শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

টুকরো স্মৃতিগুলো চোখের কোণাগুলোকে ভীষণভাবে পোড়াচ্ছে

মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারী ২২, ২০২২

প্রিন্ট করুন

ইফতেখার আহমদ সায়মন: যত ভাল রেজুলেশনের ক্যামেরা, লাইট সেট আপ থাকুক না কেন, যতই কালার গ্রেডিং করে চকচকে লুক দেয়া হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত কিন্তু গল্পটা বলার মূল আশ্রয় স্থল অভিনয় শিল্পী। আমরা বিশেষ করে যারা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ধারার সাথে জড়িত, তাদেরকে অনেক সময় অনেক কমপ্রোমাইজিংয়ের মধ্য দিয়ে নির্মাণ ঝক্কি শেষ করতে হয়। তবে যেভাবেই আমরা আমাদের ভিজুয়াল গল্প বলার পায়তারা করি না কেন, অভিনয় শিল্পী ছাড়া গল্প বলা একেবারেই সম্ভব না। আর ক্যামেরার সাথে তাল মিলিয়ে অভিনয় করার মত অভিনয় শিল্পী শহর চট্টগ্রামে একেবারেই হাতে গোনা কয়েক জন। গত এক যুগের থিয়েটার কাম সিনে কর্মী হিসেবে পথ চলার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মঞ্চে পরিণত অভিনয়ের পাশাপাশি ক্যামেরায় পরিমিতি বোধ বজায় রাখার মত অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন প্রধান ছিল রুমেল বড়ুয়া।

২০১৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, সময়টা যেন থমকে গেল। মঞ্চে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে অনায়াসে রক্তমাংসে রূপ দেয়া এ সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণটির চিতার ছাই এখন শীতল হাওয়ায় মিশে গেছে। কিন্তু চিন্তার চিতায় অহর্নিশ যেন পুড়িয়ে ছাই করে যাচ্ছে তার একান্ত কাছের মানুষগুলোকে। ইডিপাস, অন্তিগঁ, নওকর শয়তান মালিক হয়রান, জর্জ দ্যঁদ্যাঁ এ রকম অনেকগুলো নাটকের নামই এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করা যাবে, যেগুলো তার অভিনয় নৈপুণ্যের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। কিন্তু মনে প্রাণে পরিপূর্ণ থিয়েটার কর্মী এ ক্ষণজন্মাকে আমরা মঞ্চের সামনে-পিছনে সমান তালে কাজ করার পাশাপাশি বেশ কিছু শর্ট ফিকশনেও খুঁজে পেয়েছি। বিশেষ করে চট্টগ্রামের নির্মাতাদের কাজগুলোতে পরিচিত মুখ শাহিনূর সরোয়ারের পাশাপাশি ইদানিংকালে সহশিল্পী হিসেবে রুমেল বড়ুয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল বেশ।

২০০৯ কি ২০১০ সালের দিকে ফেইম স্কুল অব ডান্স, ড্রামা এন্ড মিউজিকের বদৌলতে প্রথম পরিচয় হয়েছিল এ সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণের সাথে। হুবহু মনে নেই, সম্ভবত সুজাত ভাইয়ের সাথে এক আলাপচারিতায় ফেইমের নতুন ব্যাচে আসা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একটি ছেলের অকুন্ঠ প্রশংসা শুনেছিলাম। ছেলেটি ছিল রুমেল। ফেইমের অন্যতম শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে রুমেলকে অল্প সময়েই অসীমদার আস্থা অর্জন করতে দেখাটা ছিল দারুণ ব্যাপার। নিজ গ্রুপের ফ্রেশারদের বরাবরই আমি ফেইমের প্রোডাকশন দেখতে অনেকটা বাধ্য করতাম। দর্শক হিসেবে ওরা একটু পরিণত হলে, ওদেরকে অ্যানালিটিকাল সেন্স ডেভেলপমেন্টের জন্য কিছু বিষয় উসকে দিতাম। অনেক সময় বলতাম, ফেইমের প্রোডাকশন থেকে অসীমদার লাইট, সেট, কস্টিউম, প্রপস, মিউজিক ফেলে দাও, সুজাত ভাইয়ের কন্ঠ (যে স্বরের আমি একজন চির মুগ্ধ শ্রোতা) ফেলে দাও; তাহলে কিন্তু দেখবে কিছু কিছু জায়গা ক্লিশে লাগছে। প্রায় প্রত্যেকেরই সেই একই ধরনের অভিনয় ধারা প্রায় প্রতিটা প্রোডাকশনে।

কিন্তু একজনের অভিনয় নিয়ে আমি বরাবরই বলে এসেছি, রুমেল হচ্ছে ফেইমের বর্তমান সব অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভার্সেটাইল অভিনয় সক্ষম। নিজেকে ভাঙার খেলায় পারঙ্গম এ অভিনেতাটিকে তাই কখনোই মনোটোনাস মনে হয় নি আমার। রুমেলদের প্রতিষ্ঠা করা ‘ভ্রান্ত সম্প্রদায়’ থেকে ওর নির্দেশিত নাটক দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। মঞ্চের সামনে-পিছনে সমান তালে পূর্ণ কমিটমেন্ট নিয়ে কাজ করতে এমনকি চাকরি ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করেনি সে। এ দুঃসাহস করাটা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

ক্যামেরার সামনে আমার দৃষ্টিতে একজন পরিপূর্ণ প্যাকেজ হিরো হবার মত সব রসদই ওর মধ্যে ছিল বলে মনে হয়েছে সব সময়। হাইট, লুক, অভিনয় সবই ছিল ওর। যদিও সবেধন নীলমণি হিসেবে একমাত্র ‘পতাকা’ শর্ট ফিল্মটিতেই ওকে নিয়ে আমার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু আমার বেশ কয়েকটা চিত্রনাট্যে ও বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে ছিল। ওকে কয়েক দফা সাঁতার শেখা, জিম করা, বাইক চালানো শেখার জন্য বলেছিলাম। ‘দৃশ্যছায়া’কে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম গত কিছু দিনে। আগামী দিনগুলোতে বেশ কিছু কাজের পরিকল্পনা গুছিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু ২০১৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি এ চিরস্থায়ী ক্ষতি সামলে উঠাটা খুবই কষ্টকর হবে। লাইট? …ওকে! ক্যামেরা? … ওকে! অ্যাকশন? …ইজ নট ওকে! কারণ পারফর্মার অনেকেই আছেন কিংবা হবেন। কিন্তু ভরসা করার মত সৎ, বিনয়ী, কমিটেড পারফর্মার পাওয়াটা সহজ না। টুকরো স্মৃতিগুলো চোখের কোণাগুলোকে ভীষণভাবে পোড়াচ্ছে।

‘পতাকা’ এর শুটিংয়ের সময় মংদাকে সাহায্য করতে হিমশীতল জলে প্যান্ট গুটিয়ে ভেলা বানাতে নেমে যাওয়া, আখ খেতে আখ কাটতে কাটতে ফাজলামি, ফেইমের গোডাউনে মালামাল টানাটানি, একাডেমিতে চা খাওয়া, মাসুদ ভাইয়ের মিউজিক ভিডিওতে এক সাথে অভিনয়, খাগড়াছড়িতে কাটানো সেই তিন দিন সব মিলিয়ে কোলাজ স্মৃতিগুলো রয়ে যাবে মস্তিষ্কের কোন গোপন কুঠরীতে! আমাদের কমিউনিটিটা এমনিতেই অনেক ছোট। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর থ্যাংকসলেস এ লড়াই করতে করতে এভাবে নাই হয়ে যাওয়াটা আর কত সইতে হবে? কিছু দিন আগে তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মী-কবি জুবায়ের ভাইকে হারাতে হয়েছিলো। এবার রুমেলকে। তার কয়েক দিন পর নাট্যকর্মী বাকি ও সবার প্রিয়মুখ শান্তুনুদাকে। ‘জীবন এত ছোট ক্যানে?

লেখক: নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা, চট্টগ্রাম

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন