রুমান হাফিজ:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)।১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভের পর হাটি হাটি পা পা করে ৫৬ বছরে এক নব যৌবনে এসে পা দিয়েছে চবি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধসহ সব যৌক্তিক সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় অংশগ্রহণ। ছাত্র রাজনীতির প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রমে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো সরব। তবে সেই যাত্রায় ভাটা পড়ে বিভিন্ন সময়ে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।
এর মধ্যে প্রায় দু’যুগ ধরে এখানে আধিপত্য বিস্তার করে ইসলামি ছাত্র শিবির। চবির হল সংসদের কক্ষ ব্যবহার করেই চলত তাদের কার্যক্রম। ১৯৯০ সালের চাকসু নির্বাচনে মাত্র একটি হলে তাদের আধিপত্য ছিল। ‘৯১-এ বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে চবির সব হল দখল করে নেয় তারা। এরপর সরকার বদল হলেও শিবিরের আধিপত্যে এতটুকু নড়চড় হয়নি। সারাদেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে শিবির। ছাত্রদের সব আবাসিক হলে শিবিরের পক্ষ থেকে চলে অন্য সংগঠনের তৎপরতার ওপর কড়া নজরদারি। এর ফলে ২০০১ সালের পর সেই হলগুলোতে উঠতে পারেননি অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শিবির উৎখাতের প্রক্রিয়া। তবে ছাত্রশিবিরের শক্ত শেকড় ও হলগুলোতে নিজেদের আধিপত্য থাকায় প্রথম দিকে বেশি সুবিধা করতে পারেনি চবি ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানান, ২০০৯ সালের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলে থাকতে পারতো না ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কেউ হলে উঠলে তাকে বের করে দেওয়া হতো। ২০০৯ সালের দিকে ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট ও কলা অনুষদের ঝুপড়ি পর্যন্ত। একই বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ মিছিল করে ছাত্রলীগ। যদিও শিবিরের হামলায় পণ্ড হয়ে যায় সেই আনন্দ মিছিল। তখন ছাত্রলীগ চেষ্টা করেও হলে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়। এরপর ২০০৯ সালের ১৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের রব হলে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষ বাধে। সে সময় ছাত্রলীগের কাজী মারুফ হোসেন নামে একজন মারাত্বক আহত হয়। ৬ মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর তিনি সুস্থ হন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল, শাহ আমানত ও রব হলে কিছুটা অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। কিন্তু এই ঘটনায় সেই অবস্থানও হারায় ছাত্রলীগ।
এ সময় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মিছিল, মিটিং ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। পরে ২০১১ সালের দিকে শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হলে কিছুটা সংঘবদ্ধ হয় দলটি। কমিটি গঠিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে ফের সংঘর্ষ হয়। এসময় পুনরায় শাহজালাল ও শাহ আমানত হলের কিছুটা দখল করে ছাত্রলীগ।
২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চবি ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এর মধ্যে পাঁচবার সংঘর্ষে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি হল দখল করে ছাত্রলীগ। পৃথক দুই ঘটনায় নিহত হয় ছাত্রশিবিরের ৩ নেতা।
২০১৫ সালের ২২ মে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী বিকেল ৪টার দিকে আলাওল হলের মাঠে ক্রিকেট খেলতে গেলে শিবিরকর্মীরা মিজানুর রহমান নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে হুমকি দেয়। এ ঘটনায় পাশাপাশি অবস্থিত আলাওল ও এফ রহমান হলে ‘আধিপত্য’ নিয়ে থাকা শিবিরকর্মীদের সঙ্গে এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। উভয়পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি পাথর নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে শিবিরকর্মীরা হল ছেড়ে বেরিয়ে এলে ছাত্রলীগ কর্মীরা হল দুটিতে অবস্থান নেয়। এ ঘটনায় উভয়পক্ষের অন্তত আটজন আহত হয়। এ ঘটনার পর হল দুটি দখলে নেয় ছাত্রলীগ।
এদিকে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণে থাকা আব্দুর রব হল দখল নিতে যায় ছাত্রলীগ। ওই সময় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে ওই হল থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রশিবির। এবং দখলে নেয় ছাত্রলীগ। এভাবে একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রী হলগুলো দখলে নিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করে চবি ছাত্রলীগ।
শুধু শিবিরই নয়। তাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলেরও কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। দল ক্ষমতায় আসতে না পারায় ক্যাম্পাস থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেয় তারা। গত এক দশকে দলীয় কর্মসূচি পালন করতেও দেখা যায় নি তাদের। তবে ক্যাম্পাসে করতে না পারলে চট্টগ্রাম নগরীতে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলেও জানান দলের কয়েকজন নেতা। তাদের দাবি, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে তারা সেখানে উপস্থিত হতে পারছেন না। সর্বশেষ গত ২০২০ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ভাস্কর্যে ফুল দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন চবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম শহীদসহ অন্তত ১০জন আহত হয়েছেন।
চবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, চবিতে ছাত্রলীগ তাদের একনায়কতন্ত্র কায়েম করে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত রাজনীতি চর্চার আতুড়ঘর হলেও এখানে তা ভিন্ন। আমারা নিজেদের দলিও কার্যক্রম ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাতীয় দিবসগুলোতে ফুল দিতে গেলেও তারা হামলে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এক্ষেত্রে নীরব ভূমিকায়। এভাবে তো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি চলতে পারে না।
২০১৫ সালের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেলতে শুরু করে ছাত্রলীগের ডালপালা। আর ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের রাজত্বের। এরপর এখনও পর্যন্ত আর এক হতে পারেনি ছাত্রশিবির। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসে দেখা গেলেও ছাত্রলীগের তোপের মুখে তাদের ছাড়তে হয়েছে ক্যাম্পাস। আর বিদ্যুৎ গতিতে ডালপালা মেলে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের রাজত্ব।
একক আধিপত্য বিস্তার করলেও গ্রুপিং এর কারণে নানা সময়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ায় চবি ছাত্রলীগ। কয়েক দশক ধরে চবি ছাত্রলীগ নগর আওয়ামী লীগের দুইটি ধারায় নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। একটি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারি। আরেকটি প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারি। তবে বর্তমানে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে তারা অনুসরণ করেন। আবার এ দুটি মূল গ্রুপের মধ্যে অনেক উপ-গ্রুপ। এরমধ্যে আজম নাছির অনুসারিদের উল্কা, সিক্সটি নাইন, ভিএক্স, একাকার, কনকর্ড, আরএস, বাংলার মুখ, এপিটাফ। অন্যদিকে শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারিরা হলেন সিএফসি ও বিজয়।
এদিকে প্রায় আড়াই বছর আগে, ২০১৯ সালের ১৪ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে করোনা মহামারীসহ বিভিন্ন কারণে চবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। যার কারণে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা চলে আসে।
গত ৯ নভেম্বর শাখা ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে নেতা-কর্মীদের জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করা হয়। চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়৷
দীর্ঘদিন পর পূর্ণাঙ্গ কমিটির গঠনের ঘোষণায় নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রশিবিরকে উৎখাত প্রসঙ্গে চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আজকের অবস্থানে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে লতা-পাতার মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল। আমরা সেই দুঃসময় পার করে এসেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্রশিবির এখন ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে নেই। তবে আমরা শুনতে পাই গোপনে তারা মাঝে মাঝে কার্যক্রম চালায়। এই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর হওয়া উচিত।
রেজাউল হক রুবেল বলেন, শিবিরের দখলে থাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের মধ্যে অনেক জামায়াত ওঁত পেতে আছে। তবে আমরা এসব নিয়ে সব সময় তৎপর আছি। আমরা জানি তাদের কিভাবে প্রতিহত করতে হবে। আমারাও নিজেদেরকে আরও সংঘটিত করার চেষ্টা করছি। শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। সেই সঙ্গে হবে হল সংসদ এর কমিটি। তিনি অপশক্তির বিরুদ্ধে সকল ছাত্রলীগকর্মীকে এক হয়ে কাজ করারও আহ্বান জানান।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন