নিজস্ব প্রতিবেদক: রোববার সকাল ৯ টা ২ মিনিট। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে হুইসেল বাজিয়ে যাত্রা শুরু করে ৮ কোচের লম্বা ট্রেন। দশ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকোমাস্টার মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান এবং সহকারী লোকোমাস্টার রুখন মিয়া প্রথমবারের মতো পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ট্রেন নিয়ে যাত্রা করেন। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে ধীরে ধীরে ট্রেনের চাকা স্পর্শ করতে থাকে রেল লাইন। মাঠ-ঘাট সবুজ প্রান্তরের পাশ দিয়ে স্বপ্নের ট্রেন ছুটতে থাকে নতুন এক গন্তব্যে। পথে পথে হুইসেল জানান দেয় নতুন শহরে নতুন বাহনের পথচলা। সেই সাথে হাত উচিয়ে স্বাগত জানাতে থাকে মোড়ে মোড়ে দাড়িয়ে থাকা মানুষজন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব হচ্ছে ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু হয়ে পাহাড় ও নদীপথ দিয়ে পর্যটননগর কক্সবাজার পর্যন্ত এই রেললাইন চলে গেছে। এই পথে আছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।
রোববার (৫ নভেম্বর) সকাল ১০টায় ট্রেনটি দোহাজারী স্টেশনে পৌঁছায়। এরপর সেখান থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেয়। ট্রেনটি বিকেল সাড়ে ৫টায় কক্সবাজার পৌঁছার কথা রয়েছে। রেলের পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কক্সবাজারে অবস্থান করবেন। ৬ নভেম্বর ওই টিম কক্সবাজার রেলস্টেশন ইয়ার্ড পরিদর্শন করবে। ৭ নভেম্বর সকাল ৭টায় তারা চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবেন। আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে কক্সবাজারের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে।
কক্সবাজার ছুটে যাওয়া এই ট্রেন কোন যাত্রবাহী বা পণ্যবাহী নয় আবার এটি যে ট্রয়াল ট্রেন তাও বলা যাবে না। রেলপথের সবকিছু ঠিক আছে কিনা সেটি যাচাই করতেই এই পরিদর্শন ট্রেন চালানো হচ্ছে। এ যাত্রা শেষে কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের পর চূড়ান্ত অনুমোদন মিললেই এই রুটে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হিসেবে ঘোষণা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে প্রথমবার কক্সবাজার ছুটে চলা এই ট্রেনকে ঘিরে আশপাশের জনসাধারণের যেমন ছিলো বাড়তি উত্তেজনা তেমনি প্রথম এই ট্রেনের যাত্রী হতে পেরে বেশ উৎসাহ দেখা গেছে রেলওয়ে কর্মকর্তা-প্রকৌশলী -সাংবাদিকদের মাঝে।
ময়মনসিংহের সন্তান মাহফুজুর রহমানের বেড়ে উঠেছছেন চট্টগ্রাম শহরে। তিনি রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। তবে লোকোমাস্টার হিসেবে ট্রেন চালাচ্ছেন ২০১৪ সাল থেকে। এর আগে সহকারী লোকোমাস্টার ও সাব লোকোমাস্টার ছিলেন। কিছুদিন আগে আখাউড়া থেকে আগরতলায় যে ট্রেন গেছে সেটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
স্বপ্নের এই ট্রেন চালানোর সৌভাগ্য হয়েছে তার। আর এর অনুভূতি যে কতটা আনন্দদায়ক তা প্রকাশের যেন ভাষাই নেই মাহফুজুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ট্রেন চালাতে গিয়ে ছোট-বড় অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাচ্ছি। এটিও আমার কাছে অনেক বড় অভিজ্ঞতার বিষয়। যা সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।
এমন অভিজ্ঞতা কোনদিন ভুলবেন না বলে মনেস করেন সহকারী লোকোমাস্টার রুখন মিয়া। ২০১৭ সালে রেলওয়েতে যোগ দিয়েছেন তিনি। তারও রয়েছে অনেক অভিজ্ঞতার গল্প। তিনি বলেন, বহু ট্রেনেই কাজ করেছি। তবে এবার এমন একটা গন্তব্যে যাচ্ছি, যেখানে সবাই বছরে একবার হলেও যেতে চান। আর সেই কক্সবাজারে প্রথম ট্রেন নিয়ে যাওয়ার পেছনে আমারও অবদান আছে, এটা আমার জন্য গর্বের।
এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালানোর জন্য প্রধান বাঁধা ছিল পুরনো কালুরঘাট সেতু। পরে বুয়েটের পরামর্শে সেটি সংস্কার করে ভারী ট্রেন চালানোর উপযোগী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ১ আগস্ট থেকে সেতুটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। বর্তমানে কাজ শেষ পর্যায়ে এসে এখন সেতু দিয়ে ১৫ এক্সেল লোডের ইঞ্জিন চলাচল করতে পারে। শনিবার (৪ নভেম্বর) তিনটি ভিন্ন সিরিজের ইঞ্জিন দিয়ে এ সেতুতে ট্রায়াল রান সম্পন্ন করা হয়। ইঞ্জিন তিনটি শহর থেকে বোয়ালখালী অংশে যাতায়াত করে। এতে প্রাথমিকভাবে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বলেন, সেতু সংস্কারকাজ ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ওয়াকওয়ে ও ঢালাইয়ের কাজ বাকি। তবে ট্রেন চলাচলের উপযোগী। বাকি শেষ হতে মাসখানেক সময় লাগবে।
ট্রেনে জিআইবিআর রুহুল কাদের আজাদ, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলাম, দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ সহ পূর্ব রেলের শীর্ষ কর্মকর্তারা রয়েছেন। জিআইবিআর স্পেশাল ট্রেনে করে সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের কারিগরি তদারকি করছেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, এটি কোনো ট্রায়াল ট্রেন না। নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলে সেটি যাচাই-বাছাই করতে হয়। এটি তারই অংশ। এখানে রেলের পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা রয়েছেন। তারা যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিকঠাক আছে জানালে যথাসময়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। রেলপথটি নির্মিত হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন প্রকল্পটি আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও তার আগে আগামী ডিসেম্বরের দিকে পুরোপুরি কাজ শেষ হবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ট্রেন চালানোর জন্য তার আগেই বুঝিয়ে দেওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন