বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

শিরোনাম

তরুণদের স্ট্রোক বাড়ছে কেন? জানুন কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়

বুধবার, জুলাই ৩০, ২০২৫

প্রিন্ট করুন
স্ট্রোক

স্ট্রোক—শুনলেই মনে হয় এটি বয়স্কদের রোগ। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা ও চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে উঠে আসছে এক চমকে দেওয়া তথ্য—স্ট্রোক এখন তরুণদের মাঝেও ব্যাপক হারে বাড়ছে। আগের মতো ষাটোর্ধ্ব নয়, এখন ২৫-৪০ বছর বয়সী তরুণরাও স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন আশঙ্কাজনক হারে। এর পেছনে রয়েছে আধুনিক জীবনের নানা অনিয়ন্ত্রিত অভ্যাস ও মানসিক চাপ।

এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো কেন তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রবণতা বাড়ছে, লক্ষণগুলো কীভাবে চিনবেন এবং কী করলে এই ভয়াবহ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

স্ট্রোক কী?
স্ট্রোক হলো এক ধরনের মস্তিষ্কের আঘাত, যেখানে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় অথবা কোনো রক্তনালী ফেটে যায়। ফলে নির্দিষ্ট অংশ অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না এবং দ্রুত সেল ড্যামেজ হয়। স্ট্রোকের ফলে পক্ষাঘাত, বাকশক্তি হ্রাস, স্মৃতিভ্রষ্টতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

স্ট্রোক

তরুণদের মধ্যে স্ট্রোক বেড়ে যাওয়ার ৫টি বড় কারণ

১. খাদ্যাভ্যাসে বিপর্যয়: ভাজাপোড়া ও ফাস্টফুড
তরুণদের দৈনন্দিন খাবারে এখন বেশি জায়গা দখল করে নিচ্ছে ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিপস, বার্গার ও তেলে ভাজা স্ন্যাক্স। এসব খাবারে থাকে ট্রান্স ফ্যাট ও উচ্চমাত্রার সোডিয়াম, যা রক্তনালিতে চর্বি জমিয়ে ‘আথেরোসক্লেরোসিস’ সৃষ্টি করে। এর ফলে ধমনী সরু হয়ে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা স্ট্রোকের বড় কারণ।

২. প্রযুক্তিনির্ভর জীবন ও শরীরচর্চার অভাব


সারাদিন ল্যাপটপ, মোবাইল বা টিভির সামনে বসে থাকার ফলে তরুণদের দেহে সঞ্চালন কমে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় বসে থাকা রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বাড়ায় এবং তা ধীরে ধীরে স্ট্রোকের দিকে ঠেলে দেয়। এতে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসও দেখা দেয়, যা সবই স্ট্রোকের জন্য দায়ী।

৩. ধূমপান ও অতিরিক্ত ক্যাফেইন বা এনার্জি ড্রিংক


নিকোটিন ধমনীকে সংকুচিত করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। ধূমপান বা ভেপিং করার অভ্যাস রক্তনালির গঠন দুর্বল করে ফেলে। এদিকে অতিরিক্ত কফি বা এনার্জি ড্রিংক সেবনে হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হয় এবং স্নায়ু অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়। তরুণদের এই ‘কুল’ অভ্যাসই একসময় হয়ে উঠছে মৃত্যুঝুঁকির কারণ।

৪. অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা


বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা, চাকরি পাওয়া, সম্পর্কের টানাপোড়েন বা সামাজিক প্রত্যাশা—তরুণদের জীবনে মানসিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এ চাপের ফলে শরীরে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয়, যা রক্তচাপ ও প্রদাহ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ বা বিষণ্নতা অনেক সময়ই ডিপ্রেশন, ঘুমের অভাব বা আত্মনিয়ন্ত্রণহীন আচরণের দিকে নিয়ে যায়, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

৫. ঘুম ও বিশ্রামের ঘাটতি

ঘুম ও বিশ্রামের ঘাটতি


রাত জেগে মোবাইল দেখা, ওয়ার্ক প্রেশার, ক্লান্তি—এই সব মিলিয়ে ঘুমের গুণগতমান নেমে যাচ্ছে। কম ঘুম বা বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি স্নায়ুতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে, যা স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের সাধারণ লক্ষণ

হঠাৎ মুখ, হাত বা পা এক পাশে অবশ হয়ে যাওয়া, কথা বলার সময় জড়তা বা অস্বচ্ছতা, চোখে ঝাপসা দেখা, বা এক বা দুই চোখেই দৃষ্টিহীনতা, ভারসাম্য হারানো বা মাথা ঘোরা, মাথায় তীব্র ব্যথা, যা সাধারণত অস্বাভাবিক মনে হয়, অস্থিরতা, ক্লান্তি, বা বমি ভাব।

অনেক তরুণেই প্রথমে দেখা দেয় ‘মিনি স্ট্রোক’ বা ট্রানসিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক (TIA), যা কয়েক মিনিট থেকে ঘণ্টাখানেক স্থায়ী হয় এবং পরে বড় স্ট্রোকের পূর্বাভাস দিতে পারে।

কীভাবে বুঝবেন আপনি ঝুঁকিতে আছেন?
আপনি যদি একজন তরুণ হন এবং নিচের যেকোনো কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন, তাহলে আপনিও স্ট্রোকের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন:

নিয়মিত ধূমপান বা এলকোহল/মাদক গ্রহণ, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস, পরিবারে কারও স্ট্রোক বা হৃদরোগের ইতিহাস, স্থূলতা (ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি), মানসিক চাপ বা ডিপ্রেশন, একটানা বসে কাজ করা বা একেবারে ব্যায়াম না করা

প্রতিরোধে যা করবেন-

১. সুষম খাবার গ্রহণ
ফল, সবজি, বাদাম, মাছ ও ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে ধমনী সুস্থ থাকে। বিশেষ করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছের তেল হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের জন্য উপকারী।

২. নিয়মিত ব্যায়াম
প্রতিদিন ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো বা জগিং করলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। ব্যায়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়।

৩. ঘুমের যত্ন
ঘুমের অভাব কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। নিয়মিত রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। মোবাইল বা স্ক্রিন টাইম রাত ১০টার পরে কমিয়ে ফেলুন।

৪. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
ধ্যান, বই পড়া, প্রকৃতিতে সময় কাটানো কিংবা কথা বলার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়। কেউ বিষণ্নতা বা উদ্বেগে ভুগলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

৫. ধূমপান ও মাদক বর্জন
এই দুটি অভ্যাস ধমনী ও স্নায়ুকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে। সেগুলো পরিহার করাই সুস্থ জীবনের প্রথম পদক্ষেপ।

স্ট্রোক এখন আর শুধু প্রবীণদের রোগ নয়। তরুণদের মধ্যেও এটি এক নীরব ঘাতক হয়ে উঠছে। সঠিক জীবনধারা, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন