শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

শিরোনাম

প্রীতিলতা—আমরা কি অবদান স্বীকার করতে জানি না?

বুধবার, জানুয়ারী ৪, ২০২৩

প্রিন্ট করুন

নওসাদ শোয়েব:

"আমি নিজেকে, অন্ধকারের দিকে চেয়ে, আত্ম-অহংকারে তাড়িত ও উপহাস্য একটা জীব হিসেবে দেখতে পেলাম, এবং আমার চোখ দুটো ক্ষোভে আর যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ।"

এই এপিগ্রাফটি জেমস জয়েস-এর ছোটগল্প ‘আরাবী’-র সর্বশেষ বাক্য। এই গল্পের নামহীন বক্তা (যে কিনা পুরো গল্পজুড়েই তার এই রাগভাবাপন্ন বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় ছিলো) আরাবী বাজারে যাওয়া নিয়ে খুব রোমাঞ্চিত আর উচ্ছ্বাসিত ছিলো। কিন্তু বাজারের স্থানিক অবস্থা বোঝার পর সেসব আগ্রহ হারিয়ে রাগান্বিত হয়ে গেলো।

একইভাবে, যেদিন আমি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবনে গিয়েছিলাম, আমিও সমানভাবে উচ্ছ্বাসিত এবং শিহরিত ছিলাম এই নিয়ে যে আমি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সম্পর্কে জানতে যাচ্ছি, যিনি ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম নারী শহীদ, কিন্তু ১৮ই ডিসেম্বর, ২০১৯, যখন আমি আর আমার বন্ধু, মিজানুর রহমান বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবন নামের ছয় তলা বিল্ডিং ঘুরা শেষ করেছিলাম। আমার সব আকাঙ্ক্ষা উড়ে গিয়েছিল।

বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান পঙ্কজ চক্রবর্তীর মতে, ভবনটি সম্পন্ন হতে মোট খরচ হয়েছে ৪ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। ভবনটিতে ১২ টি কক্ষ, মহিলাদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে ৩০ টি সেলাই মেশিন, শিক্ষানবিশ আর ফ্রিল্যান্সিং-এর জন্য ৫০টি কম্পিউটার, কিছু বাদ্যযন্ত্রে ভরা লাইব্রেরী নামক একটি শূন্য কক্ষ এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার একটা সুন্দর ভাস্কর্য রয়েছে। প্রীতিলতা তাঁর নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন এই লক্ষ্যে নিয়ে যে, “নারীরা কখনো নিজেদের দুর্বল ভাববে না। কারণ তারা পিছনে থাকার জন্য নিরূপিত নয়, বরং পুরুষের সাথে সক্রিয়ভাবে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য।”

সবকিছুই ঠিক ছিলো কিন্তু লাইব্রারী নামের বড় শূন্য বন্ধ কক্ষটি আমাকে প্রচন্ড হতাশ করেছিলো। কারণ, আমি সেখানে গিয়েছিলাম এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে আমি কিছু অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবো যা অবশ্যই আমাকে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

যাইহোক, ১৯৭১ সনে আমরা একটি জাতি হিসেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিলাম। এবং এটিকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোথা থেকে আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়তে যাবার সাহস পেয়েছিলাম? অবশ্যই বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন আর সাতচল্লিশের ভারতবর্ষ বিভাগ আমাদের পাকিস্তানি পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করেছিলো। কিন্তু ইতিহাসকে সেই ১৯৭১ সাল থেকেই গণতন্ত্রের নামে শাসকগোষ্ঠী নতুনভাবে লিখে আসছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সালে আমার স্কুলজীবন শুরু হওয়ার পর থেকে আমার পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে আমি জানতে পারি, বাংলার প্রথম স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম), কিন্তু ২০০৯ সালে এসে আমি নতুনভাবে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাই।

বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, ভালোবেসে যাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়েছিলো, নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ গঠনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। ইতিহাস সবসময়ই একটি সামষ্টিক ব্যাপার। তবে আমাদের ইতিহাসের প্রতি নিচু আর সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ সমন্বিত ত্যাগ আর পরিশ্রমকে ইতিহাস থেকে বাতিল করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের আগের ইতিহাসকেও মুছে দেয়া হয়েছে বা কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখন এই দেশ ১৯৭১ সালের আগের ইতিহাস ছাড়াই একটি জাতি হয়ে উঠেছে।

আমাদের সংস্কৃতি এবং মিডিয়াতে প্রীতিলতার অবস্থান উল্লেখযোগ্য নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রমে প্রীতিলতা এবং তাঁর মতো অন্যদের খুবই অল্প জায়গা দেওয়া হয়েছে। আমরা কি তবে জাতির অগ্রগতির জন্য তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছি না? নাকি, তাঁদের আত্মত্যাগের প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ আছে? ঘটনাগুলো এমনটাই নির্দেশ করছে নাতো?

আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি এটি একটি সুপরিকল্পিতভাবে গঠিত পরিস্থিতি, তা নাহলে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হতে বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবনের ৫০-টি কম্পিউটার আর ৩০-টি সেলাই মেশিন-এর জন্য কোনো অর্থ প্রদান করা হতো না। নারী ও পুরুষদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য সরকারের কাছে যথেষ্ট অর্থ আর উপকরণ আছে, কিন্তু, বই (যা একটি বুদ্ধগিত প্রতিরোধ–যা আমাদেরকে জাতি হিসেবে সকল অত্যাচার আর চরমপন্থা-র বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে তুলবে, এবং, অবশেষে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবে যা বাংলাদেশের স্বপ্ন এবং তার অস্তিত্বের একটি মৌলিক উপাদান) -এর জন্য কেনো বরাদ্দ নেই?

আমি বলবো, কম্পিউটার এবং সেলাই মেশিন পূর্ণ দুটো আলাদা কক্ষ আর লাইব্রেরী নামক শূন্য কক্ষ মাথায় রেখে বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবন গঠন করা শাসকদের একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যাতে করে তারা এই জাতিকে ইতিহাস শূন্য, দুর্বল সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিজীবী হীন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, এবং এমনই একটা জাতি শাসন করার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট, নিঃসন্দেহে, শক্তিশালী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়তে এমন একটি অস্পষ্ট জাতির কোনো শক্তি বা ধারণা কোনোটাই থাকবে না।

পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি মস্তিষ্কহীন জাতি হিসেবে তৈরি করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো তা এখনও বিদ্যমান, তবে ভিন্ন পন্থায়। বর্তমানে যেসকল উপায়ে জাতি বুদ্ধিদীপ্ত হতে পারে রাষ্ট্র পরিকল্পিতভাবে সেসকল উপায়গুলোকে প্রতিরোধ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবনের লাইব্রেরীতে কোনো বই না থাকা। তুলনামূলকভাবে, দ্বিতীয় পন্থাটি বেশি ভয়ঙ্কর, কেননা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, বুদ্ধিজীবী তৈরি হওয়ার করার উপায়কে নয়।

পরিশেষে, আমাদেরকে বাঙালি সত্ত্বা-র ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত, কেননা, স্টুয়ার্ট হল-এর মতে, “identity as being” হলো অনেকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি সামষ্টিক সত্য যা আমাদের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মহিমান্বিত ইতিহাসকে রিপ্রেজেন্টেশেনের (উদাহরণস্বরূপ, চলচ্চিত্র, গান, নাটক ইত্যাদি) মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যাতে করে তুলনামুলকভাবে উৎকৃষ্ট বাঙালি সত্ত্বা তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি করা যায়- যা সময়ের সাথে বিকশিত হবে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র আর উন্নয়নের নামে জাতীয় চেতনার অবমাননার বিরুদ্ধে প্রশ্ন দাঁড় করাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন