নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলা সনের প্রথম দিন বাংলা নবর্বষ বা পহেলা বৈশাখ হিসেবে পালিত হয়। প্রতিবছর দিনটিতে নানান উৎসবের আয়োজন করেন বাঙালিরা। অন্য সবার মতো যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। তবে এবার সে উৎসব নিয়ে তৈরি হয়েছে নানান বিতর্ক। মূলত পবিত্র মাহে রমজানে এমন উৎসবের আয়োজন সঠিক মনে করছেন না অনেকে। তাইতো বেশ কিছু সংগঠন এবারের উৎসব ঈদের পরে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে কয়েকটি সংগঠন যেন নাছোড় বান্দা। রমজানে পহেলা বৈশাখ আয়োজন কোন সমস্যা হবে না—এমন যুক্তি দেখিয়ে তারা চাইছেন অনুষ্ঠান আয়োজনের। যদিও এসবের সমালোচনা করতে ছাড়ছেন না প্রবাসী বাঙালিরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রমজানে পহেলা বৈশাখের আয়োজন নিয়ে চলছে ‘তমুল’ সমালোচনা।
জানা গেছে, নিউইয়র্কে টাইমস স্কয়ারে শতকন্ঠের আয়োজনে বাংলা নববর্ষ ১৪০৩ উপলক্ষ্যে ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ ২৩ রমজানে নানান আয়োজন করা হচ্ছে। এ উৎসব আয়োজনের প্রধান হচ্ছেন বিশ্বজিত সাহা। আয়োজক সংগঠন হিসেবে রয়েছে এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। টাইমস স্কয়ারে শুক্রবার ১ বৈশাখ অনুষ্ঠানটির সময় দেয়া হয়েছে সকাল ৬টা থেকে ৮টা। দ্বিতীয় দিন ২ বৈশাখ ১৫ এপ্রিল কুইন্সের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলার আয়োজন। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা অবধি নাচ গান, মেলা ও শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মকান্ড পরিচালিত হবে। এছাড়া হিন্দু মিলন মেলার উদ্যোগে ১৩ এপ্রিল উডসাইডের কুইন্স প্যালেসে বর্ষবরণ ও বৈশাখী উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এর আহবায়ক হচ্ছেন শান্তা সূত্রধর ও যুগ্ম আহবায়ক মিতা ঘোষ।
পহেলা বৈশাখ রমজানের মধ্যে হওয়ায় এসব অনুষ্ঠানের পক্ষে নয় অধিকাংশ বাঙালি-আমেরিকান। তারা বলছেন ঈদের পরে হলে সবার জন্য ভালো হতো। তবে আয়োজকরা বলছেন—রমজানে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান কোন সমস্যা তৈরি করবে না!
বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, সম্রাট আকবরের আমল থেকে বর্ষবরণের রেওয়াজ চলে আসছে। সকল ধর্মের মানুষ একত্রিত হতে পারে এ ধরনের অনুষ্ঠানে। এতে ভাতৃত্ব বন্ধনের সৃষ্টি হয়। সে জায়গাটিকে বির্তকিত করা ঠিক না। যারা করেছেন তারা সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। বাঙা্লি চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। তিনি আরও বলেন, যারা বিভিন্ন ধর্ম পালন করেন তাদেরকে আমরা শ্রদ্ধা করি। তাদেরও উচিত বর্ষবরণের মতো অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সন্মান করা। রোজার মধ্যে অনুষ্ঠান হলেও ধর্মের ব্যাঘাত ঘটবে না।
গুটি কয়েক সংগঠন রমজানে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করতে এক পায়ে খাড়া হলেও অনেক সংগঠন সিংহভাগের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সকলের প্রতি সম্মান রেখে ঈদের পর নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিউইয়র্কের বিপা, বাফা, শোটাইম মিউজিক, উদিচী ও ড্রামা সার্কেলের মতো সংগঠনগুলো।
যা বলছেন প্রবাসীরা
কমিউনিটি একটিভিস্ট নাসির আলী খান এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমি প্রত্যেকের মতামতকে সন্মান করি। তার মানে এই নয় তার সাথে আমি একমত। বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বিপক্ষে আমি নই। আমি বলছি তা পিছিয়ে নেয়া হোক। যাতে রোজার পর আমরা সবাই মিলে এ উৎসবে শরীক হতে পারি। বাংলাদেশি শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের কাছ থেকে এটাই চাওয়া হচ্ছে। দয়া করে আমাদের পোর্টেট করবেন না যে, আমরা বৈশাখী উৎসবে বিরোধী। বরং আমরা এই গ্রেট শো মিস করতে চাই না। কোন ব্যক্তির অধিকার নেই তা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা। আমরাই দুনিয়াতে নন কমিউনাল। ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কোন ব্যক্তির জ্ঞান দেবারও প্রয়োজন নেই। আমি সংগঠক ও আমন্ত্রিত অতিথি বিশেষ করে ড. নুরুন নবী, রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা, লায়লা হাসান, বিশ্বজিত দাদা ও মহিতোষ তালুকদার তাপসকে অনুরোধ করছি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি মুসলিম কমিউনিটির কথা বিবেচনায় রেখে এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়া হোক।
এটর্নি মইন চৌধুরী বলেন, পবিত্র রমযানের কারনে এবারের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবো না।
কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট ও সাংবাদিক ইমরান আনসারি বলেন, রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় নিউইয়র্কে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান স্থগিতের আহ্বান জানাচ্ছি। যেখানে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বানী দিচ্ছেন। সিটি মেয়র ব্যুরোতে ঘুরে ঘুরে ইফতার পার্টিতে অংশ নিচ্ছেন, নিজের বাসভবনে ইফতার আয়োজন করছেন, টাইম স্কয়ারের মত যায়গায় উন্মুক্ত স্থানে তারাবী পড়ার নিরাপত্তা দিচ্ছেন।নিউ ইয়র্কের প্রায় চারশ মসজিদকে বিশেষ নিরাপত্তার আওতায় এনেছেন। সে যায়গায় আপনি বাংলাদেশি মুসলমান হয়ে শত কণ্ঠের অনুষ্ঠান করে কিসের বার্তা দিতে চাইছেন। যেখানে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে স্কুল ছুটির ব্যবস্থা করতে মুসলমানদের দশ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই সংগ্রাম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে বাংলাদেশিদের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর গালে চপেটাঘাত, অন্তত বাংলাদেশি মুসলমানের কাজ হতে পারে না।
তিনি বলেন, অনুষ্ঠানসূচী অনুসারে ইফতার ও তারাবীহ চলাকালীন নাচ, গান চলবে। এটি মুসলমানদের প্রতি সরাসরি অবজ্ঞা। আপনার স্বাধীনতা আছে বলেই যা ইচ্ছে তা করতে পারেন না। কমিউনিটির দু’একজন এ নিয়ে কথা বলেছেন, অনেকে তাঁদের উপর হামলে পড়েছেন। এটি ভাল লক্ষণ নয়। আমি হলফ করে বলতে পারি যারা মঞ্চে এসে বাঙলা সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেবার বুলি আওরান তাদের ছেলে মেয়েরা ভাল করে বাংলা বলতে পারেন না। বর্ষবরণের অনুষ্ঠান রমজানের পরে করলে আপনাদের খুব বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে করি না। কারণ যারা এটির আয়োজন করছেন তারা এবারই প্রথম শতকণ্ঠে বর্ষবরণের আয়োজন করছেন। এর কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এখানে নেই যে ১লা বৈশাখেই এটি করতেই হবে। বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রত্যেক সদস্যকে এ বিষয়ে সোচ্চার হবার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
রোমিও রহমান বলেন, নিউইর্য়কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় যারা আমাদের এই পবিত্র রোজার মাসে বৈশাখীর আয়োজন করছে এবং যে সব প্রতিষ্ঠান সহায়তা করছে আগামী দিনে তাদের থেকে দুরে থাকার জন্য সকল প্রবাসী ভাই বোনদের অনুরোধ করছি জ্যাকসন হাইটস বাংলাদে;শ ক্লাব এর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।
নাট্যকার খান সওকত বলেন, আপনারা চিন্তা করে দেখুন পবিত্র রমজানের সময় কে রোজা থাকলো কি থাকলো না সেটা তার নিজের বিষয়। কিন্তু রোজাদার মানুষের সামনে তারা খায়না। লুকিয়ে খায়। এটা সম্মান। এমনকি অনেক হিন্দু বন্ধুকেও দেখেছি মুসলমানদের প্রতি এ সম্মান দেখাতে। অথচ আজ দেখতে হবে বৈশাখের নামে ওপেনলী পান্থা ইলিশে তারা কামড় দেবেন রোজাদার মানুষদের সামনে। তারা খানা-পিনা করবেন সবার সামনে। এটা মেনে নেয়া বা এটা চালু করা দুটোই কষ্টের। ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমাদের সবার। আশা করি মন থেকে সবাই সেটা অনুভব করবেন। আমরা এ উৎসবের বিরুদ্ধে নই। শুধুমাত্র এক সপ্তাহ পিছিয়ে রমজানের পর এ অনুষ্ঠানটা করতে আমরা অনুরোধ করছি। সবার কল্যাণ হোক।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন