মোহাম্মদ আলী: সময়ের ব্যবধানে দেশে প্রায় সব কিছুর দাম বাড়ে। অথচ চামড়ার দাম কমে ধারাবাহিকভাবে। প্রতি বছর প্রতি বর্গফুট লবণজাত চামড়ার যে দাম নির্ধারিত হয়, পরের বছর তা ২০-২৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। মাঠ পর্যায়েও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া কিনেন আড়তদার ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। সরকার কর্তৃক চামড়ার দাম কম নির্ধারণ করা, বিশ্ব বাজারে চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়া, আগের বছরের চামড়া অবিক্রিত থাকা, ট্যানারি মালিক কর্তৃক চামড়ার দাম সময়মত পরিশোধ না করা, ট্যানারী মালিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেট, রপ্তানি বন্ধ থাকা ইত্যাদি কারণে প্রতি বছরই কমছে কুরবানীর পশুর চামড়ার দাম কমছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের দরিদ্র-সাধারণ। কুরবানীর পশুর চামড়ার সঠিক দাম নিশ্চিত করার জন্য সরকার কর্তৃক ন্যায্য দাম নির্ধারণ করা এবং সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর জন্য সরকারের নজর চান কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা।
করোনা ভাইরাসের কারণে টানা গত দুই বছর (২০২০ ও ২০২১ সালে) চামড়ার ব্যবসায় খুব একটা ভাল যায় নি। অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী এ দুই বছরের কোরবানির পশুর চামড়া কিনে লোকসানে পড়েছেন। এমনকি কেউ কেউ চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলেও রেখে গেছেন।
৩০ বছর আগে ১৯৯২ সালে কোরবানিদাতারা এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় চামড়া বিক্রি করেছেন। ২০১৩ সালে দেশে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ছিল ৮৫-৯০ টাকা ও ছাগলের চামড়া ৫০-৫৫ টাকা। ২০২১ সালে সেই গরুর চামড়ার দাম নির্ধারিত হয় ঢাকায় ৪০-৪৫ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৩৩-৩৭ টাকা। এভাবে গত আট বছরে প্রতি বর্গফুটে মূল্য নির্ধারণের স্তর বিবেচনায় গরুর চামড়া ছাগলের চামড়ায় পরিণত হয়েছে। আট বছরের ব্যবধানে কুরবানীর পশুর চামড়ার দাম কমেছে প্রায় ৫২ শতাংশ। এর ফলে ক্ষুব্ধ কোরবানিদাতাদের অনেকে পানির দরে বিক্রি না করে সেই চামড়া মাটিচাপা দিয়েছেন। কেউ ভাসিয়েছেন নদীর জলে। গত দুই-তিন বছর কুরবানীর পর রাস্তায় ও পথে-ঘাটে পড়ে ছিল চামড়া। এতে পরিবেশ দূষিত হয়েছিল চরমভাবে।
এর আগে ২০২০ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৫-৪০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দর ২৮-৩২ টাকা। ২০১৯ সালে ঢাকায় এ দাম ছিল ৪৫-৫০ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা। একইভাবে ২০২০ সালে ছাগলের চামড়ার দর নির্ধারণ করা হয় ১৩-১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০-১২ টাকা। ২০১৯ সালে এ দাম ছিল ১৮-২০ টাকা। অর্থাৎ ওই সময়ে আগের বছরের তুলনায় ছাগলের চামড়ার দাম কমে প্রায় ২৭ শতাংশ। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে টানা তিন বছর প্রতি বর্গফুট গরু চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৪৫-৫০ টাকা। তবে ২০১৭ সালে ছাগলের প্রতি বর্গফুট চামড়া ২০-২২ টাকায় নির্ধারণ করা হলেও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তা আরো কমিয়ে ১৮-২০ টাকা করা হয়। দাম কমিয়ে ২০১৪ সালে গরুর চামড়া ৭০-৭৫ টাকা ও ছাগলের চামড়া ৪০-৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পরপর দুই বছর প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়া ৫০-৫৫ টাকা ও ছাগলের চামড়া ২০-২৫ টাকায় অপরিবর্তিত থাকে।
বাংলাদেশে সারা বছর যে পরিমাণ পশু জবাই হয়, তার ৬০ শতাংশই হয় এ কোরবানীর মৌসুমে। কোরবানী যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকার বা আড়তদারদের কাছে। তারা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। আর ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা প্রতি বছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ফ্রেড এর ইকনোমিক ডাটার চামড়া সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চামড়ার উৎপাদক মূল্য সূচক ছিল ১৫৫ দশমিক১-তে। সেটি গত ২০২১ সালের মে মাসে দাঁড়ায় ২০৬ দশমিক ৩-তে। এর মানে হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে আসন্ন কুরবানীর ঈদে চামড়ার ‘ভালো ব্যবসায়’ হবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও কেমিকেলের দাম বাড়ায় চামড়া শিল্পের বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। কেউ কেউ বলেছেন, বিশ্ব বাজারে চামড়ার দাম যতটুকু বেড়েছে, তা মূলত কেমিকেলের দাম বাড়াতে বেড়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের (২০২১-২২) দুই মাস বাকি থাকতেই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় আগের অর্থ বছরের আয় ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০৩ কোটি দশ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১০১ কোটি ১৭ লাখ ডলার। আগের অর্থ বছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় হয় ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
ব্যবসায়ী ও মানবাধিকার কর্মী আমিনুল হক বাবু বলেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কিছু সিন্ডিকেট এবং তাদের কাছে থেকে যারা চামড়া কেনেন, সেই ব্যবসায়ী বা শিল্প প্রতিষ্ঠান/গ্রুপগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে প্রতি বছর কুরবানীর পশুর চামড়ার দাম কমছে। সাধারণ মানুষ লাভের আশায় কুরবানী করেন না। তাই বলা যায়, কুরবানীর পশুর চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দরিদ্র-সাধারণ। সিন্ডিকেট ভেঙেৃ্গ দিয়ে এবং সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কুরবানীর পশুর চামড়ার ন্যার্য দাম পাওয়া সম্ভব হবে।’
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়ার আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সহ-সভাপতি মো. আব্দুল কাদের বলেন, ‘সরকার এখনো চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় নি। সরকার নির্ধারিত দাম থেকে আমরা দুই-পাঁচ টাকা কমে চামড়া কিনি। প্রতি বছর কুরবানীর পশুর চামড়ার দাম কমার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় গরীব-মিসকিনরা। তাদেরক হক নষ্ট হচ্ছে। ট্যানারি মালিকরা চামড়া রফতানি করে এর ন্যার্য দাম দিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। কোরবানীর পশুর চামড়া দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও ট্যানারী মালিকরা, এ ক্ষেত্রে এতে সরকারের নজর দেয়া উচিত।
সিএন/এমএ
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন