সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ধারাবাহিক তীব্র হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। তারা জানায়, সুয়েইদায় দ্রুজদের রক্ষায় ও তাদের ওপর হামলাকারী সরকারপন্থিদের দমন করতেই এই অভিযান চালানো হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) সিরিয়া ইসরাইলের এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এটিকে ‘বিপজ্জনক পরিস্থিতির তীব্রতা বৃদ্ধি’ বলে অভিহিত করেছে।
সিরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে সিরিয়ায় উত্তেজনা বৃদ্ধি, বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেওয়া এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার’ অভিযোগ তুলেছে।
বুধবার সিরিয়ায় কী ঘটেছিল?
ইসরাইল বুধবার সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের মধ্যাঞ্চলে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের ধারাবাহিক এ হামলা
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছের এলাকাগুলোতে অবস্থিত একটি কম্পাউন্ডে আঘাত করেছে।
এছাড়া ইসরাইলি সেনাবাহিনী দক্ষিণ সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতেও হামলা চালিয়েছে, যেখানে চার দিনেরও বেশি সময় ধরে দ্রুজ সম্প্রদায়, বেদুইন উপজাতি এবং সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের মতে, চলমান সংঘর্ষে সুওয়াইদা প্রদেশে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
ইসরাইল বলছে,তাদের অভিযানের লক্ষ্য দ্রুজ সম্প্রদায়দের রক্ষা করা (যাদের তারা সম্ভাব্য মিত্র বলে দাবি করে) এবং তাদের ওপর আক্রমণের অভিযোগে সরকারপন্থি বাহিনীকে আঘাত করা।
যদিও সিরিয়া ইসরাইলের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এই হামলাকে ‘প্রকাশ্য আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছে।
কোথায় হামলা হয়েছে?
ইসরাইলি হামলাগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল দামেস্কের কেন্দ্রস্থল: প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সামরিক সদর দপ্তর এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আশেপাশের এলাকা। আরও দক্ষিণে আরও হামলা চালানো হয়।
সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর: স্থানীয় সময় বিকাল ৩টার দিকে দুটি বড় ধরনের হামলা চালানো হয়। এর ফলে ভবনটির প্রবেশপথ সহ কাঠামোগত ক্ষতি হয় এবং শহরের ওপর দিয়ে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে (উমাইয়াদ স্কয়ার): দামেস্কের মধ্যাঞ্চলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আশেপাশের এলাকাগুলোতেও বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এছাড়া দামেস্কের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে আরেকটি বিমান হামলা চালানো হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ইসরাইল জানিয়েছে, ‘দামেস্ক অঞ্চলে সিরিয়ার সরকারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের এলাকায় একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা হয়েছে। ’
দক্ষিণাঞ্চল: ইসরাইলি ড্রোনগুলো সিরিয়ার সুওয়াইদা শহরকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে, যা জর্ডান সীমান্তের কাছে অবস্থিত মূলত দ্রুজ শহর।
কেন সিরিয়ায় বোমা হামলা চালালো ইসরাইল?
সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং স্থানীয় দ্রুজ সম্প্রদায়ের মধ্যে সুওয়াইদায় কয়েকদিন ধরে চলা মারাত্মক সংঘর্ষের পরই বিমান হামলা চালালো ইসরাইল। দ্রুজ সম্প্রদায় এবং স্থানীয় বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অপহরণ এবং আক্রমণের মধ্য দিয়ে সহিংসতার শুরু হয়। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারি বাহিনী এতে হস্তক্ষেপ করে এবং দ্রুজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করেও হামলা চালানো হয় বলে জানা গেছে।
সিরিয়া এব ইসরাইল উভয়ই সংখ্যালঘু দ্রুজদের ইসরাইলের অনুগত মিত্র হিসেবে দেখে। এ সম্প্রদায়ের অনেকেই ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে কর্মরত।
যদিও সুওয়াইদার দ্রুজদের বিভক্ত বলে ধারণা করা হয়। তাদের অন্যতম নেতা ইয়াসের জারবু ঘোষণা করেন, সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তবে আরেক নেতা হিকমত আল-হিজরি যুদ্ধবিরতির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আবার অনেক সিরীয় দ্রুজরা চান না যে, ইসরাইল তাদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করুক।
দ্রুজ কারা?
দ্রুজরা হলো আরবিভাষী এক জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যারা সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল এবং ইসরাইলের অধিকৃত গোলান মালভূমিতে বসবাস করে। তাদের ধর্ম বিশ্বাস শিয়া ইসলামের একটি শাখা হলেও, এতে রয়েছে নিজস্ব পরিচয় ও বিশ্বাস।
বিশ্বে আনুমানিক ১০ লাখ দ্রুজ জনগোষ্ঠীর বাস, যাদের অর্ধেকই থাকে সিরিয়ায়। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ তারা।
ইসরাইলে বসবাসরত দ্রুজদের অনেকে দেশটির সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। তাই সাধারণভাবে তারা ইসরাইল-সমর্থক হিসেবে বিবেচিত হন। ইসরাইলের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইল ও গোলান মালভূমিতে প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার দ্রুজ বাস করে।
সিরিয়ার রাজনীতিতে দ্রুজরা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থেকেছে। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সময় তারা দক্ষিণ সিরিয়ায় নিজেদের মিলিশিয়া গড়ে তোলে।
গত ডিসেম্বরে আসাদ সরকার পতনের পর থেকে দ্রুজরা দক্ষিণ সিরিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টার বিরোধিতা করছে। যদিও তারা নতুন সরকারের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব দেখাচ্ছে—কেউ সতর্ক, কেউ স্পষ্টভাবে বিরোধিতা করছে। তবে অনেকেই সুয়েইদায় সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি মানতে চায় না এবং সিরীয় সেনাবাহিনীতে যুক্ত না হয়ে স্থানীয় মিলিশিয়াদের ওপরই ভরসা রাখছে।
সিরিয়ার প্রতিক্রিয়া
সিরিয়া ইসরাইলের এ হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানিয়েছে
দামেস্কে অবস্থিত ওমরান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক আম্মার কাহফ বলেন, ‘ইসরাইলিরা সিরিয়ার সরকারকে পুরো ভূখণ্ডে কর্তৃত্ব বিস্তার করতে দেবে না।’
তিনি বলেন, ‘আসাদের সরকারের পতনের পর এবং নতুন নেতৃত্বের ওপর ইসরাইল তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
তিনি আল জাজিরারকে আরও বলেন, ‘আমরা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছি, তবে এর জন্য সমস্ত সিরিয়ানকে একত্রিত হতে হবে। একটি বিদেশী সরকার এসে জনসাধারণের সম্পত্তি ধ্বংস করবে এবং নিরাপত্তা ধ্বংস করবে,তা ব্যাখ্যাতীত।
সিরিয়া সরকার আরও ঘোষণা করেছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে সুওয়াইদা শহর থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার শুরু করবে। এতে অন্যান্য সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যাহারের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন