শাহীন চৌধুরী ডলি:
সখিনা ঘন্টা দুই সময়ের জন্য আসে এবং আমার ঘরের কাজে সাহায্য করে চলে যায়। এভাবে সে আরো কয়েকটি বাসায় কাজ করে। সুস্থ সবল স্বামী অকর্মণ্য, জুয়ারি এবং নেশাখোর। দুটো কন্যাসন্তানসহ পরিবারের চারজনের ভরণপোষণের দায়িত্ব, মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ সাথে বাসা ভাড়ার টাকাটা দিনান্ত পরিশ্রম করে সখিনাকেই উপার্জন করতে হয়৷ ক্লান্ত শরীরটা রাতে বিছানায় এলিয়ে দিয়েও সুখ নেই৷ শুরু হয় স্বামী নামক প্রভুর টাকার জন্য শারীরিক – মানসিক অত্যাচার। জোরপূর্বক বউয়ের টাকাটা ছিনিয়ে নিয়ে সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় এবং টাকাটা আনন্দ স্ফূর্তিতে উড়িয়ে দেয়। হঠাৎ সখিনার শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে কারণ জানতে চাইলাম। জানলাম সে পুনরায় গর্ভবতী। দুই কন্যা আছে আবার সন্তান জন্মদানের কি প্রয়োজন জিজ্ঞেস করতেই বললো, তার স্বামী পুত্রসন্তান চায়। শরীর সখিনার হলেও সে সন্তান ধারণ করতে চায় কিনা এব্যাপারে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। এরকম ব্যাপার বাংলাদেশের সমাজে অহরহই ঘটছে। সখিনা একজন উদাহরণ মাত্র।
নারীও রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। নারীর আছে এক পৃথক সত্তা। শরীর থাকলেও সেই শরীরের মালিকানা নারীর নিজের হাতে নেই। নিজের শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, সঙ্গীর সাথে যৌনতার বিষয়ে পছন্দ – অপছন্দ, গর্ভ নিরোধক ব্যবহারের, এমনকি স্বাস্থ্য পরিসেবা গ্রহণের অধিকার পর্যন্ত নারীর এখতিয়ারে নেই। ২০২১ সালের আধুনিক বিশ্বের একাংশের নারী চিত্র এটাই। শরীরের উপর অধিকার নিয়ে ইউএনএফপিএ ( জাতিসংঘ ) এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, বিশ্বের ৫৭টি উন্নয়নশীল দেশের প্রায় অর্ধেক নারীর শরীর পুরুষ দ্বারা শাসিত।
শরীর ও যৌনতা নিয়ে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা মূল্যহীন। উপরন্তু ধর্ষণ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, বলপূর্বক গর্ভপাত, কুমারিত্ব পরীক্ষায় কিশোরী হতে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর শরীরের অধিকার অবিরাম লঙ্ঘিত হচ্ছে। দক্ষিন ও মধ্য এশিয়া, সাহারা অঞ্চলের আফ্রিকান দেশগুলোতে নারীর অধিকার ভঙ্গ প্রকট আকার ধারণ করেছে। নিজ শরীরের অধিকার নিয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী নারী মুখ খুলেন না। যদিও খুলেন তার হার খুবই কম, মাত্র ১০ শতাংশ নারী। এর জন্য দায়ী আমাদের পরিবার -সমাজ – রাষ্ট্র, ক্ষমতা কাঠামোর প্রতিটি স্তরে প্রোথিত পুরুষতন্ত্র ও লিঙ্গবৈষম্য। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লিঙ্গ বিভেদতন্ত্রই নারীকে দুর্বল ও নারীশরীরকে ‘ রক্ষণীয় ‘ বলে বিধান দেয়। পুরুষরা সেই উছিলায় নারীশরীরকে পুরুষের অধিকৃত সম্পত্তি বলে বিশ্বাস ও প্রচার করে।
জাতিসংঘের মতে মেয়েশিশু জন্মের পর দোলনা থেকেই লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। বেড়ে উঠার প্রতিটি স্তরে সমাজ নারীর শরীর নিয়ে আলোচনা – সমালোচনায় মুখর থাকে। মেয়েদের পোশাক নির্বাচন নিয়েও মন্তব্য শুনতে হয়। একটি মেয়ের পোশাক, প্রসাধনীসহ সার্বিক বহিরঙ্গই যেন তার চরিত্র বিচারের মাপকাঠি। সমাজ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া এমন লিঙ্গবৈষম্যের জলহাওয়াতেই ক্ষমতার সাম্য বিঘ্নিত হয় এবং অসাম্য বেড়ে উঠে। নারীমনে ধারণা গড়ে উঠে- তার শরীর আসলে একটি বড় দায়, বিড়ম্বনা। তার নিজের শরীর নিয়ে সিদ্ধান্তের দায়ভার অন্যের, পুরুষের। নারীর শরীরসুখ পুরুষের দ্বারা চালিত। গর্ভধারণ কিংবা গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট করে দেয়ার মালিক পুরুষ। শরীরের যন্ত্রণাগুলোকেও পুরুষ স্ত্রীরোগ আখ্যা দিয়ে উপহাস করে। একজন নারী চিকিৎসার জন্য ঘরের বাইরে ডাক্তারের কাছে কিংবা চিকিৎসালয়ে যাবে কিনা- এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারও নারীর ক্ষেত্রে খর্বিত, তাও নির্ধারণ করে দেয় পুরুষ।
জাতিসংঘের সমীক্ষা কিন্তু কেবল এই অসাম্যই দেখায়নি। নারীর প্রতি এত যে অসাম্য, রাষ্ট্রের আইন ও বিচার তা রোধে কতটা সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় তাও বুঝিয়েছে। জাতিসংঘের একটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে, ৫৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে ২০ টিতে বহাল আছে ধর্ষককে বিয়ে করার আইন। ধর্ষকের কঠোর শাস্তি এড়ানোর জন্য এটাও রাষ্ট্রের বেছে নেয়া পন্থা। বিশ্বের ৪৩টি দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনো আইনই নেই। ৩০টিরও বেশি রাষ্ট্র নারীকে ঘরের বাইরে ঘোরাফেরাতে বাঁধা প্রদান করে। প্রায় ৩০ শতাংশ দেশে এখনো মাতৃত্বকালীন পরিচর্যায় গাফিলতি আছে। ২৫ শতাংশ দেশে নারীর গর্ভনিরোধকের সুব্যবস্থা নেই। নারীর সাংবিধানিক সমানাধিকার প্রায় সর্বত্র স্বীকৃত, কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। রাষ্ট্রের একজন পুরুষ যেখানে সম্পূর্ণ আইনি অধিকার ভোগ করছে, নারী সেখানে পাচ্ছে ৭৫ শতাংশ। নারীশরীরের সহমর্মি আইন প্রণয়নের সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যোগ নেই এটা ভাবলে ভুল ভাবা হবে। কম্বোডিয়া, মোজাম্বিকের মতো দরিদ্র দেশও নারী-পুরুষের যৌন জীবন, শিক্ষা ও স্বাস্থসেবা খাতে সমানাধিকার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশে এখনো নারী শরীর অন্যের ইচ্ছার দাস।
লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক
ইমেইল: shaheen.babu1971@gmail.com
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন