মো. আবদুর রহিম: পৃথিবীতে মানুষ হল আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। মানুষই পৃথিবীকে সাজিয়েছে। মানুষ সৃজনশীল। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মানুষ উল্লসিত হয়, বেঁচে থাকার উৎসাহ পায়, সৃষ্টির সাথে মানুষ সম্পর্ক গভীর হয়। চট্টগ্রামের রাউজানের কৃতি মানুষ ইউসুফ চৌধুরী ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল মনমানসিকতায় গড়ে উঠে। তিনি পরিকল্পনা নিজের মধ্যে করে নিজে গড়ে তুলেন এবং গড়ার মধ্যেই তিনি বেঁচে ছিলেন। তার সৃষ্টি নিউজ ফ্রন্ট, সিগনেট প্রেস, দৈনিক পূর্বকোণ, সিগনেট বক্স, ডেইরি ফার্ম ও ভেটেরিনারী বিশ্ববিদ্যালয়। আমার দেখা কৃর্তিমানদের মধ্যে ইউসুফ চৌধুরী ব্যতিক্রম ও বিরল মানুষ। তিনি সৃজনশীলতা ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনন্য প্রেরণার উৎস। মরহুম ইউসুফ চৌধুরী ছাত্র জীবন থেকেই উদ্যোমী সৎ, পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ের নিদর্শন।
আমার জানা মতে, ইউসুফ চৌধুরীর তিন ভাই ও এক বোন ছিল। চট্টগ্রামের রাউজান ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সৃষ্টি এক জনপদ। এক জনপদের কৃতি সন্তান ইউসুফ চৌধুরী। ১৯৩৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দাওয়াত করে রাউজানে নিয়ে আসা হয়।
জানা দরকার যে, ইউসুফ চৌধুরী ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাউজানের ঢেউয়া হাজিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যে গ্রামের ধূলা মাটি-প্রকৃতি প্রভা আকর্ষণ থেকেই নিজ গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামকে নিজ বাড়িতে দেখেন। সে সময় দুই দিনের এক যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢেউয়া হাজিপাড়া গ্রামের বিলে। তখন ইউসুফ চৌধুরীর বয়স ১২ বছর। এ সম্মেলন আয়োজনে তৎকালীন স্কুল শিক্ষক আহমদ চৌধুরীর সাথে কলকাতার কানেকশন থেকে তারই সহযোগিতায় কাজী নজরুল ইসলাম রাউজানে আসার সুযোগ পান এবং যুব সম্মেলন সফলতা পায়। কাজী নজরুল ইসলাম ইউসুফ চৌধুরীদের বাড়ির কাচারি ঘরেই তিন দিন থাকেন। কাজী নজরুল রাউজানে ইউসুফ চৌধুরীর বাড়িতেই তার অমর কবিতা ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ লিখেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমনকে কেন্দ্র করে ইউসুফ চৌধুরী শিশু-কিশোর সময় থেকে ব্যবসায় নিজেকে জড়িত করার চেষ্টা করেন। জীবনের প্রথম ব্যবসায় শুরু ‘চা’ বিক্রির ছোট দোকান দিযে, পরে হেঁটে হেঁটে পা বিক্রী করেন। নজরুল চলে যাওয়ার পরও ইউসুফ চৌধুরী ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর রাউজান গুণীদের আড্ডা ও পত্রিকা পড়া চলতে থাকে। পরে তিনি প্রকাশনা অর্থাৎ প্রেস স্থাপন করেন। নগরীর তামাকুমন্ডী লেনে ‘সিগনেট প্রেস’ স্থাপন করে কাজ শুরু করেন। এ কাজে ইউসুফ চৌধুরীর স্ত্রী জোহরা খাতুনও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তখন সম্ভবত ১৯৫৪ সাল। পরে এ সিগনেট প্রেস আধুনিকতার ছোঁয়ায় উন্নতি করেন ইউসুফ চৌধুরী। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম বহতল বিপনী বিতান গড়ে উঠে। ইউসুফ চৌধুরী তার ‘নিউজ ফ্রন্ট’ নিয়ে যান নতুন নিউমার্কেটে। ধীরে ধীরে এ বইয়ের দোকানে পাঠকের ভিড় বাড়তে থাকে। পত্রিকার বিক্রির নেশা থেকে ইউসুফ চৌধুরী পত্রিকার প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার চিন্তার নতুন সৃষ্টি আধুনিক পত্রিকা ‘দৈনিক পূর্বকোণ’। ১৯৮৬ সালে এ পত্রিকাটি তিনি প্রকাশ করেন। দৈনিক পূর্বকোণই প্রথম পত্রিকা সম্পূর্ণভাবে ফটো অফসেটে ছাপা শুরু হয়। তবে জানা যায়, ইউসুফ চৌধুরী পূর্বকোণ প্রকাশের পূর্বে সত্তরের দশকে ‘প্রভাতী’ নামে একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়েছিলেন এবং ‘দোলনা ডাইজেস্ট’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করতেন। দৈনিক পূর্বকোণের পর তিনি চট্টগ্রামের মানুষদের পুষ্টির যোগান দিতে শুরু করেন ‘ডেইরি ও পোল্ট্রি’ আন্দোলন। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি ও এ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান করেন। তার সুপার ডেইরি চাহিদা পুরনে সফল হলেন। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হল ভেটেরিনারি ও এ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউসুফ চৌধুরী একজন চট্টলদরদী মানুষ ছিলেন। ১৯৯২ সাল থেকেই ডেইরি ও পোল্ট্রি শিল্পের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আমৃত্যু তিনি এ এসোসিয়েশেনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৩ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমনস্থল তার নিজ বাড়িতে কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা, নজরুল মেলা এবং নজরুল পাঠাগারও স্থাপন করেন। মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সংবাদপত্র শিল্পের জন্য আধুনিকতার যে পথরেখা এঁকে দিয়ে গেছেন, সে পথ ধরেই সংবাদপত্র শিল্প এগিয়ে চলছে। আধুনিক সংবাদপত্র শিল্পের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি যুগপরম্পরায় স্মরণীয় চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। এ গুণী ব্যক্তি চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনে অনন্য ভূমিকার জন্যও জনপদের মানুষদের কান্ডারী হয়ে জনহৃদয়ে থাকবেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে। ইউসুফ চৌধুরী একজন দেশব্রতী মানুষ হিসেবে নানাভাবে জনগনের কল্যাণ সাধন করে অমর হয়ে আছেন। দেশ কল্যাণে জীবন সংগ্রামে এ সাহসী মানুষটি প্রজন্ম পরম্পরায় অনির্বাণ আলোক শিখার ন্যায় দেদীপ্যমান হয়ে থাকবেন চিরকাল। তার ১৩তম মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা স্মৃতি পরিষদ
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন