শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

শিরোনাম

ট্রাম্পের প্রস্তাবে ইসরাইল-ইরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত

মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

সকল উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ট্রাম্পের প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরাইল ও ইরান। দুই পক্ষই নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তার ও কাতারের মধ্যস্থতায় আপাতত সংঘাত থামল। যদিও ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের পরপর দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে। হামলার প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। বিশেষত ইসরাইলকে বোমারু বিমান নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে কঠোর আহ্বান জানান তিনি। এরপর দুই পক্ষই জানিয়েছে, আগে আক্রান্ত না হলে তারা কেউ অন্যের বিরুদ্ধে হামলা করবে না। বিশ্লেষকরা দুই দেশের অবস্থান পর্যালোচনা করে বলছেন, কিছুদিনের জন্য হলেও এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হতে পারে।

ইরাক ও কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া থেকেই বিশ্লেষকরা অনুমান করছিলেন যে, যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প নিজের ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‘ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত দুর্বলভাবে দিয়েছে, যা আমরা আশা করেছিলাম এবং খুব কার্যকরভাবে প্রতিহত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা (ইরান) তাদের ‘সিস্টেম’ থেকে সবকিছু বের করে এনেছে। আশা করি, আর কোনো ঘৃণা থাকবে না। আমি ইরানকে আমাদের পূর্ববর্তী নোটিস দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। সম্ভবত ইরান এখন এই অঞ্চলে শান্তি ও সম্প্রীতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আমি উৎসাহের সঙ্গে ইসরাইলকে একই কাজ করতে উৎসাহিত করব। ট্রাম্পের এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, যুদ্ধবিরতি আসন্ন।

আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কূটনীতিকের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের আমিরের কাছে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করার অনুরোধ করেছিলেন। কূটনীতিক আরও জানান, কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন জসিম আল-থানি সোমবার ইরানের সম্মতি আদায় করেন, যা পরবর্তীতে ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বকে জানান।

সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, কাতার ইরানের সঙ্গে আলোচনায় মধ্যস্থতা করে যুদ্ধবিরতিতে সহায়তা করেছে। হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছেন, ইসরাইল এই শর্তে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে যে, ইরান তাদের দেশে হামলা বন্ধ করবে। সূত্র আরও জানায়, ইরান এই শর্তে সম্মত হয়েছে।

সোমবার রাতেই ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে এক বার্তায় বলেন, ইরানের ওপর সেই ‘নিখুঁত আঘাতই’ সবাইকে একত্রিত করেছে এবং চুক্তিটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছে। তিনি আরও দাবি করেন, ইসরাইল এবং ইরান উভয়ই একই সময়ে তার কাছে শান্তির জন্য এসেছিল। ইরান অবশ্য এটিকে এভাবে দেখছে না। তাদের একজন সংবাদ উপস্থাপক বলেছেন, কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পর ট্রাম্প ভিক্ষুকের মতো ফোনকল করেছিলেন।

ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং ইসরাইলি পক্ষকে মধ্যস্থতা করতে সক্ষম হন। ইসরাইলিদের রাজি করানোর পর আমরা বিশ্বাস করি তিনি কাতারের আমিরকে ফোন করে বলেছিলেন, দেখুন, আপনারা কি ইরানিদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন? তাদের কি আবার পক্ষে আনতে পারবেন? আমি ইসরাইলিদের পেয়েছি, কিন্তু আমাদের ইরানিদেরও পক্ষে দরকার। কাতারের আমির এবং প্রধানমন্ত্রী তখন সেটি করতে সক্ষম হন।

এদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ ইরানিদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যখন সবকিছু একযোগে চলছিল, তখন জেডি ভ্যান্স এবং কাতারের প্রধানমন্ত্রী মিলে লজিস্টিকগুলো চূড়ান্ত করেন। এভাবেই যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা বাস্তব হয়।

যুদ্ধবিরতির পরও পাল্টাপাল্টি হামলা : বাংলাদেশ সময় ভোররাত ৪টায় ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, যুদ্ধবিরতি ‘এখন থেকে প্রায় ৬ ঘণ্টার মধ্যে’ কার্যকর হবে। তিনি আরও একটি সময়সীমা উল্লেখ করেন প্রথম ছয় ঘণ্টা বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় শেষ হয়। এটি ছিল ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে ‘ফাইনাল মিশন’ শেষ করার সময়। ইরান প্রথমে যুদ্ধবিরতি শুরু করবে। ইসরাইল ১২ ঘণ্টা পর যুদ্ধবিরতি অনুসরণ করবে। এই সময়সীমার মধ্য দিয়ে ইসরাইল-ইরানের মধ্যে ‘১২ দিনের যুদ্ধে’র আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির কথা উল্লেখ করেন ট্রাম্প।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টা ৮ মিনিটে ট্রুথ সোশ্যালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর। অনুগ্রহ করে লঙ্ঘন করবেন না!’ ইসরাইলকে ইরানে আর কোনো হামলা না চালানোর হুঁশিয়ারিও দেন ট্রাম্প। এরপর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইসরাইল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিও একই সময়ে জানায়, যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে।

যদিও পরে ইসরাইল অভিযোগ করে যে, ইরান যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ইরান আবারও এ অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে ইরানের শীর্ষ নিরাপত্তা সংস্থা হুঁশিয়ারি দেয় যে, ইসরাইল আরও আগ্রাসী হলে কড়া জবাব দেওয়া হবে। ট্রাম্পের পোস্টের এক ঘণ্টা পর ইসরাইল জানায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব মেনে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। ইরানও ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে তারাও একই পদক্ষেপ নেবে।

দুদেশেরই বিজয় দাবি : যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার বিবৃতিতে নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ সফলভাবে শেষ হয়েছে এবং এতে ইসরাইল তাদের সব লক্ষ্য অর্জন করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরাইল একটি দ্বিমুখী অস্তিত্বগত হুমকি পরমাণু ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দূর করতে সক্ষম হয়েছে। অভিযানে ইসরাইলি বাহিনী তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, ইরানের সামরিক নেতৃত্বে বড় ধরনের ক্ষতি ঘটায় এবং দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘অভিযানের লক্ষ্য পূর্ণ হওয়ায় এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে পূর্ণ সমন্বয়ের ভিত্তিতে ইসরাইল দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে।’

অন্যদিকে ইরানের পক্ষ থেকেও নিজেদের বিজয়ী দাবি করা হয়। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজা আরেফ বলেছেন, এ ‘বিজয়’ প্রমাণ করে, ইরান এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দম্ভ ভেঙে চুরমার দিয়েছে এবং ইরানের শক্তি কতটা, তা তাদের দেখিয়েছে।’ দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাহদি মোহাম্মাদি যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে ‘বিশাল, ইতিহাস গড়া বিজয়’ বলে অভিহিত করে উদযাপন করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।’ ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার মুখপাত্র বেহরোজ কামালভান্দি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কেউই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ‘নির্মূল’ করতে পারবে না। এটা অন্য সবার বোঝা উচিত।

সিএনএনের সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইল-ইরান যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে এটি অন্তত স্বল্প সময়ের জন্য হলেও স্থায়ী হতে পারে। ইসরাইল মনে করে, তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে। ইরানের এতটা ক্ষতি তারা করতে পেরেছে যে পুনর্গঠনের জন্য সময় লাগবে। বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সেড্রিক লেইটন বলেছেন, ইসরাইল তাদের অনেক লক্ষ্য অর্জন করেছে, যার মধ্যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানা এবং তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা অন্যতম।

লেইটন আরও বলেন, ইরান পুনর্গঠন এবং পরবর্তীতে তারা কী করবে তা বোঝার ও পদক্ষেপের জন্য একটি সুযোগ খুঁজছে। তিনি বলেন, ‘এই অর্থে, যুদ্ধবিরতি অন্তত কিছু সময়ের জন্য স্থায়ী হওয়া খুবই সম্ভব।’

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন