শাহীন চৌধুরী ডলি
ইতিহাস বলে শত বছরের শোষিত জাতির নাম বাঙালি জাতি। যুগে যুগে নানা শাসকগোষ্ঠী শোষণ করেছে পলি মাটিতে গড়া ব-দ্বীপ দেশটিকে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে বাঙালি। হয়েছে বঞ্চনা ও যন্ত্রণার শিকার। শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালি ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে বাঙালির নবজীবনের সূচনা করে। আমরা পাই বহু আকাঙ্খিত স্বাধীন দেশ। লাল – সবুজের পতাকা। বিশ্বের বুকে আবির্ভূত হয় একটি গর্বিত জাতি। সবুজ – শ্যামল ভূখণ্ডের রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
প্রতিটি বিজয়ের পেছনে থাকে বহু সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে ব্যক্তি স্বার্থ ও দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেছেন আপামর বাঙালি। লাখো শহীদ তাদের রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে বিজয়ের স্বাদ দিয়েছিল আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশকে। পরাধীনতার হাত থেকে দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে নিজের সম্মান বিলিয়ে দিতে হয়েছে লাখো নারীকে। এই বিজয় গৌরবের, আনন্দের। এই বিজয়ের জন্য যারা জীবন দিয়েছে সবাই পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার, দুঃশাসন, থেকে মুক্তির জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
১৯৭১ সালে বিজয়ের দুইদিন আগে ঠিক বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা হারিয়েছি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন৷ চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হাজার হাজার বরেণ্য বাঙালি শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ওপর চালায় নির্মম – নিষ্ঠুরতম নির্যাতন, তারপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের অনিবার্য পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওরা জানতো, বাঙালি জাতির সূর্য সন্তানরা বেঁচে থাকলে এই দেশের মাটিতে ওদের মতো বেঈমানদের স্থান হবে না। পিশাচরা পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা ও কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল নির্মম আঘাতের চিহ্ন, চোখ -হাত- পা ছিল বাঁধা অবস্থায়। কারো শরীরে ছিল একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ভয়াবহ ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকের পক্ষেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। মিরপুরের বধ্যভূমিতে জলা-জংলায় ফেলে রাখা হয় নক্ষত্রপ্রতীম শ্রেষ্ঠ মানুষদের মৃতদেহগুলোকে। জালিমরা তালিকা ধরে ধরে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মুনীর চৌধুরী, শহীদল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ফজলে রাব্বী, আলীম চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, আলতাফ মাহমুদ, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য সহ হাজারেরও বেশি বুদ্ধিজীবীকে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা দীর্ঘ। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশে তথ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ নামে একটা বই প্রকাশ করে। সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ১ হাজার ৭০ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি শহীদ বুদ্ধিজীবী গ্রন্থকোষ প্রকাশ করে। এই বইয়ে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা আরেকটু নির্দিষ্ট করা হয়। ২০১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম পরিচয় কোষগ্রন্থটিতে স্থান পায়। ততদিনে অনেকের ঠিকানাসহ তথ্য দুর্লভ হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জাতির যে ক্ষতি হয়, যে মেধাশূন্যতা তৈরি হয়, তা আজও পূরণ হয়নি৷ বিশ্বের আর কোন দেশে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মতন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করার নজির নেই৷ স্বাধীন দেশেও আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী ও অবরুদ্ধ দেশের লড়াকু মানুষদের প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর স্মৃতিঘেরা শোকাবহ দিন যা ইতিহাসের পাতায় বেদনাবিধুর কালো দিবস । প্রতিবছর জাতি শ্রদ্ধার সাথে এই দিনটি স্মরণ করে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর কেটে গেলেও শহীদদের স্বজনদের আশা, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী ঘৃণ্য নরপশুসহ সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে। তাদের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি মুক্তি পাবে কলংকের হাত থেকে। শান্তি পাবে শহীদের বিদেহী আত্মা। ১৪ ডিসেম্বরে শহীদ হওয়া সকল বুদ্ধিজীবী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি রইলো অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন