শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫

শিরোনাম

গাজায় ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধ নিয়ে যা জানাল মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন

শনিবার, নভেম্বর ৮, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান চলাকালীন ইসরাইলের সামরিক আইনজীবীরা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপনের মতো প্রমাণ থাকার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন বলে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ওই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল মূলত মার্কিন অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে। এ তথ্য জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পাঁচ কর্মকর্তা, যাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে বিশেষ সংবাদ প্রকাশ করেছে রয়টার্স।

সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই তথ্য ছিল গাজা যুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছানো সবচেয়ে উদ্বেগজনক গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর একটি। এতে দেখা যায়—ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর ভেতরেই যুদ্ধ পরিচালনার বৈধতা নিয়ে সংশয় ছিল, যা সরকারের প্রকাশ্য অবস্থানের সঙ্গে তীব্রভাবে সাংঘর্ষিক।

গাজায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ক্রমেই বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে ইসরাইলের সামরিক অভিযান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধের নির্দিষ্ট প্রমাণ বা ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি।

গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, দুই বছরের সামরিক অভিযানে ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছে ৬৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। ইসরাইল দাবি করছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার ছিল যোদ্ধা।

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা নয়জন সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, তারা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সময় দায়িত্বে ছিলেন এবং তাদের ছয়জন সরাসরি এই গোয়েন্দা তথ্য ও পরবর্তী বিতর্ক সম্পর্কে জানতেন। বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।

বাইডেন প্রশাসনের শেষ সপ্তাহে তীব্র বিতর্ক

গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশের পর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। আলোচনায় উঠে আসে—ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ করছে বলে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে মার্কিন আইন অনুসারে দেশটিকে অস্ত্র সরবরাহ ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বন্ধ করতে হবে।

বিতর্ক সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব প্রমাণ পায়নি যে ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিক বা মানবিক সহায়তাকারীদের হত্যা করছে। ফলে অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহযোগিতা আইনগতভাবে চালিয়ে যাওয়া যায়।

তবে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা মনে করেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে এবং ইসরাইলের সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রশ্রয় দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি এবং ইসরাইলের প্রতি আরও ঘনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেন বলে সাবেক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আইনজীবীদের উদ্বেগ

রয়টার্স জানায়, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যের আগেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আইনজীবীরা সচিব অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে সতর্ক করেছিলেন যে, গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে এবং তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরেই তারা এ বিষয়ে বৈঠকে মতামত দেন। তবে তারা কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি যে ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে—যা অনেক কর্মকর্তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে আইনি বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হিসাবে দেখেন।

২০২৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইল মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করে থাকতে পারে। তবে যুদ্ধের অনিশ্চয়তার কারণে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।

ব্লিংকেনের মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেন, বাইডেন প্রশাসন সবসময় ইসরাইলের যুদ্ধ আইনের প্রতি আনুগত্য এবং আমাদের নিজস্ব আইনি বাধ্যবাধকতা পর্যালোচনা করেছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ

গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও হামাস নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে গাজা সংঘাতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। হামাস জানিয়েছে, পরে ইসরাইলি হামলায় দেইফ নিহত হন।

ইসরাইল এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আদালতের এখতিয়ার স্বীকার করেনি। একইভাবে হামাসও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন বলেন, এই প্রতিবেদন প্রমাণ করে যে বাইডেন প্রশাসন মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ রেখেছিল।

ইসরাইল বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগের মুখোমুখি। দেশটি অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করছে এবং বলছে, তাদের অভিযান হামাসকে লক্ষ্য করেই পরিচালিত, গাজার সাধারণ মানুষকে নয়।

ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে এবং সম্ভাব্য ২,০০০টি ঘটনার তদন্ত করছে, যেগুলোর মধ্যে বেসামরিক মৃত্যু ও অবকাঠামো ক্ষতির অভিযোগ রয়েছে।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন