বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

তির্যক নাট্যদলের নাটক ‘রাজা’ এবং আমার শঙ্কা

বুধবার, নভেম্বর ১০, ২০২১

প্রিন্ট করুন
244455808 235234925312018 4544324554202541213 n 1

মোহাম্মদ আলী: থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের (টিআইসি) মূল মিলনায়তনে শনিবার (২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় তির্যক নাট্যদলের নাটক ‘রাজা’ দেখে একটি বিষয়ে খুবই শঙ্কিত, ভীত ও চিন্তিত হলাম। চট্টগ্রামে প্রতি বছর নাটকের দল বাড়ছে, কিন্তু নাট্য কর্মী বাড়ছে না। একটি দল ভেঙ্গে একাধিক দল হচ্ছে। কিন্তু নতুন নাট্য কর্মী তৈরি হচ্ছে না! ফল স্বরূপ তীর্যক নাট্যদলের মত একটি দলের একটি নাটকেই তিন-চার জন শিল্পীকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। এক দৃশ্যে যে প্রজার অভিনয় করছে, পরের দৃশ্যে সে রাজা বা সৈন্যের চরিত্রে অভিনয় করছে। সাধারণ দর্শক হিসেবে বিষয়টা আমার কাছে খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে। নাটকে দর্শকের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটেছে। এক দৃশ্যে যে ইতিবাচক রোলে অভিনয় করলেন, পরের দৃশ্যে সে ফের নেতিবাচক রোলে। একই নাটকে একাধিক তথা তিনটি চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে একজন শিল্পীর উপর মানসিক চাপও পড়ে বলে আমি মনে করি। তির্যক নাট্যদলের মত নাট্যদলে অভিনয় শিল্পীর এমন খরা হলে অন্য দলগুলোর অবস্থা কেমন, তা সহজে অনুমেয়। তাই নাটকের দলগুলোর ভাঙ্গন রোধে দলের প্রধানদের স্বেচ্ছাচারিতা ও আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে, অন্যের মতামতের প্রতি সহনশীল হতে হবে।

এবার নাটকের কথায় আসি। যতদূর মনে পড়ে মূল চরিত্র সুদর্শনার সাথে দৈব কণ্ঠের কথোপকথনে নাটকের সূচনা। তবে সুদর্শনা দ্বৈব কণ্ঠকে ‘রাজা; বলে সম্বোধন করলেও তাদের দুইজনের মধ্যে সম্পর্কটা দর্শক হিসেবে আমি বুঝে উঠতে পারিনি পুরো নাটকেই। পুরো নাটকের পরিবেশনা সাজানো-গোছানো হলেও নাটকের কাহিনী ছিল খুবই দুর্বোদ্ধ। নাটকের ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, তার কার্য কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। নাটকের সেট ছিল খুবই সাদামাটা। সেটের মতে কস্টিউম বা পোশাকেও ছিল দূর্বলতা। বেশিরভাব শিল্পীর সবাই পরিধান করেছেন কমন পোশাক (ট্রাইজার ও টিশার্ট/গেঞ্জি), যা নাটকের কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এ ধরনের কমন পোশাক সাধারণত পথ নাটক বা মুকাভিনয়ে ব্যবহার করা হয়। তির্য়ক নাট্যদল যেন পথ নাটকের স্বাদ দিল। সেট ও কস্টিউম ডিজাইনে ফুটে উঠেছে দৈন্য দশা।

সুদর্শনা তথা শায়লা শারমিন স্বাতীর অভিনয়, সংলাপ ও অভিব্যক্তি ছিল পারফেক্ট। সব শিল্পীই সংলাপ বলার ক্ষেত্রে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন, সংলাপ বুঝতে কোন অসুবিধা হয় নি দর্শকরদের। নাটকে যন্ত্রবিহীন সঙ্গীতও ভাল লেগেছে। অধিকাংশ নাটকে বাজনার জন্য গানের কথাই বুঝা যায় না। সেখানে রাজা নাটকের সঙ্গীত উপভোগ করেছেন দর্শকরা।

দীর্ঘ প্রায় আঠারো মাস পর নাটক রাজা’ মঞ্চে এনছে তির্যক নাট্যদল। শুক্রবার (১ অক্টোবর) ও শনিবার (২ অক্টোবর) দুই দিন নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে তির্যক নাট্যদলের প্রযোজনায় এ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়েছিল ২০১১ সালের ১৫ জুন ‘রাজা’ নাটকের ভাববস্তু রূপের সাধনা ও অরূপের আরাধনা নিয়ে গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্র ভাবাদর্শের রূপ-অরূপ, সীমা-অসীম তত্ত্বও এখানে আভাসিত। অন্ধকার ঘরের অদৃশ্য রাজা অসীম অনন্তের প্রতীক। তাকে ঘিরেই প্রধান চরিত্র তিনটির আবর্তন। সুদর্শনা, সুরঙ্গমা, ঠাকুরদা এমনকি কাঞ্চীরাজও রাজার বৃত্তেই ঘুরে চলেছে। এরা যেন বৈষ্ণবপদাবলীর সেই ভক্ত স্বরূপ। এ এক বসন্তবিহীন কাল। বসন্তের আজ তাই নতুন উপলব্ধি চাই। আজ রাজা-তে বসন্ত কেবল তো পটভূমি নয়, এক হিসেবে বসন্ত আবার পুরোভূমি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় ও আহমেদ ইকবাল হায়দার নির্দেশিত ‘রাজা’ নাটকের বিভিন্ন অভিনয়ে করেছেন সুজিত চক্রবর্ত্তী, শায়লা শারমিন স্বাতী, লাকী মল্লিক, মাহবুবুল ইসলাম রাজিব, রিপন বড়ুয়া, অমিত চক্রবর্ত্তী, রোজিনা আকতার নিঝুম, ফারজানা ইসলাম টিনা, বিভোর সা’দ অপূর্ব, মিখাইল মোহাম্মদ রফিক, সালমা চৌধুরী, সাইদুর রহমান চৌধুরী, আবির কিশোর, অজয় ত্রিপুরা, সানজিদা আক্তার রূপা ও জুয়েল চাকমা। আলোক ও মঞ্চ পরিকল্পনায় আহমেদ ইকবাল হায়দার, পোশাক পরিকল্পনায় নায়লা আজাদ, সহযোগি অমিত চক্রবর্তী।

তির্যক নাট্যদল রাজা নাটকটি নিয়মিত মঞ্চায়ন করবে। তাই এর সেট ও কস্টিউম ডিজাইনে আরো যত্নবান হতে হবে। আরো শিল্পী অন্তর্ভুক্ত করে এক শিল্পীকে একাধিক চরিত্রের ভার থেকে মুক্তি দিতে হবে।

লেখক: অভিনেতা ও সাংবাদিক

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন