বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

জোছনার রুপকথা

শনিবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২১

প্রিন্ট করুন
bulan purnama1 1024x667 min 1

রুনা তাসমিনা

রুমকি! ঘুমোতে এসো।

মা, দেখো! কি সুন্দর জোছনা! মনেই হচ্ছেনা বাইরে লাইট নেই! আর দেখো উঠোনে কত্তগুলো জোনাকি উড়ছে? দেখতে তারার মতো লাগছেনা মা? মা চলো বাইরে যাই!

না। সারাদিন অনেক জার্নি হয়েছে। এবার ঘুমোতে চলো।

গ্রামে খুব কম আসা হয় রুমকির। তাও বাবার ব্যস্ততা না থাকলে । কিন্তু গ্রামে জোছনা দেখা এই প্রথম। শহরে নিয়নের আলোর জন্য আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায় ঠিকই কিন্তু জোছনা দেখা যায় না। দিদার কাছে গল্প শোনে জোছনা রাতে নাকি পরিরা নেমে আসে। আজ কি পরিরা নেমে আসবে? পরি দেখতে কেমন? অনেক প্রশ্ন ভিড় করে মনে। কিন্তু মা কিছু শুনতে রাজি না। পীড়াপিড়ি করছে ঘুমোতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও  সরে আসে জানালার পাশ থেকে।

খাওয়া দাওয়া শেষে দিদার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। জার্নিতে ক্লান্ত দিদা ঘুমিয়ে পড়ে একটু পরেই। কিন্তু রুমকির চোখে ঘুম নেই। মন পড়ে আছে বাইরে। চাঁদ, জোছনা, জোনাকি প্রচণ্ডভাবে তাকে টানছে বাইরের দিকে।

অন্যদিন দিদার সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ কেন জানি ঘুম আসছেনা। বাইরে এখন কি হচ্ছে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে! দিদার নাক ডাকার শব্দ কানে আসতেই আস্তে করে বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিল। আরে জোছনা আরও উজ্জ্বল, ঘরের দাওয়ার সাথের ছোট বাগানে,বাড়ির উঠোনে জোনাকির মেলা! জানালা ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছে কোন কোনটি! হাত বাড়ালো রুমকি। কিন্তু একটিও জোনাকি ধরতে পারলো না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে নিজের মনেই বললো, নাহ। এভাবে হবে না। আচ্ছা বাইরে গেলে কেমন হয়!

ভাবতেই মন খুশিতে মন ভরে উঠল। বিপত্তি বাঁধলো দরজা খুলতে গিয়ে। হুকটা অনেক উপরে। কি করা যায়! ডায়নিং টেবিলের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল রুমকি।

উঠোনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে রুমকি। গ্রামের বাড়িতে খুব একটা আসা হয় না। গ্রীষ্মের ছুটি ছাড়া। এখন গ্রীষ্মের ছুটি নয়। হঠাৎ করেই বাবা সবাইকে নিয়ে চলে এলো বাড়িতে। শহরে জোছনা বোঝা যায় না। চাঁদ আর তারা দেখা যায়।

ঘাসের জমে থাকা শিশির ভিজিয়ে দিচ্ছে পা। ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি। ভেজা পায়ে উঠোনে দৌড়ে দৌড়ে  একটা একটা জোনাকি ধরে জমা করছে ফ্রকের ভাঁজ করা কোঁচড়ে। চাঁদের আলো যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উপরে তাকিয়ে রুমকি বিস্ময়ে হতবিহ্বল! পরিরা সব উড়ে বেড়াচ্ছে। স্কুলে রুমকি যেমন করে বন্ধুদের সাথে খেলা করে ওরাও তেমন করে খেলছে! ওদের জামাগুলো কি দিয়ে বানানো! একদম তারার আলোর মতো ঝিকমিক করছে! রুমকিকে একা দেখতে পেয়ে নেমে এলো বেশ কয়েকজন। কি মিষ্টি আর পুতুলের মতো চেহারা ওদের! আশ্চর্য! ওদের দেখে রুমকির একটুও ভয় করছেনা।

একজন বললো , তুমি একা কেন খেলছ ভাই? দ্যাখো আমরা দল বেঁধে খেলতে বেরিয়েছি। তুমিও চলো।  আমাদের সাথে খেলবে! 

তোমরা পরি ? তোমাদের জামাগুলো এমন কেন?

হ্যা। আমরা জোছনাপরি। জোছনা রাতেই আমরা খেলতে বের হই। আমাদের জামা তারার আলোয় তৈরি।

কিন্তু আমার তো তোমাদের মতো ডানা নেই! কিভাবে তোমাদের সাথে খেলবো?

ডানা নেই তো কি হয়েছে! তুমি আমাদের ডানায় বসে ঘুরে বেড়াবে! পরিরা বললো।

ইস! বেশ মজা হবে তো! কিন্তু মা? যদি টের পায় তাহলে তো খুব বকবে। কি করবে বুঝতে পারছেনা রুমকি। খুব মন চাইছে ওদের সাথে খেলতে। কিন্তু মা’র ভয়ে কিছু বলতেও পারছেনা।

তুমি কিচ্ছু ভয় পেয়োনা ছোট্ট বন্ধু। মা জানতেই পারবেনা আমরা জোছনায় খেলা করেছি।

কি আশ্চর্য! ওরা আমার মনের কথা জানল কি করে! আমিতো মুখে কিছু বলিই নি।

তোমরা কি করে জানলে আমি মা’র কথা ভাবছিলাম! আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল।

ওরা সবাই একসাথে খিলখিল করে হেসে উঠল। বললো,

পরিরা সব জানে। চলো খেলবে আমাদের সাথে। কিন্তু আগে আমরা তোমার ফ্রকের কোঁচড়ে রাখা জোনাকিদের উড়িয়ে দেবো।

অনেকগুলো জোনাকি ধরে ফ্রকের  কোঁচড়ে রেখেছে রুমকি। পরিবন্ধুদের সাথে মিলে ওগুলো উড়িয়ে দিতে লাগলো। রুমকির অনেক মজা লাগছে ওরা যখন আবার টিমটিম করে লাইট জ্বালিয়ে উড়ে যাচ্ছে। পরিবন্ধুদের সাথে চললো সারারাত খেলা। ওরা কখনো রুমকির সাথে ঘুরে বেড়ালো সারা উঠোন। মেঘের ভেলায় চড়ে ভেসে বেড়ালো আকাশে। তারাগুলো মিটমিটিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

তারার জামা নেবে? রুমকি কিছু বলার আগেই দেখলো তার ফ্রকটিতে অনেক তারা ঝিকমিক করছে! আরে! একি! রুমকির ফ্রকটিও জোছনাপরিদের মতো হয়ে গেলো! কি মজা! কি আনন্দ! 

কখনো আবার রুমকিকে নিয়ে উড়ে গেল চাঁদের দেশে। চাঁদের বুড়ি ফোকলা দাঁতে হেসে জানতে চাইল,

তুমি কে গো?

ও আমাদের বন্ধু। শহরে থাকে। তাই কখনো জোছনা দেখেনি। গ্রামে বেড়াতে এসে জোছনা দেখতে বেরিয়েছিল। আর আমাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। ভাব হয়ে গেল। পরিরা বললো।

কাছে এসো তো বাছা। তারারা তোমার জামায় ফুল পরিয়ে দিয়েছে? একটু বসো। আমি তোমার জামা জোছনার সুতোয় তৈরি করে দিচ্ছি।

চোখের পলকেই বুড়ি তারা ঝলমল , জোছনামাখা জামাটি রুমকিকে পরিয়ে দিল।। খুশিতে রুমকি জড়িয়ে ধরে বললো,তুমি আমার চাঁদনি দিদা।

বুড়ি রুমকিকে আদর করে দিয়ে বললো, আবার এসো জোছনা রাতে। এবার যাও,পরির দেশে ঘুরে এসো।

এ কি! আলো ঝলমলে শহরটিতে একটি লাইটও নেই। জোছনার আলোয় উৎসবে মেতেছে পরিরা সব। সবাই কি আনন্দ করছে! উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। পরির দেশে কি ঈদ হচ্ছে! এত ফুলও রুমকি কখনো দেখেনি। এ যেন শুধু পরির দেশ নয়,ফুলের দেশও। রুমকির খুব ইচ্ছে করছে ওদের মতো উড়তে। রুমকিকে দেখে পরি রানি এগিয়ে এসে মিষ্টি করে হেসে বললো,

ছোট্ট রুমকি,পরির দেশে প্রতি পূর্ণিমা রাতই ঈদের মতো। এখানে সবাই সবার বন্ধু। এখানে মারামারি নেই,হিংসা নেই। তুমিও আমাদের বন্ধু । এসো আজ রাতের জন্য তোমাকে পরি বানিয়ে দিই।

পরি রাণীর কথা শেষ হতে না হতেই রুমকি অনুভব করে পিঠের দু’পাশে দুটো ডানা! বিস্ময়ে রুমকির মুখ দিয়ে কথা বের হয়না। আশ্চর্য! এরা কিভাবে বুঝে যায় মনের কথা! প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো পরিবন্ধুদের দিকে। ওরা হাসছে। বললো, এবার আর আমাদের পিঠে চড়ে ঘুরতে হবেনা। তুমি নিজেই উড়ে উড়ে বেড়াতে পারবে! আনন্দে রুমকি ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। হাত দুটো একটু উপরে তুলতেই হাওয়ায় ভাসতে লাগলো। উড়ে গিয়ে এক চক্কর লাগিয়ে এসে দাঁড়ালো পরিবন্ধুদের পাশে। সবাই মিলে নেমে এলো নিচে। পরি হয়ে রুমকি কখনো বসলো স্কুলের মাঠে ফুটে থাকা বিশাল সূর্যমুখী গাছের ডালে। কখনো পুকুর ঘাটে। কখনো উড়ে গেলো মেঘের দেশে।  রাত শেষ হয়ে আসছে ।

এবার আমাদের যেতে হবে রুমকি বন্ধু! তুমিও ঘরে ফিরে যাও। আবার কখনো জোছনারাতে গ্রামে এলে দেখা হবে। তুমি ভারী মিষ্টি মেয়ে! আবার আমরা এভাবে খেলা করবো।

রুমকির ঘরে ফিরতে একটুও ইচ্ছে করছে না। মন খারাপ হচ্ছে পরিবন্ধুরা চলে যাবে তাই। দিনের আলোয় জোছনাপরিরা বাইরে থাকার নিয়ম নেই। ওরা রুমকিকে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানাতে জানাতে একে একে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। ভোরের আলোর আভাস পেতেই রুমকির ফ্রক আবার আগের মতো হয়ে গেলো। ডানাও নেই। রুমকিও ঘরে ফিরে সাবধানে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো দিদার পাশে। দাদুর পাশে শুয়ে শুয়ে পরিবন্ধু, চাঁদনি দিদা,পরি হয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো। স্বপ্নে দেখতে লাগলো রাত এখনো শেষ হয়নি। উজ্জ্বল জোছনায় রুমকি পরিবন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এই রুমকি ওঠো। দ্যাখো কত বেলা হয়ে গেলো! ওঠো তাড়াতাড়ি। চোখ খুলে রুমকি বিছানায় শুয়ে মিষ্টি হেসে আম্মুর দিকে চেয়ে রইল।

লেখকঃ গল্পকার 

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন