ইফতেখার ইসলাম: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে পদার্পণের পর থেকেই একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য ও নীতিগত অবস্থান প্রকাশ করে চলেছেন। প্রথম মেয়াদে তার আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিভিন্ন দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, এবার তিনি আরও স্পষ্টভাবে সাম্রাজ্যবাদী অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে নানা বক্তব্য দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ, গাজায় নতুন ভূখণ্ড গঠনের পরিকল্পনা, ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার দাবির প্রতি নমনীয়তা এবং পানামা খালের ওপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত।
ট্রাম্পের এসব বক্তব্য বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অবস্থান শুধু মার্কিন কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই বদলাবে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

গ্রিনল্যান্ড দখলে নিতে চান ট্রাম্প
গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ট্রাম্পের আকাঙ্ক্ষা নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো ডেনমার্কের কাছে গ্রিনল্যান্ড কিনতে চেয়েছিলেন, যা তখনকার ডেনিশ সরকার তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ট্রাম্প তখন বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘যদি একটি দেশ বিক্রির জন্য না থাকে, তবে তার কী দরকার?’
এবার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে তিনি আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘গ্রিনল্যান্ডের মতো কৌশলগত অঞ্চল আমাদের অধীনে থাকা উচিত। এটি বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড, এবং আমরা এটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারি।’
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডরিকসেন এই দাবির বিপরীতে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গ্রিনল্যান্ড কোনো বাণিজ্যিক সম্পত্তি নয়, এটি আমাদের সার্বভৌম ভূখণ্ডের অংশ এবং এখানকার জনগণের নিজস্ব অধিকার রয়েছে।’ ইউরোপীয় ইউনিয়নও ট্রাম্পের মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই দাবি শুধু অর্থনৈতিক কারণেই নয়, বরং এটি ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটি অংশ। আর্কটিক অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীন ও রাশিয়ার প্রভাব মোকাবিলা করতেই যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ‘ধূর্ত’ পরিকল্পনা
ট্রাম্প সম্প্রতি গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, গাজাকে নতুনভাবে গড়ে তোলা উচিত। আমরা এটিকে মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা বানাতে পারি, যেখানে উন্নত হোটেল, ক্যাসিনো এবং ব্যবসায়িক হাব থাকবে।
এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কারণ, এটি মূলত ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উৎখাত করার একপ্রকার প্রচ্ছন্ন বার্তা বহন করে। মিশর, তুরস্ক এবং কাতার একে জাতিগত নির্মূলকরণের পরিকল্পনা বলে আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘও কঠোর ভাষায় এই ধারণার নিন্দা জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন আমাদের ইতিহাস ও অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। গাজা আমাদের মাতৃভূমি, এবং এখানে কোনো সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প চলতে পারে না।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব। কারণ, গাজার জনগণ এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এটিকে কখনোই মেনে নেবে না। এই ধরনের উদ্যোগ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

রাশিয়ার প্রেমে ট্রাম্প!
ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে আগের বাইডেন প্রশাসনের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছিল, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, ইউক্রেনকে ‘বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে’ এবং ‘কিছু ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিয়ে শান্তির জন্য আপস করতে হবে।’
এই অবস্থান ইউরোপীয় মিত্রদের ক্ষুব্ধ করেছে। ন্যাটো মহাসচিব বলেন, ‘আমরা সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইন রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং ইউক্রেনের ভূখণ্ডীয় অখণ্ডতা কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া উচিত নয়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য ইউক্রেনকে বলি দিতে পারে। এটি শুধুমাত্র ইউক্রেনের জন্য নয়, বরং গোটা ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হতে পারে।

পানামা খালেও ভাগ চায় ট্রাম্প
ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, পানামা খাল আবারও আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসা উচিত, কারণ এটি আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। এই মন্তব্য পানামার জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
পানামার প্রেসিডেন্ট জোসে রাউল মুলিনো কড়া ভাষায় এর বিরোধিতা করে বলেন, আমাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো আপস হবে না। পানামা খাল আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পানামা খাল নিয়ে মার্কিন আগ্রাসী অবস্থান শুধু পানামার জন্য নয়, পুরো লাতিন আমেরিকার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।

বিশ্ব রাজনীতির জন্য কী সংকেত দিচ্ছেন ট্রাম্প?
বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে একটি কৌশলগত ও কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য আন্তর্জাতিক নীতিতে পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার পুনরুত্থান ঘটাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসন যদি এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে চায়, তবে বিশ্বব্যবস্থা মারাত্মক সংকটের মধ্যে পড়বে। কারণ, এ ধরনের নীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে এবং বিশ্বব্যাপী সামরিক প্রতিযোগিতা বাড়াবে।
বিশ্ব এখন দেখছে, ট্রাম্পের এই অবস্থান কতটা বাস্তবে রূপ নেয়, নাকি এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে যে দিকেই যাক, এটি নিশ্চিত যে তার দ্বিতীয় মেয়াদ বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মোড় আনতে চলেছে।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন