে চাই।
রুদ্র ইকবাল: সাংবাদিক, বণিক বার্তা
Views: 7
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন