মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

শিরোনাম

চল্লিশ দশকের মহাকবি ফররুখ আহমদের  ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা

মঙ্গলবার, অক্টোবর ২২, ২০২৪

প্রিন্ট করুন

এ কে এম রেজাউল করিম

কবি ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা “রাত্রি” ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায় (শ্রাবণ-১৩৪৪ সংখ্যায়) প্রকাশিত হওয়ার পরপরই কবি আজীবন ছিলেন সৃজনশীল।

ঐ বছরই কবির একগুচ্ছ কবিতা বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনায় ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। বলতে গেলে ১৯৪৪ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশ হওয়ার পর সমালোচকরা তাকে স্বীকার করে নিলেন একজন প্রতিভাবান কবি হিসেবে। এ যেন এলেন, দেখলেন, জয় করলেন- সেই সঙ্গে হৃদয়েও গেঁথে গেলেন।

এই সালেই অকাল প্রয়াত প্রতিভাবান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত “আকাল” সংকলনে ফররুখ আহমদের বিখ্যাত “লাশ” কবিতাটিকে স্থান দেন।।

সেই কারণে আমরা স্বভাবত দেখতে পাচ্ছি ফররুখ আহমদের কবি জীবন দু’টি ভাগে বিভক্ত। কোলকাতা জীবনে তার কবিতা ডান-বাম উভয় গোষ্ঠীর পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ঢাকাতেই পাড়ি জমালেন। এখানেই কাটালেন আজীবন।

অনেকে মনে করেন কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন কেবল মাত্র একজন কবি। তথ্য হিসেবে এটি মোটেও ঠিক নয়। তিনি ছিলেন গীতিকার, (যার বহু গান ফেরদৌসি রহমান-সহ অনেক ভালো ভালো গায়ক গেয়েছেন) কাব্য নাটক, গদ্য নাটক-রচিয়তা (যার নাটকে মুনীর চৌধুরীর মত নাট্যকার অভিনয় করেছেন)।

তিনি একমাত্র কবি সমকালীন পাকিস্তানী সরকার প্রদত্ত “সিতারা-ই ইমতিয়াজ(১৯৬৬)” খেতাব প্রত্যাখ্যান করে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন। সত্যি বলতে কি এই রকম চরমতম আদর্শবাদী কবি- আমাদের সাহিত্যে আর একটিও নেই, ভবিষ্যতে পাবো কিনা বলতে পারিনা। তবে এখন নেই- এটা হলপ করে বলতে পারা যায়।

এহেন শক্তিমান কবিকেও চাকরির ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পরবর্তী কালে বিপর্যয়ের মুখোমুখী হতে হয়েছিল। যারা পাকিস্তান আমলে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারাই হয়ে গেলেন তীব্র বিরোধী।

কবির কি অপরাধ ছিলো এখনো আমরা জানতে পারিনি। তবে একটা অপরাধ ছিলো অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের সাথে তিনি যৌবনের শুরুতেই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকা-ে অংশ নিয়েছিলেন এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি।

তবুও আহমদ শরীফের ও শওকত ওসমানের ডায়রিতে ফররুখ আহমদের নিন্দাবাদ পেয়েছি। একসময় চাকরি থেকেও বরখাস্ত হয়েছেন। তবে এসব অন্যায়ের চরমতম উত্তর দিয়েছিলেন জাগ্রত বিবেকের বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা তীব্র তীক্ষ্ম প্রতিবেদনে। যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘গণকণ্ঠ’ ১ লা আষাঢ় ১৩৮০ সংখ্যায়।

তিনি জানিয়ে দিলেন- ইকবাল আর মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর উপর “সঞ্চয়িতা’র মত গাদাগাদা কবিতা লিখে সুফিয়া কামাল যদি সরকারী দলের প্রতিনিধি হিসেবে মস্কো সফরে যেতে পারেন, তাহলে ফররুখ আহমদের দোষ কোথায়?

এই প্রতিবেদনে কাজ হলেও কবি ফিরে পেলেন না তার আনন্দের আসল জায়গা। হারালেন বেতারের নিজস্ব শিল্পীর মর্যাদাশীল পদটা। তবে এরপর কবি আর বেশি দিন আমাদের এই হিংসার ধরাধামে ছিলেন না। পাড়ি দিলেন তাঁর বিশ্বাসের শেষ ডেরাতে -১৯৭৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ঠিক সন্ধ্যে বেলায়।

আমার ব্যক্তিগত পর্যালোচনায় দেখেছি তিনি জীবিতকালীন যেমন ছিলেন অসামান্য সৃজনশীল, আলোচিত হওয়ার পর পাশাপাশি সমালোচিত মৃত্যুর পর শুরু হলো আবার আলোচনার পালা, বিশেষত আবদুল মান্নান সৈয়দের অসামান্য সম্পাদনায় ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বের হওয়ার পর।

তবে এটা ঠিক যে ফররুখ আহমদের জামানার সাহিত্যিক পরিবেশ এখন আর নেই। বলতে গেলে এখন সাহিত্যিকদের মধ্যে চলছে অহেতুক সাহিত্য বিবর্জিত অসুয়া জনিত বিদ্বেষের প্রতিযোগিতা। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি পায় দলীয় আদর্শের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে।

বাম গোষ্ঠীর কিছু অংশ এখনো মনে করেন, ফররুখ আহমদ হলেন মক্কা-মদীনার সৌরভে আমোদিত কবি। এও অভিযোগ করা হয় তাঁর কবিতায় দেশজনতার প্রভাব নেই বললেই চলে।

আমি এই রকম আলোচনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতিমান বাংলার অধ্যাপকের লেখায় দেখতে পেয়েছি। তাদের ধারার পত্র-পত্রিকায় ফররুখ বিষয়ে কোন সৃজনশীল লেখা প্রকাশ পায় না। বিষয়টা এই রকম তাকে স্মরণ করার কাজ যেন মুষ্ঠিমেয় ঐতিহ্যবাদীদের।

তবুও ফররুখের সৌভাগ্য যে, ইসলামপন্থী কবি সাহিত্যিকদের লেখা পাঠ্য তালিকা থেকে তাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে; তাতে ফররুখ আহমদ বেঁচে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ফররুখ আহমদকে তাড়ানো যাচ্ছেনা।

বলা বাহুল্য ঃ এখানেই ফররুখ আহমদের কবিতার অসামান্যতা এবং আমাদের কবিতার গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছেন যাকে উৎপাটন করা অসাধ্য মনে হচ্ছে। হয়তো এই কারণে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতন বিরুদ্ধবাদী তাকে যথার্থ আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অপরাজেয়’ বলে। যদিও এই মতামত প্রয়াত হুমায়ূন আজাদের মোটেও পছন্দ হয়নি।

কবিকে মূল্যায়ন করার অন্যতম হাতিয়ার হলো তার রচনাকর্ম সহজলভ্য হওয়া। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ফররুখ আহমদের বেলায় সেটি হচ্ছেনা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনাবলি এখন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রকাশিত হওয়ার কারণে নজরুল চর্চার পরিধি আগের তুলনায় বাড়ছে।

যাই হোক, এবার আমাদের আলোচনার আসল প্রসংগে আসা যাক। বাংলা একাডেমির কাছে ফররুখ শতবর্ষ পালন উপলক্ষে যে প্রত্যাশা আমাদের থেকে যাচ্ছে সেটাই জানানো দরকার। বাংলা কবিতার পাঠক মাত্রই জানেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মহতি আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি আজকের বাংলা একাডেমিকে। যদিও তখন সেই নাম ছিলো কেন্দ্রীয় বাংলা-উন্নয়ন-বোর্ড।

কবি ফররুখ আহমদ চিরকালই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থক ছিলেন। আমরা প্রয়াত এই মহৎ কবির কাছে থেকে যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ পেয়েছি তার একটি বাংলা ভাষা বিষয়ে, যার শিরোনামই হলো “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য”। তিনি সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন- “আমি আগেই বলেছি যে, বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সাংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।”

আর এই ভাবে ফররুখ আহমদ হয়ে যান ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির একজন সৈনিক। এটা হয়তো অনেকেই জানেনা যে, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিকের শাহাদাতের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার বাহিরে প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনি তুলেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বেতারের শিল্পীরা; তাদের অন্যতম ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। এই মহতি প্রতিষ্ঠানের সাথে ফররুখ আহমদের আজীবন সুসম্পর্ক ছিলো।

১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমির উদযাপিত নাট্য সপ্তাহে “নৌফেল ও হাতেম” নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিলো, তিনি এই সালেই প্রতিষ্ঠানের ফেলো নির্বাচিত হন। কিন্তু সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল ঐ বছরেই। কবিতাই প্রথম বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনায়।

অনেকের ধারণা ছিলো কবি জসীমউদ্দীন এই পুরস্কার পাচ্ছেন, কারণ তখন তিনি প্রবীণ কবিদের অন্যতম। তিনি পুরস্কার না পাওয়াতে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ার উত্তরে বাংলা একাডেমি কতৃপক্ষ বলেছিলো তিনিতো পুরষ্কারের উর্ধ্বে। তবে এটা জসীমউদ্দীনকে আহত করেছিলো। এই কারণে তাঁর রচনাবলি প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুমতি দেননি।

পরবর্তীকালে অনেক বই তাঁর বড় ছেলের প্রতিষ্ঠিত ‘পলাশ প্রকাশনী’ থেকে বের হয়েছে। কবি ফররুখ আহমদের অন্যতম সৃষ্টি ‘হাতেম তাই’ প্রকাশ করেছিলো বাংলা একাডেমি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে বাংলা একাডেমির জন্মলগ্ন থেকেই ফররুখ আহমদ জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই স্বভাবতই ফররুখ আহমদের জন্ম শতবার্ষিকীতে এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে আমাদের কিছু বিশেষ প্রত্যাশা থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কোন তৎপরতা এ যাবৎ আমরা লক্ষ্য করিনি। এর আগে বাংলা একাডেমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বসুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে চমৎকার দু’টি সংখ্যা বের করেছিলো। এ দুজনেই বাংলা সাহিত্যের অমর ব্যক্তি নিঃসন্দেহে; পাশাপাশি ফররুখ আহমদও তার যোগ্যতা বলে সেই রকমই দাবীদার হয়ে যান।

ফররুখ আহমদের সৃজনশীলতার উপর অনেক ভালো ভালো সমালোচক তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। সেগুলো এক করা দরকার। ফররুখ আহমদের বেশ কিছু কবিতা ‘কবিতা’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিলো সে গুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে করে ভবিষ্যতে যারা কবির উপর গবেষণা করতে আগ্রহী হবেন, তাদের পক্ষে ভালো সুযোগ সৃষ্টি হবে। উন্নততর দেশগুলোতে এই রকম সংরক্ষণাগার অহরহ চোখে পড়ে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই রকম কিছু পদক্ষেপ এ যাবৎ শুধু বাংলা একাডেমি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাড়া- অন্য কোন প্রতিষ্ঠান নেয়নি। যারা নিয়েছেন তাঁদেরও নিরপেক্ষতার অভাব রয়েছে। বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় এর আগে ফররুখের কাব্যগ্রন্থ, অনুবাদ, কবিতা ও প্রবন্ধ সমন্বয়ে একটি রচনাবলি বের হয়েছিলো। যার সম্পাদনায় ছিলেন ফররুখ অনুরাগী দুই কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ও প্রয়াত আবদুল মান্নান সৈয়দ।

এই গ্রন্থ প্রকাশের অনেক পরে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সুদক্ষ সম্পাদনায় দুই খ- রচনাবলি বের করে বাংলা একাডেমি। যথাক্রমে আগস্ট ১৪০২/ জুন ১৯৯ ও আগস্ট ১৪০৩/জুন ১৯৯৬ সালে। বাংলা একাডেমির এই মহৎ কাজে আমরা ফররুখ অনুরাগীরা স্বভাবতই বাংলা একাডেমির কাছে ঋণী থাকতে বাধ্য। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে- পরবর্তী খ-গুলো প্রকাশের মুখ আর দেখেনি।

ইতোমধ্যে রচনাবলির সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তার মত অনুসন্ধানী সম্পাদককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির ঘাড়ে পড়েছে। বাংলা একাডেমি সেই মহৎ কাজে এগিয়ে যাবেন আশা করা যায়। অন্যান্য প্রকাশকরা যখন কবির ভাষায় :-

বিকায়ে নিজের সত্ত্বা যে ভোলে জাতীয় তমুদ্দনহবে না কি তার দলে ধার করা কদলী-বেগুন।

(হালকা লেখা: ফররুখ আহমদ)

কবি তাঁর সব সৃজনশীল কর্মকাণ্ড আমাদের হাতে সমর্পণ করে এখন মূল্যায়নের আশায় বসে আছেন। এ যেন একজন মহৎ কবির নিরন্তর অপেক্ষা। প্রত্যেক মহৎ কবি তাই করে থাকেন। ফররুখ আহমদই তার ব্যতিক্রম হবেন কেন?

লক্ষণীয় বিষয় এই, ফররুখ আহমদ বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যে অসাধারণ জননন্দিত কবি হলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁর ওপর গবেষণা কর্মের সংখ্যা হাতেগোনা। এমনকি শুনতে পাই, এই কবির কবিতা পড়ানো ও বোঝানোর মতো দক্ষ শিক্ষকও নেই।

আমি প্রায়ই কৌতূহল বশবর্তী হয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, কোন শিক্ষক ফররুখ আহমদ পড়ান? তারপর যে উত্তর পাই তাতে করে হাসি চেপে রাখার উপায় থাকে না। আমার এই মন্তব্য শুনে অনেকের মনে হতে পারে, আমি হয়তো সমালোচনার জন্য এ অযাচিত প্রসঙ্গগুলো উল্লেখ করলাম।

আসলে তা নয়। আমরা ফররুখ আহমদের কবিতা আলোচনা করার সময় কিছুটা হলেও তাঁকে সরলীকরণ করে ফেলেছি। সেটা কেমন? আমি প্রায়ই সভা-সমিতিতে শুনতাম- ‘তিনি রেনেসাঁর কবি!’ কারণ তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের জাগরণ কামনা করেছিলেন।

পরবর্তীকালে ফররুখ আহমদের কবিতা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর বুঝলাম ব্যাপারটা সেইরকম নয়। তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণকামী অধিকারের সমর্থনকারী কবি। কারণ তিনি ইংরেজদের হাতে বন্দী মুসলমানের দুঃখ নিরসন করার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী একটি সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতায় বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ কারণে সমসাময়িক অন্যান্য মুসলমান কবির মতো পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে তিনিও জড়িয়ে গিয়েছিলেন।

একটি উদাহরণ দেয়া যাক- তাঁর সমকালীন অন্য একজন বামধারার কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক কাব্য সঙ্কলনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি কবিতাও রচনা করেননি। বরং দেখা গেল, জাপান যে চীনের উপর আক্রমণ করেছে, সেই চিন্তা তাকে বিভোর করেছে; সুযোগ পেলেই মহাত্মা গান্ধীকে ব্যঙ্গ করেছেন, পাশাপাশি কংগ্রেসি রাজনীতিকে উড়িয়ে দিয়েছেন এই বলে-

দুর্ঘটনার সম্ভবনাকে বাঁধবে না কেউ।
ফসলের এই পাকা বুকে আহা বন্যার ঢেউ
দস্যুর স্রোত বাঁধবার আগে সংহতি চাই
জাপ পুস্পর্কে জ্বলে ক্যানটন, জ্বলে সাংহাই।
(চীন-১৯৩৮, পদাতিক)

তার মানে এই তখনকার দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা সংগ্রাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তেমন কোনোভাবে স্পর্শই করেনি। যদিও সেই সময় ব্যক্তিবাদী কবি জীবনানন্দ দাশ বামপন্থীদের ক্রমাগত আক্রমণের তোড়ে অনেকখানি জনগণের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু তাঁর দীপ্র মননশীলতায় সেটা সাধারণ পাঠকদের পক্ষে বোঝা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই তুলনায় ফররুখ আহমদ তাঁর কবিতায় অনেকখানি সপ্রতিভ- আবেগমথিত কলস্বর- যা আজো আমাদের মানবিক চেতনাকে আঘাত করে বসে। যেমন

এ নয় জোছনা-নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর
এ নয় পরীর দেশের ঝরকা নারঙ্গী বন্দর।
এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার
ক্ষুধিত শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।
আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙ্গা মাস্তুল দেখা দিক করতালি-
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।
(সাত সাগরের মাঝি)

ফররুখ আহমদকে আমরা আজো কেনো স্মরণযোগ্য কবি বলে মনে করছি? একজন প্রখ্যাত সমালোচক একবার বলেছিলেন, পঞ্চাশ বছর পর একজন কবি যদি পাঠকহৃদয় আন্দোলিত করতে পারেন, তা হলেই তিনি বড় কবি। সেই অর্থে তিনি অবশ্যই বড় কবি। কোনো কোনো তরুণ কবি আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে বসেন- কেনো তিনি এখনো স্মরণযোগ্য পর্যায়ে পড়েন?

তাদের প্রশ্নের উত্তর বলছি সূত্রাকারে-

ফররুখ আহমদ ছিলেন সেই ধরনের প্রতিভাবান কবি, যিনি অল্প সময়ের মধ্যে অনুকারকের দল তৈরি করার ক্ষমতা রাখতেন। অন্তত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাত সাগরের মাঝি মনোযোগসহকারে পড়লেই বোঝা যায়। এত স্মরণযোগ্য পঙক্তি তৈরি আসলে ওই দশকে কোনো কবি সৃজন করতে পারেননি। তিনি অনেক ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রজ কবিদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেই কারণে পঞ্চাশের দশকে তরুণ কবিদের কাছে জীবনানন্দ দাশের পরে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী কবি।

হুমায়ুন আজাদের মতো বামধারার কবি-সমালোচক স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, কবি শামসুর রাহমানের প্রাথমিক জীবনে কবি ফররুখ আহমদের প্রভাব ছিল। কবি শামসুর রাহমান তাঁর জীবনের প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ফররুখ আহমদের ওপর, যা তৎকালীন দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার ‘সাহিত্য পাতায়’ প্রকাশিত হয়েছিল।

ফররুখ আহমদ আপাদমস্তক ছিলেন একজন সৃজনশীল কবি, কিন্তু সারা জীবনের কাব্যসাধনায় কেবল কবিতা সৃজনেই দিনাতিপাত করেছেন এমনও নয়। তিনি অনুবাদ করেছেন মহাকাব্যধর্মী রচনাসহ (যা এখনো অনালোচিত থেকেই গেছে), নাটকও লিখেছেন, রয়েছে কাব্যনাটক ও ছোটগল্প।

প্রত্যেকটি রচনায় দেখা গেছে, পরিবেশ সৃজনে যে কাব্যভাষা ব্যবহার করেছেন তা ছিল যথাযথ। তবে তাঁর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে সমালোচকরা যে অভিযোগ তুলেছিলেন তারও খানিকটা সত্যতা আছে।

তবে তা কতখানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল তা-ও নিষ্পন্ন হয়নি। কারণ ফররুখ আহমদ আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগ ছাড়াও অনেক কবিতা সৃজন করেছেন। সেটা আমরা লক্ষ করি না। যেমন ধরা যাক এই সনেট কবিতা

আমার হৃদয় স্তব্ধ, বোবা হয়ে আছে বেদনায়
যেমন পদ্মের কুঁড়ি নিরুত্তর থাকে হিম রাতে,
যেমন নিঃসঙ্গ পাখী একা আর ফেরে না বাসাতে
তেমনি আমার মন মুক্তি আর খোঁজে না কথায়।
যখন সকল সুর থেমে যায়, তারারা হারায়,
নিভে যায় অনুভূতি-আঘাতে, কঠিন প্রতিঘাতে;
নিস্পন্দ নিঃসাড় হয়ে থাকে পাখী, পায় না পাখাতে
সমুদ্র পারের ঝড় ক্ষিপ্রগতি নিশান্ত হাওয়ায়…
মুখ গুঁজে পড়ে আছে সে পাখীর মতো এ হৃদয়
রক্তক্ষরা। ভারগ্রস্ত এ জীবন আজ ফিরে চায়
প্রাণের মূর্ছনা আর নবতর সৃষ্টির বিস্ময়,
উদ্দাম অবাধ গতি, বজ্রবেগ প্রমুক্ত হাওয়ায়;
অথচ এখানে এই মৃত্যু-স্তব্ধ রাত্রির ছায়ায়
রুদ্ধ আবেষ্টনে আজ লুপ্ত হয় প্রাণের সঞ্চয়।

ফররুখ আহমদের অসামান্য এই সনেট কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কবি কায়সুল হক সম্পাদিত অধুনায় বাংলা ১৩৬২ সালে। উল্লেখ্য এই সঙ্কলনে জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, আবুল হোসেন, আহসান হাবীবের কবিতাও প্রকাশিত হয়েছিল। এই কবিতায় কি চেনা যাচ্ছে আমাদের বহুল-আলোচিত চেনা ফররুখ আহমদকে?

এই কবিতায় একটি পঙক্তিতেও আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ নেই। বলা বাহুল্য, এটা আমরা খেয়াল করি না যে, ফররুখ আহমদ বড় কবি বলেই দুই রীতিতে কবিতা সৃজনের দক্ষতা দেখিয়েছেন। তবে আবার এটাও স্বীকার করা ভালো যে, আদর্শ ও পরিবেশকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, সে ক্ষেত্রে সব সময় শব্দ প্রয়োগে সফল হয়েছেন তাও বলা যায় না।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তরুণরা কিভাবে উপকৃত হবে ফররুখ আহমদ পাঠে। ফররুখ আহমদ জানিয়ে গেলেন, কবিতা লিখতে গেলে জানতে হয় কবিতার প্রকরণশৈলী। তিনি তাঁর কবিতাকে ছন্দময় করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য ছন্দে প্রখর জ্ঞান দরকার, তার পুরোটাই ফররুখ আহমদের ছিল।

অথচ চল্লিশের দশকে তাঁর উত্থান হলেও গদ্যছন্দের দিকে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। তাঁর প্রথম কবিতাই সনেট, আর শেষ কবিতাও ছিল সনেট। অনুজ কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল সঠিকই লক্ষ করেছিলেন কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে বসবাসের পর থেকেই তিনি রোমান্টিকতার দিক বদলে ক্লাসিকতার দিকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়েছেন।

এ সময় তার প্রিয় কবি ছিলেন ইকবাল, এলিয়ট ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর এলিয়ট থেকেই পেয়েছিলেন ঐতিহ্য চেতনার ব্যবহার, তিনি এ-ও বিশ্বাস করতে ঐতিহ্য চেতনা ছাড়া কবিতা শক্তিশালী হয় না। তিনি এলিয়টকে নিবিড়ভাবে পাঠ করেছিলেন।

সে কারণে দেখা যায়, সমালোচক ও নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদের একটি জীবনানন্দ দাশকেন্দ্রিক সমালোচনা পড়ে তাকে এলিয়ট পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে, এলিয়টের কাব্যপ্রক্রিয়াকে তিনি অশান্ত মনে করতেন, সে জন্য ইসলামের দিকেই ধাবিত হয়ে শান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সামাজিক বৈষম্য তাকে ক্রমান্বয়ে ক্ষুব্ধ করেছিল। তিনি বিশ্বাসের উপর দীপ্রভাবে ভর করে কর্মসাধনা করে গেছেন। কবিতার সৃজনশীলতা দিয়েই বিপরীত আদর্শের অনুসারীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাবোধ আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরকম দ্বিতীয় উদাহরণ বাংলাদেশে আর একটিও নেই।

এখনকার অনেক তরুণ কবি এই বিশ্বাসী কবিকে গ্রহণ করার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। কারণটাও স্বাভাবিক, সেটা হলো- আমাদের সৃজনশক্তিমত্তা ও চিন্তাশীলতার দারুণ অভাব। আমাদের কবিতার বিবর্ণতার মূল কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। যার ফলে কবিতা ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত হচ্ছে আজগুবি দুর্বোধ্যতার জটাজালে। কারণ তরুণ কবির সামনে নেই কোনো বিশ্বাসের দীপ্র প্রান্তর। থরোথরো তামসি মন নিয়ে মহৎ কবিতা সৃজন করা অসম্ভব।

আর তাই ফররুখ আহমদের কবিতার কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হবে। সেই বিশ্বাসের কথা ফররুখ আহমদ অনেক আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর একটি কবিতায়-

আর একবার তুমি খুলে দাও ঝরোকা তোমার,
আসুক তারার আলো চিন্তার জটিল উর্নাজালে,
যে মন বিক্ষত, আজ জাগ্রত তোমার ছন্দ তালে
এখানে সমস্যাকীর্ণ এ জগতে এসো একবার।
(কবিতার প্রতি : মুহূর্তের কবিতা)

আমাদের প্রস্তাবনা সমূহ-

ফররুখ আহমদকে ব্যাপক আলোচনার আওতায় আনতে গেলে ফররুখ রচনাসমগ্র অচিরেই প্রকাশ করা দরকার। একসময় কবি ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ড রচনাবলি প্রকাশিত হওয়ার পর বাকি খণ্ড কবে প্রকাশ হবে তা বলা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি পুনঃপ্রকাশিত হওয়া দরকার আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’।

অনেক দিন যাবৎ অপ্রকাশের ধূসর জগতে অবস্থান করছে এই গ্রন্থটি। এ ব্যাপারে যথাশীঘ্র সম্ভব পদক্ষেপ নেয়া দরকার। আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রকাশক হলেন মাড়োয়ারি জাতের ব্যবসায়ী। কেবল লাভের দিকে তাকিয়ে বই প্রকাশ করে থাকেন। শতবর্ষ উপলক্ষে একটি স্মারকগ্রন্থ বের করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার। নতুন আলোচনার পাশাপাশি পুরনো ক্লাসিক আলোচনাগুলো নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সম্পাদনায় প্রকাশ করলে এখনকার পাঠক ও তরুণ কবিরা ফররুখকে বেশি করে জানার সুযোগ পাবেন।

বর্তমানে ফররুখকেন্দ্রিক চর্চা তরুণদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে কমে আসার প্রবণতা লক্ষ করছি। এর কারণও রয়েছে। ফররুখ আহমদ ছিলেন আপাদমস্তক ক্লাসিক ধাঁচের কবি, পাশাপাশি তরুণরা ইদানীং তথাকথিত মুক্তছন্দে কবিতা সৃজনের দিকে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সেই দিক থেকে স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের বিরোধ থেকেই যাচ্ছে।

এ কথা আমাদের স্বীকার করা ভালো যে, ফররুখ আহমদ ছিলেন গদ্যছন্দের বিরোধী, কবি আবুল হোসেনের গদ্যছন্দকে ‘কোলকাতার চটকদারী ছন্দ’ বলে অ্যাখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেননি। যদিও তাঁর সমসাময়িক কবিবন্ধু সৈয়দ আলী আহসান এই মতামতের বিরোধিতা করেছেন। ফররুখ আহমদের ক্লাসিকপ্রীতি ও আদর্শবাদিতা আমাদের কালের তরুণরা গ্রহণ করছেন কি না তাও আমাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।

আবার ফররুখের কবিতার মাহাত্ম্য বাড়ানো যাবে না। কারণ এখানে কবির কবিতার চেয়ে কবির জীবনধারাকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা কাজ করে।

অথচ অনেক আগেই টি এস এলিয়ট স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই বলে-
‘সৎ সমালোচনা ও সংবেদনশীল মূল্যায়ন হয় কবি নয়, কবিতাকে কেন্দ্র করে। আমরা যদি সংবাদপত্রের সমালোচকদের দ্বিধান্বিত মূল্যায়ন এবং পুনরাবৃত্ত জনপ্রিয় ধারার হইচই শুনি, তা হলে আমরা অনেক কবির নাম শুনতে পাব। কেতাবি জ্ঞানের মুখাপেক্ষী না হয়ে আমাদের কবিতা থেকে আনন্দ খুঁজতে হবে।’

আমি আগেই জানিয়েছি, ফররুখ আহমদ এলিয়ট ভক্তদের একজন। কিন্তু এলিয়টের কাব্যপ্রক্রিয়াকে তিনি অশান্ত মনে করতেন, তথাপি তিনি তাঁর সমালোচনার রীতির পক্ষপাতী ছিলেন। তাই নতুন করে ফররুখ আহমদকে আবিষ্কার করতে হলে তুলনামূলক সমালোচনার বড় দরকার। ফররুখ আহমদ এটাই চাইতেন। সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই।

কারণ তিনি ছিলেন শিক্ষিত মেধাবী কবি। ইংরেজি সাহিত্য মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছিলেন। বিশেষ করে ইংরেজ কবি জন কিটস-এর কবিতা। তার প্রভাব সুবিখ্যাত ‘ডাহুক’ কবিতায় পাওয়া যায়।

ফররুখ আহমদ: একজন প্রকৃত মানবতার কবি
কবি-সাহিত্যিকরা তাঁদের গভীর চিন্তাকে পাঠকদের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেন। কবিতা বড়োদের যেমন আকর্ষণ করে ঠিক তেমনি ছোটদেরও আনন্দিত করে। বিশেষ করে ছড়া।

পৃথিবীর সকল কবিগণই তাই তো ছোটদের জন্য আলাদাভাবে কবিতা ও ছড়া লিখে গেছেন এবং এখনও লিখছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ বাংলা ভাষায় প্রায় সবাই শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন অসংখ্য ছড়া।

আমাদের জাতী জাগরণের কবি হিসেবে খ্যাত ফররুখ আহমদও শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন অনেক মজাদার ও শিক্ষণীয় ছড়া।

কবিকে অনেকেই ‘ইসলামী রেঁনেসার কবি’ বলে থাকেন। আসলে তিনি শুধুমাত্র ইসলামী রেঁনেসার কবি নন, বরং তিনি একজন প্রকৃত মানবতার কবি। তিনি অনেক বড়ো কবি। তাঁর মতো কবিদের খন্ডিত করা উচিত না। কারণ প্রকৃত অর্থে সকল মানুষের জন্যেই তিনি কবিতা লিখেছেন।

শিশু-কিশোরদের জন্য ফররুখ আহমদ প্রচুর ছড়া-কবিতা লিখেছেন। তিনি শুধূই শিশু-কিশোরদের উপযোগী লেখা লিখে ক্লান্ত হননি, লিখেছেন এক্কেবারে সোনামণিদের জন্যেও। তাঁর ‘হরফের ছড়া’ গ্রন্থটি এরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আসলে ফররুখ আহমদের কোন তুলনা হয় না। এ জন্যে কেউ তাঁকে সহজে ভুলতে পারে না। আর ভুলে থাকা কী সম্ভব? ধরা যাক একসময় তাঁকে আমরা ভুলেই গেলাম। অমনি শুরু হলো বৃষ্টি! ঠিক তখনই হৃদয়ে দোলা দিয়ে উঠবে তাঁর সেই বিখ্যাত ছড়াটিঃ

‌বিষটি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাস বনে
বকের সারি কোথারে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকলো দূরে দেয়া যে,
কোন্ সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে!

প্রিয় কবি ফররুখ একজন রোমান্টিক কবিও বটে! শিশু-কিশোরদের তিনি দারুণ ভালবাসতেন। ভালবাসতেন সব মানুষকে। এমন কি প্রকৃতির প্রতিও ছিল তাঁর অফুরন্ত ভালবাসা। তাঁর ‘শরতের সকাল’, ‘পউষের কথা’ কিংবা ‘হৈমন্তীর সুর’ কবিতাগুলোর কোন তুলনা কী বাংলা সাহিত্যে আছে? ‘ফাল্গুনে’ শিরোনমের কবিতাটি পড়লেই আমরা তাঁর প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার কিছুটা নিদর্শন পেয়ে যাই-

‘ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী,
ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙানি,
এক ঝাঁক পাখি এসে ঐকতানে
গান গায় এক সাথে ভোর বিহানে,
আযানের সুর মেশে নীল আকাশে
শির শির করে ঘাস হিম বাতাসে,
আচানক দুনিয়াটা আজব লাগে
আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে,
লাল নয়, কালো নয়, সবুজ ছাতা
জেগে ওঠে একরাশ সবুজ পাতা,
হাই তুলে জাগে সব ফুলের কুঁড়ি
প্রজাপতি ওড়ে যেন রঙিন ঘুড়ি।’

বাংলা ভাষায় এমন কোন কবিকে খূঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যার কবিতায় পাখির কথা নেই। কিন্তু কবি ফররুখ আহমদের পাখি বিষয়ক ছড়া-কবিতাগুলোর স্বাদই অন্যরকম! পাখি নিয়ে তাঁর অনেক বিবিত্রধর্মী ছড়া-কবিতা আছে। এখানে মাত্র কয়েক লাইন তুলে ধরছিঃ

‘নদী নালার দেশে আবার আসে দূরের হাঁসগুলো,
চমকে ওঠে তাল, সুপারি, নারকেল গাছ, বাঁশগুলো।
নানান রঙের ঝিলিক দিয়ে পাখিরা সব যায় চলে,
হাজার সুরে দূর বিদেশের খবর তার যায় বলে।
পর পাখনা নাড়া দিয়ে রঙিন পাল যায় রেখে
ঝিল হাওরে, নদীর তীরে পাখিরা সব যায় ডেকে।’

কবি ফররুখ আহমদ বেশ কিছু মজাদার হাস্যরসের ছড়াও লিখেছেন। তবে সে সবের আলাদা বৈশিষ্ট হলো এই যে, তাতে শুধু হাসি আর কৌতুকই থাকে না, সেখানে থাকে জানা ও শেখার অনেক কিছু। এ ছাড়া কবির ‘সিন্দাবাদ ও বুড়োর কিসসা’, ‘দুষ্ট জ্বিনের কিসসা’, ‘হাতেম তায়ীর কিসসা’ ও ‘নৌফেল বাদশা’ প্রভৃতি দীর্ঘ কবিতাগুলো পড়লেও যেমন আনন্দিত হওয়া যায়, তেমনি অনেক কিছু শেখা যায়।

ব্যক্তি জীবনে কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী। ছাত্র জীবনে তিনি খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। ক্লাসে সবসময় প্রথম হতেন। সব সময় সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন মানবতাবাদী এই কবি। অর্থ-বিত্তের লোভ কখনোই তাঁকে লালায়িত করেনি। তাঁর যে খ্যাতি এবং পরিচিতি ছিল তা দিয়ে তিনি চাইলেই অঢেল সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তান না করে তিনি অর্থ কষ্টে দিন যাপন করেও কারো কাছে হাত পাতেননি। আমাদেরও তিনি তাঁর কবিতায় হাত না পাতারই পরামর্শ দিয়েছেন। কবি বলেছেনঃ

‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া,
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।’

আগেই বলেছি শিশু-কিশোরদের কবি ফররুখ আহমদ খুবই ভালবাসতেন। কবি তাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতেন, আদর করতেন। আর সেজন্যই তো কবি ফররুখ আহমদ ছোটদের জন্য লিখে গেছেন মজাদার এবং উপদেশমূলক অনেক বই।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন বর্তমান মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আমাদের এই প্রিয় কবি। পুলিশ ইন্সপেক্টর খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী এবং বেগম রওশন আরার দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন ফররুখ। নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু।

পরে কলকাতার তালতলা মডেল স্কুল ও বালিগাঁও হাইস্কুল এবং খুলনা জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন। শেষোক্ত স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন ও ১৯৩৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।

সেখানকার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজেও তিনি লেখাপড়া করেছেন। পরে প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজিতে অনার্স পড়তে ভর্তি হলেও কবিতার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে তিনি তা শেষ করতে পারেননি। স্কুলজীবনেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। কবি গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেমের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা তাঁর শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

ছাত্রজীবনে তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মানবতাবাদী আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়ে বামপন্থী মনোভাব পোষণ করতেন। পরবর্তীতে তিনি পুরোপুরি ইসলামী আদর্শের অনুসারী হয়ে যান।

কবি ফররুখ আহমদ ১৯৪২ সালে চাচাতো বোন সৈয়দা তাইয়্যেবা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিসে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতায় এরপর সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টেও কিছু দিন কাজ করেন।

১৯৪৫ সালে তিনি বিখ্যাত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশ বিভাগের পরপরই তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় যোগদান করেন।৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানকার স্টাফ আর্টিস্ট ছিলেন।

কবি ফররুখ আহমদ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সমর্থন দান করেন। দেশবিভাগের পরপরই তিনি মাসিক সংগাত পত্রিকার (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৪৭) সংখ্যায় ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নিবন্ধে তিনি লেখেন “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিৎ সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষ কে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪), ‘সিরাজাম মুনীরা’ (১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১), ‘মুহুর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), ‘পাখির বাসা’ (১৯৬৫), ‘হাতেম তায়ী’ (১৯৬৯) ‘হরফের ছড়া’ (১৯৭০) ‘ছড়ার আসর’ (১৯৭০) ‘হে বন্য স্বপ্নরা’ প্রভৃতি।

ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) মুসলিম রেনেসাঁসের কবি। চল্লিশের দশকের শক্তিশালী কবি প্রতিভা ফররুখ আহমদ আধুনিক বাংলা কাব্য ধারার পথ বিনির্মাণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি মুসলিম ঐতিহ্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে আরব্য উপন্যাস, ইরান ও আরবীয় সংস্কৃতিতে উল্লেখিত কাহিনীর ঐতিহ্য একদিকে যেমন ধারণ করেছেন অন্যদিকে মুসলিম অভ্যুত্থান যুগের ঐতিহ্য ও ভাবধারাও তাঁর কাব্যে ধারণ করেছেন।

তিনি জীবনের শূণ্যতাবোধকে যেমন কবিতার প্রধান উপজীব্য বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন, তেমনি মানুষের কুটিলতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থান্ধতাকে কাব্যে স্থান দিয়েছেন। ‘মানুষের সততায় হারায়েছি আমি যে বিশ্বাস’-এ উক্তি শুধু ‘হাতেমতায়ী’র নায়িকা হুসনা বানুরই নয়, আধুনিক বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর যে কোন মানুষের। তাই তাঁর কবিতা এক বিশেষ ধর্মীয় কাল পরিক্রমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর কবিতা লাভ করেছে বিশ্বজনীনতা।

ফররুখ আহমদ মুসলিম আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর কাব্যে ঐতিহ্য ও আদর্শের পারস্পর্য কি তা সহজেই বোধগম্য এবং কোন প্রেক্ষিতে এই সমন্বিত উদ্বোধন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তাতে ঐতিহ্যের স্বপ্ন যতখানি লাবণ্যে উদ্ভাসিত, জীবনের দ্বািদ্বক অবশ্যম্ভাবিতা উজ্জ্বল। জীবনধারণের সাথে আদর্শের যোগ স্থাপিত করা হয়েছে প্রতীক ও রূপক দ্যোতনার মাধ্যমে। তাই ফররুখ আহমদের প্রতীক ব্যবহার জীবন রসে নয় প্রতীকী রসে সিঞ্চিত। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিলে কথাটি পরিস্কার হবে:

“নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দাবাদ

পাকে পাকে ঘুরে-তীর বেগে ছুটে আবর্তে দিশেহারা,

ক্ষুধার ধমকে ঘাস ছিঁড়ে খেয়ে আকাশ জাগায়ে সাড়া,জালিমের চোখ আগুনে পোড়ায়ে গুড়ায়ে পাপের মাথা,

দেখেছি সবুজ দরিয়া জাজিমে স্বপ্ন রয়েছে পাতা।” (সিন্দাবাদ)

অথবা

“জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি

জাগো, অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি

দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি কত দেরি।” পাঞ্জেরী)

উদ্ধৃতগুলো এতই প্রাঞ্জল যে, কি আদর্শে উজ্জীবিত এবং ব্যবহৃত প্রতীকের আড়ালে মূল বক্তক্যটাই বা কি তা সহজেই অনুমেয়। মূলত প্রতীকের আড়ালে যে ঐতিহ্য ও আদর্শ অবিমিশ্র হয়েছে তা একটি বিশেষ কালের সীমায় আবদ্ধ থাকেনি তা হয়ে উঠেছে গতিময়।

ইসলামি ভাবধারা ও উপজীব্য বিষয় নিয়ে কবিতা লেখায় যে দৃষ্টান্ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপস্থাপন করেন কবি ফররুখ আহমদ সে ধারারই যোগ্য উত্তরসাধক। কবিতার আঙ্গিক রচনাশৈলী এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে উভয়ের মধ্যে মূলগত কিছু পার্থক্য থাকলেও কতকগুলো ক্ষেত্রে কবি ফররুখ আহমদ সার্থক স্রষ্টা। বিদেশী শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহারে তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাবলীল ও সার্থক।

আরবের মরু প্রান্তরে খেজুর গাছের আড়ালে মায়াবী চাঁদের হাতছানি, ইরান ও আরবের সংস্কৃতি ও পুরাকথা কুরআনের সত্য কাহিনী এবং আরব্য উপন্যাসের বিভিন্ন ঘটনাবলীকে তিনি শৈল্পিক কুশলতায় কাব্যিক দক্ষতায় যথার্থ রূপদান করেছেন। আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার সর্বপরি উপমা উৎপ্রেক্ষার সার্থক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কবির প্রেম, সৌন্দর্য চেতনা এবং আবেগ উল্লেখিত পরিমন্ডলের আবির্ভ‚ত নয় বরং এ সবের মধ্যে একাকার হয়ে মিশে আছে।

তাঁর কাব্য বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে আবু জাফর সামসুদ্দীন পূর্বদেশ পত্রিকায় ১৩৮১ সালের ৪ঠা কার্তিক প্রকাশিত অপরাজেয় কবি ফররুখ আহমদকে ‘জীবন শিল্পী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে ‘অন্ধকার অমানিশার মধ্যেও আলোর গান শোনার নামই যদি জীবন বন্দনা হয়, তাহলে ফররুখ আহমদ অবশ্যই ছিলেন জীবন শিল্পী।

ফররুখ আহমদ ছিলেন মানব দরদী কবি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিলো সকল মানুষই সমান। তিনি নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের দুঃখ সমব্যথী। এবং এদের গভীর মমতায় অনুভব করতেন। তাঁর এই জীবনাদর্শের প্র্রকাশের ভঙ্গিও ছিলো ভিন্নতর। তিনি নির্যাতিত মানুষের দুঃখ বেদনায় মুসলিম ঐতিহ্যকে স্মরণ করেছেন এবং সেই আদর্শকে বুকে বাধার পরামর্শ দিয়েছেন :

“নিশান আমার কি স্বপন তুমি দেখছো আজ।

নিশান আমার শীর্ণ মুঠিতে

পেতে চাও তুমি মহা নিখিল?

ক্ষুধিত মাটিতে সে নয় তাজমহল

মানুষের মাঠে বিরাণ মাটিতে

এবার ফলবে তাজা ফসল।” (নিশান)

ফররুখ আহমদের কাব্য সাধনার প্রথম পর্বে ছিলো রোমান্টিকতা, স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধের প্রাধান্য, যদিও কবিতায় স্বপ্ন ও বাস্তবের দ্ব›দ্ব একবারেই অপ্রতক্ষ ছিলো না। কবিতার ভাষা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্প ও রূপরীতিতে অনেকটা এই কবির রচনাতে ছিলো আবেগ অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এবং স্বতন্ত্র কণ্ঠের উচ্চারণ।

স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধের পাশাপাশি মানবিকতাবোধের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর প্রথম জীবনের কবিতায়। কিন্তু সীমিত সাফল্যে সন্তুষ্ট না থেকে সৃজনী প্রতিভাধর ফররুখ আহমদ কাব্যের নতুন রূপ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হন। এ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ও মহাকবি ইকবালের কবিতাই তাঁর প্রেরণার মূল উৎস হয়।

ইসলামী আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী এবং মুসলিম রেনেসাঁয় প্রত্যয়ী হওয়ার পর ফররুখ কাব্যের উপজীব্য আহরণ ও রূপরীতি নির্মাণের ক্ষেত্রে ভিন্নরীতির অন্নেষী হন। পাকিস্তান আন্দোলনের পটভ‚মিতে রেনেসাঁ আন্দোলনের সময়েই তিনি সচেতন প্রয়াসে কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্যের ব্যবহার, বিশেষ করে চলতি ভাষার পুঁথি কাব্যের নবরূপায়ণের দিকে দৃষ্টি দেন।

আরব্য উপন্যাসের কাহিনীকে প্রতীকী উপস্থাপনের মাধ্যমে ফররুখ আহমদ নতুন ব্যঞ্জনায় ও গভীর তাৎপর্য মহিমায় মূর্ত করে তোলেন।

লেখক:  সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’র প্রতিষ্ঠিতা।

Views: 2

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন