বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শিরোনাম

ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড়

বুধবার, ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার মালিকানা যুক্তরাষ্ট্র নিতে চায় বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। মঙ্গলবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে হোয়াইট হাউসে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তার এই ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে। টানা ১৫ মাসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি জাতিগত নিধনে ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থন করছেন বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি গাজা উপত্যকার দীর্ঘমেয়াদী মার্কিন মালিকানার প্রত্যাশা করেছেন। এর মাধ্যমে গাজাকে পুনর্গঠিত করে সেখানে চাকরি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনবেন বলে দাবি করেছেন তিনি। ট্রাম্পের এমন মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

• হামাস কী বলছে?

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি বলেছেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধনে ট্রাম্পের আহ্বান ‘‘তাদের নিজ জমি থেকে উৎখাতের শামিল।’’

তিনি বলেন, গাজা নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে ট্রাম্পের মন্তব্য হাস্যকর এবং অযৌক্তিক। এই ধরনের যে কোনও ধারণা অঞ্চলটিতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেবে।

আবু জুহরি বলেন, আমরা তাদের পরিকল্পনাকে এই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা তৈরির একটি রসদ হিসেবে বিবেচনা করি। কারণ গাজার বাসিন্দারা এ ধরনের পরিকল্পনা কখনই বাস্তবায়ন করতে দেবে না।

• প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)
ফিলিস্তি স্বাধীনতাকামী এই সংগঠনের মহাসচিব হুসেন আল-শেখ বলেছেন, পিএলও জন্মভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার সব ধরনের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করছে। আন্তর্জাতিক বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সুরক্ষা, স্থিতিশীলতা এবং শান্তির নিরাপত্তার প্রতি ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব তাদের দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করে।

• সৌদি আরব
যদিও ট্রাম্প দাবি করেছেন, রিয়াদ ফিলিস্তিনিদের স্বদেশের দাবি করছে না। তবে সৌদি আরব বলেছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না রিয়াদ।

সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করার যে কোনও প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করছে সৌদি আরব। ফিলিস্তিন ইস্যুতে সৌদি আরবের অবস্থান ‘‘পরিষ্কার এবং সুস্পষ্ট’’; যা আলোচনা সাপেক্ষ নয়।

‘‘সৌদি আরব ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকারের বিষয়ে যে কোনও ধরনের লঙ্ঘনের ঘটনায় অতীতের মতো দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যানের পুনরাবৃত্তি করছে। ইসরায়েলি বসতি স্থাপন নীতিমালার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূমির অধিগ্রহণ কিংবা জমি থেকে ফিলিস্তিনি জনগণকে বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টারও বিরোধী সৌদি।’’

• মার্কিন সিনেটর ক্রিস মারফি
ট্রাম্পের গাজার মালিকানা নেওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর মারফি বলেছেন, তিনি (ট্রাম্প) একেবারে গেছেন। গাজার মার্কিন আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার মার্কিন সেনার মৃত্যু ঘটাবে এবং কয়েক দশক যুদ্ধের দিকে তা পরিচালিত হবে। এটি খারাপ, অসুস্থ রসিকতার মতো।

• মার্কিন সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন
ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর হোলেন বলেছেন, ট্রাম্পের গাজা থেকে ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বের করে দেওয়ার এবং প্রয়োজনে জোর করে ‘মালিকানা’ নেওয়ার প্রস্তাবটি কেবল অন্য নামে জাতিগত নিধন। এই ঘোষণা ওই অঞ্চলে আমাদের আরব অংশীদারদের অবজ্ঞা করার পাশাপাশি ইরান ও অন্যান্য বিরোধীদের বারুদ জোগাবে।

ভ্যান হোলেন বলেন, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের জন্য কয়েক দশকের দ্বিপক্ষীয় আমেরিকান সমর্থনকে অস্বীকার করছে ট্রাম্পের প্রস্তাব… কংগ্রেসকে অবশ্যই এই বিপজ্জনক এবং বেপরোয়া পরিকল্পনার বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে।

• সিএআইআর, মার্কিন মুসলিম অ্যাডভোকেসি গ্রুপ
কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স (সিএআইআর) নামের এই গ্রুপ বলেছে, গাজা কেবল ফিলিস্তিনিদের, এটি যুক্তরাষ্ট্রের নয়। গাজা ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের বহিষ্কারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বান একটি নিখুঁত পরিকল্পনা।

সিএআইআর বলেছে, ‘‘যদি ফিলিস্তিনি জনগণকে কখনও কোনোভাবে জোর করে গাজা থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাহলে তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সেখানে ব্যাপক সংঘাতের সূত্রপাত করবে, আন্তর্জাতিক আইনের কফিনে শেষ পেরেক মারবে এবং আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির শেষ চিহ্নটুকু ধ্বংস করে দেবে।

রাশিয়া
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এবং গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থানচ্যুত করার চেষ্টা করার পরিকল্পনা রয়েছে। সম্মিলিত শাস্তির নীতি চর্চা করার এমন পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করছে রাশিয়া।

• চীন
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজার জনগণের জোরপূর্বক স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে বেইজিং। একই সঙ্গে সব পক্ষই ফিলিস্তিনি ইস্যুকে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতিকে রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ফিরিয়ে আনার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করে চীন।

• তুরস্ক
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন, ট্রাম্পের মন্তব্য একেবারে ‘‘অগ্রহণযোগ্য’’। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের ‘‘সমীকরণের বাইরে’’ রেখে যেকোনও ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা আরও সংঘাতের সৃষ্টি করবে।

ফিদান বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তুরস্ক যে পদক্ষেপ—বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন ও রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানোর—নিয়েছিল তা পর্যালোচনা করা হবে।

• ফ্রান্স
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ক্রিস্টোফ লেমোইন এক বিবৃতিতে বলেছেন, গাজায় ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর যেকোনও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে প্যারিসের বিরোধিতাকে পুনর্বিবেচনা করছে ফ্রান্স। ট্রাম্পের এই ধরনের পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং ফিলিস্তিনিদের বৈধ আকাঙ্ক্ষার ওপর আক্রমণের শামিল। দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ক্ষেত্রে এটি বড় বাধা। একই সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ অংশীদার মিসর এবং জর্ডানের পাশাপাশি পুরো অঞ্চলের জন্য অস্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে এই পরিকল্পনা।

লেমোইন বলেন, গাজার ভবিষ্যৎ কেবল ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়া উচিত। এটি তৃতীয় কোনও দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়।

• অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার সরকার দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাছে; যেখানে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা উভয়ই শান্তি ও সুরক্ষায় থাকতে পারবেন।

তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধবিরতি সমর্থন করেছি, আমরা জিম্মিদের মুক্তির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছি এবং আমরা গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশের পক্ষে সমর্থন করেছি। তবে ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিবৃতির বিষয়ে মন্তব্য করছি না।’’

• অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী পরিচালক পল ও’ব্রায়েন বলেছেন, গাজা থেকে সকল ফিলিস্তিনিকে অপসারণ করা হলে তা মানুষ হিসাবে তাদের ধ্বংস করার সমতুল্য হবে। গাজা তাদের বাড়ি। গাজার মৃত্যু ও ধ্বংস ইসরায়েলি সরকারের হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার চূড়ান্ত ফল। আর এই হত্যাযজ্ঞে প্রায়ই মার্কিন বোমার ব্যবহার হয়েছে।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন