শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫

শিরোনাম

এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন দুর্ঘটনার রহস্য আরও জটিল করল পাইলটের কথোপকথোন

শনিবার, জুলাই ১২, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

ভারতের গুজরাটে বিধ্বস্ত হওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে পাইলটদের কথোপকথোন ঘিরে দুর্ঘটনার রহস্য আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি)।

শনিবার (১২ জুলাই) প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্লেনের ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে শোনা গেছে, এক পাইলট অন্যজনকে প্রশ্ন করছেন—‘তুমি কি ফুয়েল কেটে দিয়েছো?’

অপর পাইলট সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, ‘না, আমি কিছু করিনি।’ ঠিক সেই মুহূর্তে প্লেনটির ইঞ্জিন শক্তি হারাতে থাকে। কিন্তু কে প্রথমে এই প্রশ্ন করেছিলেন আর কে উত্তর দিয়েছিলেন—তা প্রাথমিক প্রতিবেদনে স্পষ্ট নয়।

এএআইবির তথ্য অনুযায়ী, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারটি উড্ডয়নের প্রস্তুতিকালে হঠাৎ করে ইঞ্জিনের ফুয়েল কাটঅফ সুইচ চালু হয়ে যায়। ফলে উভয় ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে প্লেনের পাওয়ার, থ্রাস্ট এবং লিফট একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্লেনটি ওপরে উঠতে পারেনি এবং অল্প সময়ের মধ্যেই মাটিতে বিধ্বস্ত হয়।

আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার এআই১৭১ ফ্লাইটটি গত ১২ জুন উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই একটি ছাত্রাবাসের ওপর বিধ্বস্ত হয়। এতে প্লেনের প্রায় সব আরোহীসহ অন্তত ২৭০ জনের মৃত্যু হয়। এটি গত এক দশকের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্লেন দুর্ঘটনাগুলোর একটি।

অ্যারোনটিক্স বিশেষজ্ঞ সাজ আহমেদ বলেন, ‘এনহ্যান্সড এয়ারবোর্ন ফ্লাইট রেকর্ডার (ইএএফআর)-এর মাধ্যমে প্রায় ৫০ ঘণ্টার ফ্লাইট ডেটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, কীভাবে প্লেনের পতন ঘটেছে।’

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ধোঁয়াশা হচ্ছে—কীভাবে ফুয়েল সুইচ সক্রিয় হয়েছিল। এটি না বুঝলে আমরা নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারি না।

যদিও তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, তবু অনেকেই ধারণা করছেন, যান্ত্রিক ত্রুটির বদলে ‘হিউম্যান ফ্যাক্টর’ বা মানবিক ভুল এই দুর্ঘটনার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে।

এএআইবি জানায়, এই তদন্ত আরও কয়েক মাস চলবে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উঠে আসবে কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটলো, কার গাফিলতি ছিল—তা নিশ্চিত করে বলা যাবে। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে শেষ মুহূর্তের ককপিট অডিও বিশ্লেষণে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতক্ষণ না নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে ককপিটে কে কী করেছিলেন, ততক্ষণ এই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ পুরোপুরি জানা যাবে না। তবে এখনই স্পষ্ট যে, ফুয়েল কাটঅফ সুইচ চালু হয়ে যাওয়ার কারণই এই মর্মান্তিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু।

এনহ্যান্সড এয়ারবর্ন ফ্লাইট রেকর্ডারের (ইএএফআর) উপাত্ত অনুযায়ী, কিছুক্ষণ পর লন্ডনগামী এ উড়োজাহাজের দুটি ইঞ্জিনের সুইচ আবার ‘কাটঅফ’ থেকে ‘রান’-এ আনা হয়, যা পাইলটদের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়। বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বা অন্য যেকোনো বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ একটি ইঞ্জিন দিয়েই টেকঅফ সম্পন্ন করতে সক্ষম এবং এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য পাইলটদের প্রশিক্ষণ থাকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, উড্ডয়নরত অবস্থায় যখন জ্বালানি নিয়ন্ত্রণের সুইচ ‘কাটঅফ’ থেকে ‘রান’ বা বন্ধ থেকে চালু করা হয়, প্রতিটি ইঞ্জিনের ফুল অথরিটি ডুয়াল ইঞ্জিন কন্ট্রোল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইগনিশন ও জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যমে থ্রাস্ট (যে বলে উড়োযান সামনে চালিত হয়) ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।

তবে ইএএফআর রেকর্ডিং কয়েক সেকেন্ড পরই বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই একজন পাইলট ‘মেডে’ অ্যালার্ট পাঠান। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কল সাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেও কোনো উত্তর মেলেনি। এরপরই উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরের বাইরে বিধ্বস্ত হয়।

জ্বালানি ভরা উড়োজাহাজটি খুব দ্রুত উচ্চতা হারিয়ে একটি মেডিকেল ছাত্রাবাসে আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে, উড়োজাহাজে থাকা ২৪২ জনের মধ্যে কেবল একজন বেঁচে যান, এবং মাটিতে থাকা আরও প্রায় ৩০ জন নিহত হন। উড়োজাহাজটি আকাশে ছিল মাত্র ৩২ সেকেন্ড।

উড়োজাহাজটি চালাচ্ছিলেন লাইন ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সুমিত সাবরওয়াল, যার ৮ হাজার ২০০ ঘণ্টার উড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল। তাকে সহায়তা করছিলেন ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দার, যার ১ হাজার ১০০ ঘণ্টার উড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল। প্রতিবেদন অনুসারে, দুই পাইলটই স্বাস্থ্যগতভাবে ঠিক ছিলেন এবং বিশ্রামও নিয়েছিলেন।

তদন্তে তাৎক্ষণিকভাবে নাশকতার কোনো প্রমাণ মেলেনি, তবে ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একটি সতর্কতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে ফুয়েল সুইচ ত্রুটির সম্ভাবনা সম্পর্কে বলা হয়েছিল। ৭৩৭ মডেলের অপারেটরদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উল্লেখ করা হয়- লকিং ফিচার ছাড়াই ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ ইনস্টল করা থাকতে পারে। তবে এটিকে ‘অনিরাপদ অবস্থা’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, টেকঅফের পরপরই র‌্যাম এয়ার টারবাইন চালু হয়েছিল। যদি উভয় ইঞ্জিন চলতে ব্যর্থ হয় অথবা বৈদ্যুতিক ও হাইড্রলিক সিস্টেম একযোগে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এই ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উড়ানপথের কাছাকাছি উল্লেখযোগ্য পাখির উপস্থিতি দেখা যায়নি। উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরের প্রাচীর পেরোবার আগেই উচ্চতা হারাতে শুরু করে।

এনডিটিভি লিখেছে, ১৯৮০ এর দশকে ডেল্টা এয়ারলাইন্সের এক পাইলট ভুলবশত বোয়িং ৭৬৭ উড়োজাহাজের জ্বালানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে সেই যাত্রায় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল, কারণ উড়োজাহাজটি বেশি উচ্চতায় থাকায় তিনি ফের ইঞ্জিন চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুই ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যায়- জ্বালানি সুইচ ‘রান’ থেকে ‘কাটঅফে’ যায় মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে। পাইলটরা ফের ইঞ্জিন চালুর চেষ্টা করেন। ১ নম্বর ইঞ্জিন আংশিকভাবে চালু হলেও ২ নম্বর ইঞ্জিন ব্যর্থ হয়। বিমানটি মাত্র ৩২ সেকেন্ড আকাশে ছিল এবং রানওয়ে থেকে ০.৯ নটিক্যাল মাইল দূরে একটি ছাত্রাবাসে বিধ্বস্ত হয়। জ্বালানিতে কোনো দূষণ ছিল না এবং রিফুয়েলিং প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল। আবহাওয়া ভালো ছিল- স্বচ্ছ আকাশ, ভালো দৃশ্যমানতা, হালকা বাতাস। পাইলটদের স্বাস্থ্য, যোগ্যতা, বিশ্রাম ও অভিজ্ঞতা যথাযথ ছিল। নাশকতার প্রমাণ নেই, তবে একটি পুরনো সতর্কতা অনুযায়ী জ্বালানি সুইচে সম্ভাব্য ত্রুটির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া যথাযথভাবে তা পরীক্ষা করেনি।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন