রবিবার, ০৩ আগষ্ট ২০২৫

শিরোনাম

কেন মানসিক চাপ তৈরি হয়?

রবিবার, আগস্ট ৩, ২০২৫

প্রিন্ট করুন
মানসিক চাপ

মানসিক চাপ তখনই সৃষ্টি হয়, যখন আমরা মনে করি কোনো সমস্যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বর্তমান ব্যস্ত জীবনযাত্রায় আমরা প্রায় সবাই কম-বেশি মানসিক চাপের শিকার হই। কখনো চাপ আসে অফিসের কাজ থেকে, কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে আবার কখনো বা দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো ঘটনাও হয়ে ওঠে চরম মানসিক অস্বস্তির কারণ।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো বিষয় যদি আমাদের ভালো থাকা বা নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেটি আমাদের মনে চাপ তৈরি করতে পারে।

মানসিক চাপ

মানসিক চাপ বলতে কী বোঝায়?

আমাদের জীবনে মানসিক চাপ যেন এক অভিশাপের মতো। ছাত্র জীবনের পরীক্ষা থেকে শুরু করে কর্ম জীবনের চ্যালেঞ্জ, ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতন – সর্বত্রই চাপের ছায়া। কিন্তুু কখনও কি আপনি ভেবে দেখেছেন যে, এই মানসিক চাপ বলতে কি বোঝায়? সহজ কথায় বলতে গেলে, মানসিক চাপ হলো এক ধরণের মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তির চাহিদা ও ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। যখন আমরা কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে অক্ষম বোধ করি, তখনই তৈরি হয় এই মানসিক চাপ। যা এক মূহূর্তেই একজন মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারে।

নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও দুশ্চিন্তা

মানুষের মন খুব অদ্ভুত। যা এক মুহুর্তে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতে পারে, আবার পরের মুহুর্তেই হতাশায় ডুবে যেতে পারে। এই চিন্তা ভাবনার খেলা অনেক সময় আমাদের জীবনে নেমে আনে অশান্তির ঝড়। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, দুশ্চিন্তা, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা এবং হতাশা – এইসব কিছু মিলে যখন আমাদের মনকে ঘিরে ধরে, তখনই জন্ম নেয় মানসিক চাপের ভয়াবহ রূপ।

কিছু নেতিবাচক চিন্তাভাবনা যেমন ‘আমি পারব না’, ‘সবকিছুই শেষ’, ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার’, ‘আমি ব্যর্থ’ – এই ধরণের চিন্তা ভাবনা আমাদের মনে দুশ্চিন্তার বীজ বপন করে। অতীতের ভুল, বর্তমানের সমস্যা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এই দুশ্চিন্তা কে আরও তীব্র করে তোলে। ফলে আমাদের সবার মনের উপর হতাশা নেমে আসে।

নিজেকে ছোট করে দেখা

মানসিক চাপ সৃষ্টির কয়েকটি সাধারণ কারণ

নিজেকে ছোট করে দেখা
আত্মসম্মান এবং নিজেকে মূল্যবান ভাবার ধারণা, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। যখন আমরা নিজেদের কে ছোট করে দেখি, হীনমন্যতায় ভুগি এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব অনুভব করি, তখন মানসিক চাপ বেড়ে যায়। এই চাপ দীর্ঘস্থায়ী হলে, তা বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার দিকে ধাবিত করে ফেলে।

কম আত্ম সম্মানের মানুষরা প্রায়শই নেতিবাচক চিন্তা ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকে। তারা নিজেদের সম্পর্কে, তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে এবং তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। এই ধরনের মানুষরা তাদের সিদ্ধান্ত এবং ক্ষমতায় সন্দেহ করে। তারা নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভয় পায় এবং ব্যর্থতার আশঙ্কায় থাকে।

বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া
মানসিক চাপের আরেকটি ভয়াবহ পরিণাম হলো অতিরিক্ত উদ্বেগ। ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্পষ্টতা, অজানা আতঙ্ক, সবসময় মনে ভয়ের ছায়া – এইসব কিছুই উদ্বেগের লক্ষণ। চাপের কারণে শরীরে কর্টিসল নামক হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা উদ্বেগের অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে।

দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপে থাকলে, মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে সেরোটোনিন ও ডোপামিনের মতো মেজাজ নিয়ন্ত্রণকারী নিউরো ট্রান্সমিটারের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মন খারাপ, আনন্দহীনতা, ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা – বিষণ্ণতার লক্ষণ গুলো একের পর এক বেরিয়ে আসে।

শারীরিক অসুস্থতার প্রভাব

শারীরিক অসুস্থতার প্রভাব
মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধামন্দা, ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি – এগুলো হলো সাধারণ শারীরিক অসুস্থতা যা মানসিক চাপের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

মানসিক চাপের সময় আমাদের শরীরে কর্টিসল নামক হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই হরমোন দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপের জন্য দায়ী। কর্টিসল রক্তচাপ, রক্তে শর্করার মাত্রা এবং হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি করে। এর ফলে মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, হজমের সমস্যা, এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ে।

পারিবারিক অশান্তি ও কলহ
মানুষের জীবনে পরিবার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ পরিবার হলো সুখ, ভালোবাসা এবং সমর্থনের আশ্রয়স্থল। কিন্তু যখন এই পরিবারে দেখা দেয় অশান্তি, কলহ এবং বিবাদ, তখন তা মানুষের জীবনে নেমে আসে অদৃশ্য ঝড়ের মতো, যা আমাদের জীবনে নিয়ে আসে অপরিসীম মানসিক চাপ।

একটি পরিবারে অশান্তির অনেক কারণ থাকে। আর্থিক সমস্যা, পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, অবিশ্বাস, যোগাযোগের অভাব, সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অসহ্য পরিবেশ। ঝগড়ার তীব্রতা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন শুরু হয় মানসিক চাপের যন্ত্রনা। তখন মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, বিষণ্ণতা নেমে আসে। ঘুমের অসুবিধা, ক্লান্তি, বিরক্তি, মনোযোগের অভাব – সব মিলিয়ে জীবন হয়ে ওঠে অসহ্য।

অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা মানে আয়ের অস্থিরতা, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধোঁয়াশা কে চিহ্নিত করা হয়। এই অজানা জিনিস গুলো মনকে অস্থির করে তোলে, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের জন্ম দেয়। প্রতিদিনের খরচ, ঋণ পরিশোধ এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ মেটানোর চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়।

এছাড়াও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকা মানসিক চাপের একটি প্রধান কারণ। যখন আমরা জানি না আগামী দিন গুলোতো আমাদের জন্য কী রয়েছে, তখন আমরা উদ্বিগ্ন, ভীত এবং হতাশা বোধ করি। বিশেষ করে যখন মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত আয় নিশ্চিত থাকেনা, তখন এই অনিশ্চয়তা আমাদের জীবনে আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

সামাজিক চাপ
মানুষ সামাজিক জীব। তাই আমরা সবসময় অন্যদের সাথে যুক্ত থাকতে চাই, তাদের সাথে মিশে যেতে চাই, তাদের স্বীকৃতি পেতে চাই। কিন্তু এই ইচ্ছা গুলো অনেক সময় পরিণত হয় এক অদৃশ্য বেড়া জালে, যা আমাদের মানসিক চাপের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। এই বেড়াজালের তিনটি প্রধান স্তম্ভ হল, সামাজিক প্রত্যাশা পূরণের চাপ, সমাজের সমালোচনা এবং বৈষম্য।

ডা. মেখলা সরকার বলেন, “যে সব বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, যেমন—মৃত্যু, সম্পর্কের বিচ্ছেদ, বড় অসুখ—এসবই আমাদের মনে অসহায়ত্ব তৈরি করে, যা মানসিক চাপের অন্যতম উৎস।”

মানসিক চাপ কমানোর কিছু উপায়

সাইকোলজিক্যাল বিশেষজ্ঞরা এবং বিভিন্ন হাসপাতাল যেমন ‘নিরাময় হসপিটাল’ বলছে, নিয়মিত ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে খুবই কার্যকর। শরীরচর্চা আমাদের মস্তিষ্কে ‘এন্ডোরফিন’ নামে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে, যা মন ভালো করতে সাহায্য করে।

হাঁটা, সাইকেল চালানো, হালকা দৌড় (জগিং), ইয়োগা বা যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা ধ্যান।

এই ব্যায়ামগুলো নিয়মিত করলে শুধু মানসিক চাপই কমে না, বরং শরীরও থাকে ফিট ও কর্মক্ষম।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন