আনিস আলমগীর »
যুদ্ধ মানেই অকারণে হত্যা, মৃত্যু, বিভীষিকা আর দখলের লড়াই। যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ মানে জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি থেকে কাজ করা; সেটা জেনেই বাগদাদ রওয়ানা হয়েছিলাম। কিন্তু ৮ এপ্রিল মঙ্গলবার ২০০৩ সালে বাগদাদের প্রাণকেন্দ্র প্যালেস্টাইন হোটেলে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়লে যে কোনও সময় বিমর্ষ হয়ে পড়ি আর মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেই আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় দফা যুদ্ধ ময়দানে বাাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য।
প্যালেস্টাইন হোটেল ইরাক যুদ্ধকালে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। প্রথমত আমরা যারা বিদেশি সাংবাদিক সাদ্দাম এবং জুনিয়র বুশের এই যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাগদাদ গিয়েছিলাম যুদ্ধের সময় সবাই ছিলাম এখানে। শুরুতে সাদ্দাম সরকারের নির্দিষ্ট করে দেওয়া তিনটি তারকা হোটেলের যে কোনও একটিতে থাকলেও যুদ্ধ যখন চ‚ড়ান্তভাবে শুরু হয় সবাই আশ্রয় নেয় এই হোটেলে। দ্বিতীয়ত, সাদ্দাম সরকারের উপস্থিতি জানানোর জন্য তাদের একমাত্র ব্রিফিং স্থল ছিল এই হোটেল। পুরো বিশ্বের চোখ ছিল এই হোটেলে, যার আঙ্গিনা থেকে লাইভ দিচ্ছিল টিভি সাংবাদিকরা। মোট কথা সরকার আর মিডিয়া- দুটির উপস্থিতি বলতে এই হোটেলই। পুরো শহরে এটাই ছিল একমাত্র জায়গা যেটি বোমা হামলার বাইরে ছিল, যেহেতু যুদ্ধের কুশীলবরা সবাই জানতো এখানে বিদেশি সাংবাদিকরা আছে।
দেখা গেল যুদ্ধের শেষ বেলায়, ৮ এপ্রিল ২০০৩, এই হোটেলই আক্রান্ত। সব কিছু যেন ভেঙে পড়লো তখন। আমেরিকান ট্যাঙ্ক শেলের আঘাতে কেঁপে উঠে এই ভবন এবং ভবনে থাকা মানুষগুলোর শরীরও। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিনের প্রতিটি মুহ‚র্ত। আগের দিন সোমবার দিনের বেলা প্রচÐ হামলা হলেও রাতে হামলা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু দিন শুরু হয় ভোর পৌনে পাঁচটায় ওয়েক-আপ কলের মতোই গুলির শব্দে। একটানা চলছেই। মনে হচ্ছে একেবারে কানের কাছেই। কত রকম যে অস্ত্র আছে, কত রকম শব্দ। হরেক রকমের শব্দের সঙ্গে পরিচিতও না। ছয় দিন ধরে হোটেলে একটানা বিদ্যুৎ নেই। লন্ডি চলছে না। সব কাপড়ই ময়লা হয়ে গেছে। ধোয়ার সুবিধা নেই। নিজে পরিস্কার করব সেটাও সম্ভব নয় পর্যাপ্ত পানি নেই বলে। তাছাড়া আয়রন না করে কাপড় পরাও যাবে না। গোসল করা পর্যন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের গায়ের গন্ধ নিজেরও লাগে। যেসব মিনারেল পানির বোতল খালি হতো সেগুলোকে হোটেলের ট্যাপের পানি দিয়ে ভর্তি করে রেখেছিলাম জরুরি প্রয়োজনের জন্য। তার অনেক বোতল খরচ করে এখন মাঝে মাঝে গোসল করি, টয়লেটের কাজ সারি।
আমি খালি গাঁয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল দু’চারটা গুলি এসে আমার বুকেও লাগতে পারে। উঠে একটি ময়লা জামা পরে নিলাম। গুলি ঠেকানোর জন্য? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে হাসি পেল। বিপদে মানুষ কত কিছুই করে, কত অবলম্বনই না চায়। কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লাগে পাশের মসজিদের সেই লোকটিকে। মসজিদটি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বদৌলতে জগতখ্যাত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সাদ্দাম হোসেনের দীর্ঘ ম‚র্তি নিয়ে ফেরদৌস স্কয়ার আর মসজিদের ছবি সব চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে। সেই মসজিদের ইমাম গত প্রায় ২০ দিন একটি কাজ অনবরত চালিয়ে যাচ্ছেন। যখনই প্রচন্ড বোমার শব্দ শুনতে পান তখনই তিনি মাইকে ডেকে ওঠেন- আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। এই লোকটি বিপদে পড়লে আল্লাহকেই স্মরণ করেন আমাকেও স্মরণ করতে স্মরণ করিয়ে দেন।
সকালে আল্লাহকে স্মরণ করেই প্রস্তুতি নেই সারাদিনের জন্য। সকালের আশঙ্কা আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি সত্য কিন্তু সারাদিনে তার প্রতিফলন দেখলাম। বাগদাদে একটি অভিশপ্ত, একটি ভয়ঙ্কর দিন ছিল ৮ এপ্রিল। মার্চের ১০ তারিখ ইরাকে আসার এক মাসের মধ্যে মনে হয়েছে এত খারাপ দিন বাগদাদে আর কাটাইনি। মনে হয় আমি নই, সবার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। চোখের সামনেই দেখলাম এক সহকর্মী মারা যাচ্ছেন। বাকি চার জন অচেতন। নিজেকে জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি খুব কম সময়ই দেখেছি এরকম।
তখন বেলা ১২টা। বাংলাদেশ সময় ২টা। আগে বাগদাদের সঙ্গে আমাদের সময় ব্যবধান ছিল ৩ ঘণ্টা। কিন্তু এদের গ্রীষ্মকালীন সময় আরও এক ঘণ্টা এগিয়ে আসায় তখন ২ ঘণ্টা ব্যবধান। সকাল থেকেই প্যালেস্টাইন হোটেলে বন্দি হয়ে আছি। হোটেলের চারপাশে হামলা, চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ। যেন আমরা একটি দ্বীপের মধ্যে আছি। আমি ৯টার দিকে আমার কক্ষ থেকে নিচে নেমে হোটেল লবিতে দেখলাম সাংবাদিকদের উপস্থিতি তেমন নেই। কোনও বাস ট্রিপও নেই আজ। সাদ্দাম সরকারের আয়োজনে আমরা এসব বাসে প্রায় প্রতিদিনই শহর বা শহরের বাইরে যেতাম মার্কিন হামলায় নিরীহ জনসাধারণের ক্ষয়-ক্ষতি, প্রাণহানি দেখতে। কিন্তু আজ বাইরে যাওয়া দ‚রের কথা, হোটেলের লবি থেকেই বের হওয়া নিষেধ। থমথমে পরিস্থিতির কারণ জানতে দু’চার জন পরিচিত সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলাম। একজন বললো, আজ রুম থেকে কেউ বেরুচ্ছে না। সবাই রুমে বসে বসে দেখছে অদ‚রে অবস্থারত মার্কিন সৈন্যদের অবস্থান। স্প্যানিশ একটি পত্রিকার সাংবাদিক অ্যাঞ্জেলেস পিয়ানোসার পরামর্শ চাইলাম কী করতে পারি। সে গ্রিস পত্রিকা তানিয়ার রিপোর্টার ইয়ানিসের বান্ধবী বনে গেছে এখানে এসে। ইয়ানিসের স‚ত্রে সে আমারও প্রিয়। দু’জনের সঙ্গে আমি আফগান যুদ্ধের সময় বেলুচিস্থানেও ছিলাম। অ্যাঞ্জেলেস পরামর্শ দিল টপ ফ্লোরে যাওয়ার।
১৭ তলা হোটেল ভবনের চার তলায় ৪২২ নম্বর কক্ষটি আমার। প্রত্যেক ফ্লোরে রুমগুলো দুই সারি করা। আমার রুমটি হোটেলের সামনের দিকের অংশে পড়েছে। কিন্তু সামনে তখন কোনও গোলযোগ নেই। গোলাগুলি তখন চলছিল পেছনের দিক থেকে। এক সময় আমি লিফটে করে নিচ থেকে ১৭ তলায় যাই। হোটেলের পেছনের সারির কারও রুমে ঢুকতে চাইলাম দেখার জন্য। পারলাম না, সব কক্ষের দরজা বন্ধ। আরও একটি ব্যাপার ছিল, রুম থেকে ক্যামেরা চালানো নিষেধ। যদি কেউ চালায় দরজা খোলা রাখার কথাও নয়। লিফটের সামনে বড় ধরনের ফাঁকা জায়গা আছে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পেছনে। অর্থাৎ উত্তরে কি হচ্ছে দেখতে চোখ রাখলাম।
দেখতে পাই অদ‚রে টাইগ্রিস নদীর ওপারে আগুনের শিখা, হোটেল আল মনসুরের পাশে। বলে রাখি বাগদাদ শহরটা ম‚লত প‚র্ব-পশ্চিমে দুই ভাগে ভাগ করা এই টাইগ্রিস বা ফোরাত নদী দ্বারা। ওইপারে, মানে পশ্চিমের গ্রিন জোনে সাদ্দাম হোসেনের প্রধান রাজপ্রাসাদ রিপাবলিকান প্যালেসসহ সরকারের গুরুত্বপ‚র্ণ সব মন্ত্রণালয়। বাগদাদ এসে প্রথমে আমি যে হোটেলে উঠেছিলাম সেটিও ওইপারের এই আল মনসুর হোটেল। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় এবং পাশেই শহরের দুই অংশকে সংযোগকারী অনেকগুলো ব্রিজের মধ্যে বড় একটি ব্রিজ হোটেলটির একেবারে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকায় ছেড়ে দেই। কারণ ব্রিজ হচ্ছে যুদ্ধবাজদের টার্গেট। আর প্রতিদিন সংবাদ পাঠাতে আমার দরকার ইন্টারনেট; হোটেলটিতে ইন্টারনেট নেই। দেখলাম ঠিক হোটেলে নয়, তার পাশে ইরাক টিভিতে আক্রমন। তার পাশেই তথ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে আগেও দু’দফা হামলা হয়েছে। আজ মনে হয় হয়নি।
দেখতে পাচ্ছি ব্রিজে কোনও লোক নেই। বন্ধ। এখান থেকে দুটো ব্রিজই দেখা যায়। দুটোই বন্ধ। মানে টাইগ্রিস ক্রস করে প‚র্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার কাছাকাছি কোনও রাস্তা নেই। ব্রিজের গোড়ায় ট্যাঙ্ক। বুঝতে কষ্ট হয় না এগুলো মার্কিন বাহিনীর।
জানতে পারলাম তার আশপাশ, হোটেল আল রশীদ এলাকায় প্রচÐ গোগাগুলি হচ্ছে। আল রশীদ আরেকটা হোটেল, বলা যায় সবচেয়ে অভিজাতটি। সাদ্দামের প্রিয় রিপাবলিকান প্যালেসের কাছাকাছি। যুদ্ধের শুরুতে ইরাকী তথ্য মন্ত্রণালয় সবাইকে সেখানেই থাকতে হবে এমন হুকুম জারি করায় আমিও উঠেছিলাম কিন্তু পরে দেখলাম পশ্চিমা সাংবাদিকরা সবাই সেই হোটেল ত্যাগ করছে। কারণ তাদের কাছে খবর এসেছে বাগদাদ আক্রমনের প্রথম রাতেই সে হোটেলে হামলা করা হবে। কারণও ছিল।
অনেকের হয়তো মনে আছে ইরাকের কুয়েত আক্রমনের সময় সেই হোটেলের লবিতে প্রবেশমুখে ফ্লোরের টাইলসে বড় করে আঁকা হয়েছিল জর্জ বুশের ছবি। অতিথিরা সে ছবিতে জুতা মাড়াতে বাধ্য। বাবাকে অপমানের প্রথম বদলা জুনিয়র বুশ সেটা দিয়েই করবেন অবিশ্বাস করার কারণ ছিল না। সাদ্দাম সরকার সাংবাদিকদের জিম্মি করে সেই আক্রমণ ঠেকাতে চাইলেও কোনওটাই পারেনি। সাংবাদিকরা আক্রমনের আগের রাতেই সব খালি করে দিয়ে উঠেছে প‚র্বপাড়ের এই প্যালেস্টাইন হোটেলে। আর বুশ প্রথম রাতেই সত্যি সত্যি সে হোটেলে আক্রমন করেছে, তবে বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি হোটেলটির।
যাক, সেদিন আট তারিখ সকাল সাড়ে ৭টায় ওইপাড়ের ওই এলাকায় কাতার ভিত্তিক টেলিভিশন আল-জাজিরার অফিসে বোমা হামলা করেছে মার্কিনীরা। তাদের জেনারেটর, গ্যারেজ ধ্বংস হয়েছে। আল জাজিরার সাংবাদিক তারেক আইয়ুব নিহত হয়েছেন। একজন টেকনিশিয়ান এবং আরেকজন ক্যামরাম্যান আহত হয়েছেন। নিহত সাংবাদিক চ্যানেলটির প্রযোজক ছিলেন। জর্ডানের নাগরিক তারেক মাত্র দু’দিন আগে এখানে এসেছেন।
ব্রিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শুনি কানফাটা আওয়াজ। যেন পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠল। সামনে দেখা রুম সার্ভিস বয়কে জিজ্ঞেস করলাম- কোথায় পড়েছে? সে জবাব দেওয়ার আগেই পুর্ব পশ্চিমে খাড়া হোটেলের উত্তর পাশের রুমগুলোর দরজা খুলে যেতে লাগল। এই হোটেলেই হামলা হয়েছে। চিৎকার আর চেঁচামেচি। লিফট নিরাপদ মনে না করে ছুটলাম সিঁড়ি দিয়ে। তখনও জানি না, ঠিক কোথায় হামলা হয়েছে। সব কিছু ঠিকই মনে হচ্ছে।
বিপদে সিড়িও শেষ হয় না। জীবনে ১৭তলা থেকে পায়ে হেটেও নামিনি। তারপরও হাঁফাতে হাঁফাতে নিচে নামছিলাম। স্পেনিশ একটি রেডিও জন্য কাজ করে অলগা। তার সঙ্গে আগেই ভালো পরিচয় ছিল আমার আর ভারতীয় ফটোসাংবাদিক নিজামীর। ভালো বন্ধু বলতে হবে। দেখতে অনেকটা ইন্ডিয়ান চেহারার অপ‚র্ব সুন্দরী অলগা সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব আছে এতেও আমাদের অন্য বন্ধুরা ঈষান্বিত ছিল। সুযোগ পেলে খোঁচা মারতো লেবাননের এক ফটো সাংবাদিক। প্যালেস্টাইন হোটেলে কফিশপ আলাদিন-এ বসে বিল পরিশোধ শেষে বলতো কই পরিচয় করিয়ে দিলে না তো ওর সঙ্গে। অলগার রুম ছিল আসলে পাঁচতলায়। দেশীয় সহকর্মীদের কাছে গিয়েছিল সে ১৪ তলায়।
আমি যখন ১৭ তলা থেকে নামছি অগোছালো অবস্থায় অলগাও অনেকের সঙ্গে নামে। সে কাঁদছিল। আমি সাহস যোগালাম। বেলজিয়ান এক ডাক্তার আমার সঙ্গে নামছে। ডাক্তার গ্রিট মরটার থাকেন পাশের ইস্তার (প‚র্বের শেরাটন) হোটেলে। তারা চিকিৎসা দিতে এখানে এসেছে। অবশ্য তাকে চিকিৎসার চেয়ে হোটেলে টেরেসের ছাদে বসে সময় কাটাতে বেশি দেখতাম যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা টিভি লাইভ দিতাম বেশির ভাগ সময়। কোন সাংবাদিক লাইভে কী বলছে তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতো সে।
সিঁড়িতে চিৎকার দিয়ে ডাক্তার সবাইকে আস্তে আস্তে নামার জন্য কমান্ড দিচ্ছিল। আমরা সবাই নামলাম বেসমেন্টে। সেখান থেকে আবার একতলা ওপরে উঠে সরাসরি হোটেলের আঙ্গিনায় আসতে হয়। দেখলাম ইরাকের তথ্যমন্ত্রী আল সাহাফ হোটেলে ঢুকছেন তখন। সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরল। আরবিতে ’বাকওয়াজ’ করলেন কিছুক্ষণ। আপনারা ধৈর্য ধরুন। তারা কিছু করতে পারবে না- এ জাতীয় কথাবার্তা। মন্ত্রীর ব্রিফিং ফেলে এবার সবাই দৌঁড় দিল হোটেলের প্রধান গেটের দিকে। ধরাধরি করে বিছানাসহ উঠানো হচ্ছে আহত সাংবাদিকদের মাইক্রোবাসে। তাদের কারওই হুশ নেই। এক এক করে চারজন। চারজনই রয়টার্সের সাংবাদিক। এদের মধ্যে একজন মহিলাও আছেন। হুদা। লেবাননের নাগরিক। ইরাকী একজন ফটোগ্রাফার আছেন- ফালহ খবার। পোলান্ডের নাগরিক টেরেস প্রোটসুক। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তাদেরকে জড়ানো বিছানা, জামা কাপড়। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তাদের মধ্যের টেরেস মারা যান।
এর মধ্যে আরেকজনকে নিয়ে আসা হয় ধরাধরি করে। স্পেনিশ টেলি-৫ এর ক্যামরাম্যান জোসে কোসো। কোসোর অবস্থা খুবই মারাত্মক ছিল। তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। পরে সেও মারা যায়। সেদিন প্যালেস্টাইন হোটেলে হামলায় মোট দুই জন সাংবাদিক মারা যায় আর মারাত্মক আহত হয় আরও তিন জন। আল জাজিরার সাংবাদিক সহ সেদিন দুই ঘটনায় মোট তিনজন সাংবাদিক মারা যায় আর আহত হয় ৫ জন।
এর মধ্যে জানা যায় হোটেলের ঠিক প‚র্বদিকের অংশের ১৫ তলায় হামলা হয়েছে। মার্কিন ট্যাঙ্ক শেলের আঘাতে আক্রান্ত হয় ওই তলার ঠিক উপরে-নিচের দুটি কক্ষ। মানে ১৪ এবং ১৬ তলার রুম। তিনটি রুমের মধ্যে রয়টার্সের সাংবাদিকরা ছিলেন ১৫ তলায়। ১৪ তলায় ছিল স্প্যানিশ সাংবাদিক। ১৬ তলায়ও ছিল স্প্যানিশ সাংবাদিকরা। এবার যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ করতে তাদেরই সংখ্যা বেশি। ৩৫ জন। অলগা পরে আমাকে জানালো চৌদ্দতলার সেই আক্রান্ত রুমে তার নিজস্ব ক্যামেরাটি ভেঙ্গে গেছে।
ট্যাঙ্ক শেল কেমন করে এলো তাৎক্ষণিকভাবে সে গবেষণা চলে। কারণ আমেরিকান সেনারা ছিল উত্তর দিকে। রুমগুলো হচ্ছে প‚র্বদিকে। একেবারে শেষে। কেউ কেউ বলল, এটা ইরাকীদের কাজ। কয়েকজন ইন্টারভিউ দিয়ে দিচ্ছে এই সন্দেহ করে। ইরাকীরা স্পষ্ট প্রতিবাদ জানায়, এ ধরনের উদ্ভট দাবির। তথ্য মন্ত্রণালয়ের বড়কর্তা উদে একজনের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে লেগে যান। আবার সেটাই ভিডিও করতে থাকেন আরেক সাংবাদিক। এই ধরনের সাংবাদিকতার প্রতিবাদ করে উদে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। প্রচন্ড ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি তার অন্যান্য সহকর্মী মহসিন বা খাদেমের মত অভদ্র আচরণ করতো না আমাদের সঙ্গে। আমি মনে মনে উদের অবস্থানকে সমর্থন করি। না জেনেই মিনিটের মধ্যে রায় দেওয়া যায় না আর তাদের তর্কাতর্কিকে ক্যামেরায় নেওয়াও ঠিক না।
পরে অবশ্য আমেরিকানরা স্বীকার করে যে এটা তাদেরই ছোড়া ট্যাঙ্ক শেল। রুমগুলো ভবনের একেবারে প‚র্বপাশে হলেও বেলকনিগুলো ছিল কিছুটা উত্তর-প‚র্ব করে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়টার্স সাংবাদিক ছবি তুলছিলেন। মার্কিনীরা নাকি ভেবেছে তাদেরকে টার্গেট করে সে রুম থেকে কোনও আততায়ী হামলার জন্য মিসাইল তাক করেছে। ক্যামেরার সঙ্গে লাগানো লম্বা লেন্সকে তাদের হাতিয়ার মনে হয়েছে। যত সব উদ্ভট যুক্তি। আমাদেরকে মানতেই হচ্ছে।
বলা যায় কাল ৮ এপ্রিল সারাদিন ছিল হামলা আর হামলা। পশ্চিম পাড়ের সাদ্দামের প্রাসাদ, হোটেল আল মনসুর (জনশুন্য), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়- সবই ছিল একের পর এক টার্গেট। সব হামলা তলিয়ে গেছে মিডিয়াকে টার্গেট করে চালানো হামলার কাছে। আগেই বলেছি সকালে আল জাজিরার পর তার কাছাকাছি আবুধাবী টিভি অফিসে হামলা হয়েছে। তার সাংবাদিকরা তখনও গৃহবন্দি হয়ে আছেন। আমাদের কারও কিছু করার নেই। ইরাকী সরকার দৃশ্যত প্যালেস্টাইন হোটেলে হামলার পর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে কিন্তু আমরা প্রহর গুণছি আমাদের সবার বন্দিত্ব কবে শেষ হবে!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন