মোহাম্মদ সেলিম ভূঁইয়া: বেড়াতে ভাল লাগে সবারই। কিন্তু নগর জীবনের চলমান ব্যস্ততায় বেড়ানোর জন্য সময় বের করাটাই মুশকিল। লেকের নীল জলরাশির সাথে দিগন্তে মিশে যাওয়া নীল আকাশের মিতালি ভাল লাগে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কাছাকাছি যদি প্রকৃতির বর্ণিল রঙে নিজকে রাঙানোর এমন সব আয়োজনের সমাবেশ ঘটে, তাহলে কথাই নেই। সুযোগ মিলেছে যখন ঢুঁ মেরেই আসি। সরকারি কর্মাস কলেজ বিএনসিসি প্লাটুনের পিইউও আবুল হাসনাতের আমন্ত্রণে এবারের গন্তব্য কাপ্তাই।
কাপ্তাই সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। কৃত্রিম নীল পানির কাপ্তাই লেকের আয়তন প্রায় ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ইংরেজ সরকার ১৯০৬ সালে প্রথম জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা করে কাপ্তাইয়ে। তারপর আমেরিকার অর্থায়নে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কাপ্তাই বাঁধ তৈরি কাজ শুরু করেন। ১৯৬০ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণের পর পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি সংরক্ষণের জন্য বাঁধ নির্মাণের ফলে নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়। তারপর হ্রদের সৃষ্টি হয়। এ হ্রদের সর্বনিম্ন গভীরতা ৩০ ফুট ও প্রায় ১০০ ফুট পর্যন্ত।
বলা হয়, কাপ্তাই হ্রদটি ৯০ বছরের মধ্যে ভরাট হয়ে যাবে। ইংরেজি এইচ বর্ণের আকৃতি বিশিষ্ট কাপ্তাই লেকের দুইটি বাহু রয়েছে। সুভলংয়ের কাছে গিরিসঙ্কট দ্বারা সংযুক্ত, যা কর্ণফুলী নদী পথের অংশ। কাপ্তাই হ্রদের ডান বাহু বা কাসালং দক্ষিণ দিকে দুইটি আন্তপ্রবাহি নদী মাইনি ও কসালং দ্ধারা এবং পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদী দ্বারা পুষ্ট। রাঙামাটি-কাপ্তাই অর্থাৎ বাম বাহুটি দুইটি নদী দ্বারা বেস্টিত। উত্তরে চেঙ্গি বা চিংরি দক্ষিণে রাইন খিয়াং দ্বারা পুষ্ট। মূলত রাঙ্গামাটি শহরের সৌন্দর্য ও পর্যটন নগরি হয়ে ওঠার কারণ এ কাপ্তাই লেক। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের নিদর্শন কাপ্তাই লেক বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। কাপ্তাই লেক ঘেঁষেই রাঙ্গামাটির পথে রাস্তা গিয়েছে বলে কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি এক সাথে ভ্রমণ করার দারুন সুযোগ রয়েছে ।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা, সবার মধ্যে সীমাহীন আনন্দ। কারণ এখনই ছেড়ে দিবে সরকারি কমার্স কলেজ বিএনসিসি প্লাটুন কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষা সফরের বাস। বাসে ইতিমধ্যে আসন নিয়েছেন সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ সুসেন কুমার বড়ুয়া ও তার পরিবার, শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম, ইংরেজী বিভাগের প্রভাষক আবুল হাসনাত, বাংলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মো এহতেশাম-উল হক ও এক্স ক্যাডেট এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও কমার্স কলেজের প্রত্যবেক্ষণ মোহাম্মদ সেলিম ভূঁইয়া ও ৩৬ জন রানিং ক্যাডেট। বাস ছাড়ার পরপরই ক্যাডেট মুমতাহিন সুলতানা মাইক্রোফোনে বলে উঠলেন, ‘সবাইকে কমার্স কলেজ বিএনসিসি প্লাটুনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।’
এর পরপরই যাত্রার শুভ কামনায় কোরআন তেলওয়াত করার জন্য ক্যাডেট তামান্না আক্তারকে অনুরোধ করে। ক্যাডেট আলোক শাহ গীতা ও অরুপ বড়ুয়া ত্রিপিটক পাঠ করেন। সুসেন কুমার বড়ুয়ার অনুমতি নিয়ে সকলে দেশের গান গাইতে গাইতে এবং চট্টগ্রাম শহরের সৌন্দর্য ও বর্তমান সরকারের উন্নয়ন, রাউজান চট্টগ্রাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাঙ্গুনীয়ার শেখ রাসেল এ্যাভিয়ারী ইকু পার্ক, কর্ণফুলী পেপার মিল গেইট, কর্ণফুলী সরকারি কলেজ, কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয়, বিজিবির কাপ্তাই সদর ব্যাটালিযন, প্যানোরোমা জুম রেস্তোরা দেখতে দেখতে আমরা কাপ্তাই প্রশান্তি পার্কে এসে পৌঁছাই। প্রশান্তি পার্কেই আমরা সকালের নাস্তা করি।
কাপ্তাইয়ের মধ্যে এটি খুব সুন্দর ও ভাল মানের রিসোর্ট। কাপ্তাই সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠা প্রশান্তি পার্ক। পাশে কর্ণফুলী নদী ও উঁচু পাহাড়। মানসম্মত খাবার, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ও ব্যবস্হাপনা সব মিলিয়ে সেরা প্রশান্তি পার্ক। প্রশান্তি পার্ক থেকে আমরা ওয়াগ্গা ইউনিয়নের বৌদ্ধ মন্দির, কাপ্তাইয়ের সুইডিশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পার হয়ে আমাদের আগের আমন্ত্রণ সিডিউল অনুযায়ী কাপ্তাই বিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ ও নেভাল ইউনের পিইউও মো জাহাঙ্গীর আলমের আমন্ত্রণে বিএন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ কমান্ডার এম নূরে আলম সিদ্দিকীর সাথে সৌজন্য স্বাক্ষাৎ করি। পরে মাওরুম বোর্টে (৪০ জরে ধারণ ক্ষমতা ও চারটি কেবিন সংযুক্ত) কাপ্তাইয়ের পাহাড় আর কৃত্রিম হ্রদে ভেসে ভেসে প্রাকৃতিক লিলাভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকি। মাঝপথে বেড়াইন্নার লেক থেকে দুপুরের খাবার সংগ্রহ করে নিই। কারণ বোর্টেই দুপুরের খাবার খাব ও খেতে আমাদের গন্তব্য নানিয়ারের দিকে যাব। নানিয়ার চরের বুড়িঘাটে কাপ্তাই লেকের ছোট্ট এক দ্বীপে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাঙ্গালির অন্যতম এক বীর সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ। অথৈ নীল জল পরিবেষ্টিত সমাধিতে লেখা ‘তুমি দুর্জয়, নির্ভীক মৃত্যুহীন এক প্রাণ’ কথাগুলো যেন তাঁর গৌরবজ্বল বীরত্বের এক অনন্য প্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধের এ বীরশ্রেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিতে। অথবা আপনার সন্তান বা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সেই ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেও আপনার গন্তব্য হতে পারে নানিয়ার চর। ১৯৯৬ সালে স্হানটি চিহ্নিত করা হয় ও ২০০৬ সালে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের আত্মত্যাগের প্রতি প্রদ্ধা জানিয়ে নির্মাণ করা হয় মার্চ রাইফেল ভাস্কর্য সংবলিত স্মৃতিসৌধ।
বেড়াইন্নার লেক থেকে আসাম বস্তি, তবলছড়ি, ডিসি বাংলো রিজার্ভ বাজার এলাকার সৌন্দর্য দেখতে কি যে ভাল লাগছে, এ অনুভূতি লিখে বুঝানো যাবে না। এক বার ভাবুন, আমরা বোর্ট থেকে পুরো রাঙামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন কাপ্তাই লেকের ঝর্ণা ধারা আর পানির বুকে বয়ে চলা নৌকাগুলোর দৃশ্য দেখে হারিয়ে যাচ্ছিলাম যেন এক অজানা স্বর্গীয় আনন্দে। লেকের পানিতে নৌকায় চড়ে যত দূর এগিয়ে যাই, প্রতি মুহূর্তে যেন চোখের সামনেই পালটে যাচ্ছে দৃশ্যপট, দেখতে দেখতে এক সময় মনে হচ্ছিল, বিশ্বের সৌন্দর্যের রানী খ্যাত কাশ্মীরের কোন দর্শনীয় স্থান উপভোগ করছি।
লেখক: আবৃত্তি শিল্পী, চট্টগ্রাম
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন