শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

প্রত্যাশার আগুনে নিত্য দহন হওয়া পেশাজীবী

মঙ্গলবার, মে ১১, ২০২১

প্রিন্ট করুন
মোহাম্মদ সাঈদ 3 1

ইব্রাহীম চৌধুরী »


ইতিহাসের প্রথম খসড়া লেখা হয় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। কথাটি আমার নয়। বলেছেন ওয়াশিংটন পোস্টের সহপ্রতিষ্টাতা ফিলিপ গ্রাহাম। ইতিহাসের খসড়া লেখার মহুরি আমরা। একজন সংবাদকর্মির পেছনে ফিরে দেখার অবকাশ অনেক সময়ই থাকে না। সময়ের সাথে চলমান এসব কর্মজীবীদের হাত দিয়েই রচিত হয় ইতিহাসের প্রথম পাÐুলিপি।

আমাদের চলমান সময়টা বড়ই নাজুক। মহামারীর মৃত্যুর মিছিলে দাঁড়িয়ে আমরা সভ্যতার এক কঠিন সময়ের ইতিহাসের পাÐুলিপি নিয়ে কাজ করেছি। কোভিড-১৯ আমাদের অপ্রস্তুত জনপদে হানা দিয়েছিলো। আমাদের কোন ধারনাই ছিলো না, কোন পরিস্থিতিতে আমরা পড়তে যাচ্ছি।

মানব সভ্যতার চরম বিপর্যয়ের সময়ে সাংবাদিকরাই এগিয়ে এসেছে সবার আগে। সদা প্রস্তুত সৈনিকের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করতে। কোভিড-১৯ হানা দেয়া নগরী নিউইয়র্ক মৃত্যুপুরী হয়ে উঠে ধারনার চয়ে দ্রæত। সাইরেন আর এম্বুলেন্সের ভীতিকর পরিবেশ। ঘরে ঘরে মৃত্যু হানা দিয়েছে। কোথায় যাবে লোকজন, বিপন্ন সময়ে কার দিকে হাত বাড়াবে? এমন বাস্তবতায় সাংবাদিকরা থেমে থাকেনি।নিউইয়র্কে এমন কেউ নেই , যে পরিবারের কাউকে বা স্বজন; পরিচিতজনকে হারায়নি। আমরা হারিয়েছি আমাদের সহকর্মি স্বপন হাইকে একদম শুরুর দিকেই। স্বজন পরিজনের শেষ নিঃশ্বাস যখন আমাদের ধাওয়া করছিলো, আমরা আমাদের নিজেদের জীবনকেও বিপন্ন ভাবছিলাম।আমাদের হাত দিয়ে একের পর এক স্বজন, পরিচিতজনের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের বিপন্ন বাস্তবতার বিবরণ উঠে এসেছে।

দ‚র ইতিহাসে দাঁড়িয়ে একদিন মানুষ এ সময়ের চিত্র পাবে আমাদের প্রয়াসের কারনে।ইতিহাসের প্রথম পান্ডুলিপিকার হিসেবে নিউইয়র্কের সাংবাদিকরা তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এসব সংবাদকর্মিরা চাকুরীর জন্য নয়, নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে রেখে কাজ করেছেন পেশার প্রতি প্রতিশ্রæতি থেকে। যুদ্ধের মাঠে একজন সৈনিক যেমন তাঁর নিজের জীবনকে নিয়ে ভাবেন না। সংবাদকর্মিরাও নিজেকে নিয়ে তেমনি ভাবেননি কোভিড-১৯ এর বিপন্ন বাস্তবতায় ।
স্যালুট আমার এসব সংবাদ সহযোগিদের !

আমাদের বিরুদ্ধে আপবাদের কোন শেষ নেই। নানা পেশায় জড়িত লোকজনের ব্যাপারে নিত্য অপবাদ আসে। ধর্মালয়ে নিজেকে উৎসর্গ করা ধর্মগুরুদের নিয়েও অপবাদ আসে। লক্ষ্য করে দেখা যায় , সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপবাদ বড় তীব্র। এর কারন এ পেশার লোকজনের প্রতি মানুষের প্রত্যাশার মাত্রাটি থাকে ভিন্ন পর্যায়ের। অনেক সময় মানুষ তাঁর জীবনের চরম আর্তনাদের কথাটি সাংবাদিকের মাধ্যমে উচ্চারিত হোক, এমনটি চায়।

সাংবাদিকতা এখন সারা বিশ্বে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অবশ্য কখনো এ পথটি মুসৃণ ছিলো না। আমেরিকা স্বাধীন সাংবাদিকতার দেশ। এ দেশের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। অথচ এদেশের প্রেসিডেন্টই কথায় কথায় সাংবাদিকদের নাজেহাল করেন। তাঁর বিরুদ্ধে গেলেই ফেক নিউজ বলেন। প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের গালিগালাজ করেন ।

আমেরিকার বাইরে দেশে দেশে সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কঠোর আইন–বিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ এক নতুন বৈশ্বিক প্রবণতা। সাংবাদিকতা আজ নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার ফলে একজন পাঠকের সামনে সংবাদের অনেক পথ উন্মোচিত হয়েছে। সে এখন আর খবরের কাগজ, টেলিভিশন বা রেডিওর ওপর নির্ভরশীল নয়। যেকোনো খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎক্ষনিক জানা যাচ্ছে।

এখন যার হাতেই একটা স্মার্টফোন আছে, সে তার মতামত প্রকাশ করতে পারছে। তার মতামত একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছেও যাচ্ছে। মতপ্রকাশের এত ব্যাপক স্বাধীনতা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো ছিল না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাংবাদিকতার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। খবরের সত্যমিথ্যা যাচাই বাছাই করার বালাই নেই। লাগামহীন, অসম্পাদিত সব প্রকাশ সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মিথ্যা, মনগড়া কথা প্রচারিত হচ্ছে। অন্যকে হেয় করার জন্য বা বিপদে ফেলার জন্য সাংবাদিকতার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতার ঘাটতি নিয়ে সর্বত্র আজ আলোচনা করা হয়। সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কী প্রকাশ করা যাবে , কী করা যাবে না – তা নির্ধারনের সুযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেই। ফলে আস্থার সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।

পেশাদার সাংবাদিকদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। নৈতিক সাংবাদিকতাকে সুদৃঢ়ভাবে রক্ষা করার কোন বিকল্প নেই। পেশাদার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানুষের অবশিষ্ট আস্থা ধরে রাখতে হবে। নৈতিক অবস্থানে অটল থেকে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। জনগণ সত্য সংবাদ পেশাগত সাংবাদিকদের কাছেই প্রত্যাশা করে। পেশাদার সাংবাদিকতার বিকল্প এখনো কিছু দাড়ায়নি।

সাংবাদিকতার সংজ্ঞা কখনো নিরূপণ করা যায়নি। আদিকাল থেকে হাল আমল পর্যন্ত সাংবাদিকতা এক রহস্যময় পেশার নাম। নানাজন নানাভাবে একে সংজ্ঞায়ীত করেছেন। করে যাচ্ছেন। একমাত্র এ পেশার লোকজনই সত্যটি জানেন।
সত্যটা জানেন না , সাংবাদিকতা নিয়ে নিত্য উপদেশ দেয়া লোকজন। উপদেশ দেয়া লোকজনের কাছে সাংবাদিকতা এক অলীক প্রত্যাশার নাম। আমাদের কাছে কখনো কখনো আলীক প্রত্যাশার আগুনে নিত্য দহন হওয়া পেশাজীবীদের নাম – সাংবাদিক !

ইব্রাহীম চৌধুরী , আবাসিক সম্পাদক
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন