কাকন রেজা: পারভেজ মারা গেলেন। তরতাজা তরুণ। শহীদের মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। বিপ্লব এখনো শেষ হয়নি। অসংখ্য ছাত্র-জনতা এখনো চিকিৎসাধীন। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়। নিজের সন্তান বিক্রি করে কারো চিকিৎসা খরচ চালাতে হচ্ছে এমন খবরও দিচ্ছে গণমাধ্যম।
এখানে প্রশ্ন করতে পারেন, অন্তবর্তীকালীন সরকার কী করছে। প্রশ্নটা উঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরটা তিক্ত এবং যারা প্রশ্ন করছেন তাদের জন্য। সরকারকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে অকারণ প্রতিবিপ্লবের চেষ্টায়। জুডিশিয়াল ক্যু, প্রশাসনিক ক্যু, আনসার ক্যু, সাম্প্রদায়িক ক্যু, রিকশাওয়ালা ক্যু, হকার ক্যু, ডাক্তার ক্যু, নার্স ক্যু এবং সর্বশেষ চলছে মাজার ভাঙা ক্যু। সরকার প্রতিবিপ্লব ঠেকাবে, না আহতদের চিকিৎসার খোঁজ নেবে! শহীদদের তালিকা করবে, না অকারণ দাবীর তালিকা করবে!
অনেকেই বলেন, এতদিন এতসব দাবী কোথায় ছিলো। সত্যিই তো, যাদের মুখ খুলে প্রতিবাদ না করে পতিত সরকারের পদলেহন করতে দেখেছি, এখন তারা সামাজিকমাধ্যমে নানা কথা লিখছেন। এরমধ্যে বাংলা একাডেমির দুটো রামপাঠা রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটে যারা মুখ খুলেনি। গুম-খুন-আয়নাঘরকে যারা বলতো গুজব। উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে জিহ্বা লম্বা করে ফেলতো। তারা এখন অন্তবর্তীকালীনসরকারের ভুল-ত্রুটি ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ‘এসব কী হচ্ছে’ কিংবা ‘এই স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম’ বর্তমান সময়ে তাদের কমন ডায়লগ হয়েউঠেছে।
এই গাড়লগুলো আজন্ম একচোখা জীব। মানুষ নয় ঠিক, মানুষের মতো আর কী। এই গাণ্ডুগুলোর চোখে পড়ে না, যে মেট্রোরেল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হবার পর বলা হয়েছিলো, চালু হতে এক বছর সময় লাগবে। ঠিক করতে লাগবে সাড়ে তিনশ থেকে চারশ কোটি টাকা। সেই রেল চালু হয়েছে বিশ দিনের মধ্যে। দুটো বন্ধ স্টেশন চালু হয়ে যাবে তিন মাসেই। আর ঠিক করতে টাকা লাগবে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ কোটি।
এই অন্ধগুলোর মনে কি প্রশ্ন জাগে না, চারশ কোটি টাকা থেকে পঞ্চাশ কোটি বাদ গেলে থাকে সাড়ে তিনশ কোটি। এই সাড়ে তিনশ কোটি টাকা কার পকেটে যেত! অঙ্কটা তো খুব জটিল নয়। বিয়োগ অঙ্ক। ট্রিং ট্রিং সাইকেল চালানো টাইপ পড়াশোনাটা গর্তবাসী জাফর স্যার সবে শুরু করেছিলেন। তারা তো জাফর স্যারের ট্রিং ট্রিং সাইকেলের ছাত্র নন, তাদের যে বয়স তাতে পাটিগণিত তাদের শিক্ষাক্রমে ছিলো। সুতরাং সহজ বিয়োগ অঙ্কটি না বোঝার কোনো কারণ নেই। আপনারা উল্টো তাদের প্রশ্ন করতে পারেন, বাকি সাড়ে তিনশ কোটি টাকায় কার পকেটের উন্নয়ন হতোকিংবা কার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের রিজার্ভ বাড়তো!
অনেকে দেখলাম বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে আফসোস করছেন, এদেরকে কেউ কেউ ‘আফসোস লীগ’ বা ‘আফসোস পার্টি’ নামে আখ্যায়িত করেন। এদের কাজই আফসোস করা। তারা বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু বলেন না, ভারতের আদানি গ্রুপ বকেয়া টাকার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, এই টাকা বকেয়া রেখেছিলো কারা।
গত ২৯ জুন বাংলাদেশের প্রথম আলো খবর করেছিলো, ‘আদানির কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ’ এই শিরোনামে। আফসোস পার্টির লোকজন ভুলে গেছেন জুনের লোডশেডিংয়ের স্মৃতি। কদিন ভয়াবহ লোডশেডিং ছিলো। পতিত সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী সময় চেয়েছিলেন। মাত্র দু’মাস আগের কথা। আফসোস পার্টির গোল্ডফিস মেমোরি সে কথা ধরে রাখতে পারেনি। আদানির দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাবার কথা দেড় হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা এ হিসেব ধরেই।
আসি গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিবিসি’র ভারতীয় প্রতিবেদক শুভজ্যোতি ঘোষের ‘বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুতের বকেয়া আদায়ে ভারতীয় সংস্থাগুলো কী করবে?’- এমন শিরোনামের প্রতিবেদন বিষয়ে। ঘোষ বাবু প্রতিবেদনটি শুরু করেছেন এভাবে, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যেই গোটা দেশযখন এই মুহুর্তে লোডশেডিং আর তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে, তখন অন্তর্বর্তীসরকারের জন্য বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে পাওনাদার ভারতীয়সংস্থাগুলোর তাগাদা।’
অর্থাৎ শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে ভারতের ইনটেনশন এর বিষয়টি। পরিষ্কার যে, রাজনৈতিক পালাবদলের কারণেই ভারতের সংস্থাগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় বন্ধ করে দিয়েছে না হয় কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ‘জাস্টিফাই পার্টি’র লোকজন অবশ্য বলতে পারেন, যেহেতু সরকার বদল হয়েছে এবং প্রচুর বকেয়া রয়েছে, তাই ভারতের সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলো সংশয়ে ভুগছে। সে কারণেই বিদ্যুৎ সরবারাহ বন্ধ বা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন জাস্টিফাই প্রচেষ্টার মধ্যেও কিন্তু সত্যিটা বেরিয়ে আসে। কীভাবে আসে সেটা বলতে গেলেই বলতে হয়, গত সরকারের আমলে এতটা বকেয়া কেন দেয়া হলো। উত্তর একটাই অনুগত আস্থাভাজন বলে।
কিন্তু বর্তমান সরকার চোখে চোখ রেখে কথা বলছে। কথা বলছে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সমমর্যাদার ভিত্তিতে। সুতরাং বাংলাদেশ তাদের বলতে পারে, আদানি বিদ্যুৎ না দিয়েই বিদ্যুতের টাকা নিয়েছে, সেই টাকা ফেরত দাও। বিশ্ববাজারে বিদ্যুতের দামের তুলনায় অনেক বেশি দামে তোমরা বিদ্যুৎ বিক্রি করেছো, সেই টাকারহিসেব কর, তারপর বকেয়ার আলাপ। এর জবাব কি ভারতে কাছে আছে? নেই। তাই ভারত তার চাণক্যনীতিতে বাংলাদেশের সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সরবরাহ কমিয়ে লোডশেডিং সৃষ্টি করছে, এমনটা ভাবা দোষের কিছু নয়।
এর ফলে মানুষ বলতে বাধ্য হবে, আগে তো এত লোডশেডিং হতো না। ভারতের সে আশায় গুড়েবালি। বাংলাদেশের মানুষ এখন এগুলো বোঝে। গত রাজনৈতিক বন্যায় বাংলাদেশের মানুষ তথা আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে ছবক শেখাতে চেয়েছিলো ভারত, উল্টো ছাত্র-জনতাই তাদের ছবক দিয়ে দিয়েছে। বিদ্যুৎ নিয়ে সেই একই অবস্থা হবে।
ভারত যত বাংলাদেশের মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলারচেষ্টা করবে, ততই বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে এবং ভারতের বিরুদ্ধে চলে যাবে। চলে যাবে বলছি কী, ইতোমধ্যে দেশের নব্বই ভাগের উপর মানুষ ভারত বিরোধী। এখানে ভারত বলতে আমি রাষ্ট্রের কথা বলছি, জনগণের কথা নয়। ভারতের অসংখ্য মানুষ জুলাই বিপ্লবকে সমর্থন করেছেন। তারা আমাদের সাথে ছিলেন।
যেমন ছিলেন একাত্তরে। তাদের স্যালুট। ২৯ জুলাই সুহার্তো নামে একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন। যার ডান চোখের পাশে গুলি লেগে মস্তিষ্ক ভেদ করে যায়। মস্তিষ্কের সেকেন্ডারি হ্যামারেজে ২১ জুলাই মারা যান সুহার্তো। ১৯ বছরের তরতাজা তরুণ ১৮ জুলাই আন্দোলনে মিরপুরে বুলেটবিদ্ধ হন। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলো তার। আইসিইউতে ছিলেন তিনি। তাকে বাঁচানো যায়নি। এই যে যারা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে বসাতে চেয়েছিলেন, তাদের বলি, সুহার্তো কি পরীক্ষা দিতে যেতে পারতেন?
তার সাথে তার যে কয়জন বন্ধু ছিলেন, যারা রক্তাক্ত সুহার্তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারা কি পরীক্ষার হলে বসার জন্য মানসিক ভাবে উপযুক্ত ছিলেন? যারা নিজ বন্ধু-সহপাঠিদেরএভাবে আহত নিহত হতে দেখেছেন কিংবা তাদের চোখের সামনে বুলেটবিদ্ধ মানুষকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছেন তারা কি পরীক্ষা দেয়ার মতন মানসিক শক্তি পেতেন? তাহলে অটোপাশে বিক্ষুব্ধ হলেন কারা? যারা হয়েছেন, সম্ভবত তাদের কেউ আন্দোলনে যাননি, কিংবা ৫ আগস্টের পর বিপ্লবী হয়েছেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধের পর যোদ্ধা হয়েছিলেন পঞ্চান্ন হাজার মানুষ।
এই অটোপাশ নিয়েও বর্তমান সরকারকে বেশ সময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এই অটোপাশ ছিলোসঙ্গত, এরজন্য দাবী তোলার প্রয়োজন ছিলো না। তখনই লিখেছিলাম,বাচ্চারা এক ট্রমা থেকেই বেরুতে পারেনি, তাদের কেন পরীক্ষার নামে আরেক ট্রমার মধ্যে ফেলা হচ্ছে। পড়ার টেবিলে যখন মানুষের রক্তাক্ত শরীর এবং মৃত্যু যন্ত্রণার দৃশ্য চোখে ভাসবে তখন কি কারো পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব? এটা তো সিনেমা নয়, শিক্ষার্থীরাও অনন্ত জলিল নয় যে ডায়লগ দেবে, ‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই আমার কাজ’। এমন মিমাংসিত বিষয় নিয়েও সরকারকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
চিকিৎসকদের কথা বলি, জুলাই বিপ্লবে যখন আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়া হলো। ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের উপর দফায় দফায় হামলা হলো। ডেথ রেজিস্টার গোয়েন্দা সংস্থা জোর করে নিয়ে গেলো। ডেথ সার্টিফিকেট বদলে দিলো। সার্টিফিকেট ছাড়াই লাশ নিয়ে গেলো গণকবরে দাফনের জন্য। তখন চিকিৎসকদের মানবিকতা, পেশাগত শপথ কোথায় ছিলো? আগস্ট ভিক্টোরির পর ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সিতে মারামারির ঘটনায় তারা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ডাকলেন! শপথের কথা যদি মনে থাকে তবে তারা নিজের বিবেককে প্রশ্ন করতে পারেন, আগে তারা কী করেছেন, এখনই বা কী করলেন এবং কেন করলেন। সরকারকে এনিয়েও ব্যস্ত থাকতে হয়েছে অনেকটা সময়। যেখানে স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজানো দরকার। সাতাশ হাজার টাকায় বালিশ কেনার মতন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। দরবেশ এর কোম্পানি করোনার টিকা নিয়ে যে টাকা হাপিশ করেছে তা উদ্ধার করা দরকার। তখন করা হলো উল্টো কারবার। সরকারের প্রায়োরিটিগুলো বাধাগ্রস্ত করা হলো!
যারা আফসোস পার্টি’র লোকজন, তারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, এতদিন কোথায় ছিলেন। এই যে অবিশ্বাস্য এবং অসম্ভব রকম দুর্নীতির চিত্র একের পর এক উঠে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলছেন, ১৩টা ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে। অর্থনৈতিক যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণে দুই লক্ষ কোটি টাকার দরকার, এমন কথাও বলা হচ্ছে।ক্যাশিয়ার খ্যাত এক এস আলমই ইসলামী ব্যাংকের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়েছেন। লোপাট করেছেন ৫৬ হাজার কোটি টাকা। চিন্তুা করা যায়! পাহাড় সমান ঋণ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে দেশের উপর। বিপরীতে দেশের টাকা লুট করে বিদেশে নেয়া হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে সাদ্দাদের বেহেশতখানা। দরবেশের দুই পুত্রই নাকি বাস করে দেড়শ কোটি টাকার বাড়িতে। আফসোস পার্টির এ নিয়ে কোনো কথা নেই। আলাপ করছেন শুধু ‘কী হচ্ছে’ আর ‘এমন স্বাধীনতা’ বিষয়ে। গাড়ল সব।
Views: 4
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন