আবদুচ ছালাম: মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জনের ৫০ বছর পূর্তিতে চট্টগ্রামবাসীকে জানাই বিজয়ের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার মাইলফলক হয়ে থাকবে ২০২১। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সব শর্ত পূরণে সক্ষম হওয়ায় বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তালিকাভুক্তির সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেস কোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ারদী উদ্যান) মুক্তিকামী লাখো জনতার সামনে রাখা ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবর রহমান যে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, সেই সংগ্রামের পথে ওই মাসেই তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদার ও দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে নির্দেশিত পন্থায় দীর্ঘ নয় মাস মরণপন লড়াই শেষে ১৬ ডিসেম্বর গৌরবময় বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিকে হানাদার মুক্ত করে বীর বাঙালি, বীর মুক্তিসেনারা। এতে আমরা বাঙালি জাতি একেবারে নিজেদের একটি মুক্ত-স্বাধীন ভূখন্ড লাভ করি।
স্বাধীনতা ও বিজয়ের পর পাকিস্তানী কারাগার ও ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপকার, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা ডাক দিয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তির। স্বাধীনতার পর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাচ্ছিল্য করে বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস তথা তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিলেন। দারিদ্র পীড়িত বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছতে পেরোতে হয়েছে দুর্গম পথ। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এ উত্তরণ বঙ্গবন্ধু সূচিত অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের সফল বাস্তবায়ন। অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের অকুতোভয় শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে। তারা তাদের এ হীন ষড়যন্ত্রে সফল হতে পারেনি। শেখ হাসিনা তাদের ষড়যন্ত্রের সব জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরেই বঙ্গবন্ধুর অসীম মনোবল, প্রজ্ঞা ও দুরদর্শী নেতৃত্বে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পূনর্গঠন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এনে দিয়েছিলেন সাত দশমিক চার শতাংশ।
১৯৭২ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪ মার্কিন ডলার। ১৯৭৫ সাল নাগাদ সেটি ২৭৮ ডলারে উন্নীত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকার। মাত্র সাড়ে তিন বছরে কোন দেশের মাথাপিছু আয় তিন গুণ বৃদ্ধির নজির পৃথিবীতে বিরল। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়াতে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার যে সাফল্য দেখিয়েছিলেন, তার ধারাবাহিকতা পরবর্তী সরকারগুলো তথা জিয়া, এরশাদ ও খালেদা সরকার ধরে রাখতে পারেনি। এ সময়টাতে তারা বাংলাদেশকে অনেকটাই পিছিয়ে দেয়। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫১০ ডলার। আর ২০০৮ সালে জনগণের মেন্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে চমক সৃষ্টি করেছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলি নদীর নিচ দিয়ে টানেল, মেট্রো রেল- এগুলো এখন স্বপ্ন নয়, বাংলাদেশের বাস্তবতা। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ১৯২ কিলোমিটার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন চার লেনে উন্নীত হয়েছে। কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতু নির্মিত হয়েছে। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে ঢাকা-মাওয়া চার লেনের সড়কটির কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক পাল্টে দিয়েছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি, পায়রা নদীর ওপর পায়রা সেতু, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশন থেকে মাওয়া পর্যন্ত মহাসড়ক, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ। এভাবে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে স্বস্তি আনতে ২৭৬ প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে শেখ হাসিনার সরকার। নতুন করে আরো ৩৪১টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক হাজার ১৪০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণ ও জেলা মহাসড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণের কাজ চলমান। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত আট হাজার ৭০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে র্যাম্পসহ ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এগিয়ে চলেছে। সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি রেলপথে লেগেছে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ছোঁয়া। আনা হয়েছে নতুন নতুন ইঞ্জিন ও কোচ। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন রেলপথ। রেলপথ উন্নয়নে ২০১৬-২০৪৫ মেয়াদে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টার প্ল্যান নেওয়া হয়েছে। রেলপথ সম্প্রসারণ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, রেলপথকে ডুয়াল গেজে রূপান্তরকরণ, নতুন ও বন্ধ রেলস্টেশন চালু করা, নতুন ট্রেন চালু ও ট্রেনের সার্ভিস বৃদ্ধি করা এবং ট্রেনের কোচ সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। চট্টগ্রাম দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৯০০ কিলোমিটার ডুয়াল গেজ ডাবল রেল ট্র্যাক নির্মাণ, এক হাজার ৫৮১ কিলোমিটার নতুন রেল ট্র্যাক নির্মাণ, এক হাজার ৫২৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক পুনর্বাসন, ৩১টি লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ১০০টি যাত্রীবাহী কোচ পুনর্বাসন এবং ২২২টি স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থার মানোন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। কুমিল্লা, লাকসাম হয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডাবল ট্র্যাক দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণ ট্র্যাক দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণ, ভাঙ্গা জংশন (ফরিদপুর) থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, নাভারণ থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত এবং সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ এবং ঢাকা শহরের চারদিকে বৃত্তাকার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করতে চায় সরকার।
২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যু উৎপাদনের মহা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। গ্যাস সংকট মোকাবেলায় এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নৌপথ খননের কাজ চলছে। দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে নতুন কনটেইনার টার্মিনাল, ওভারফ্লো কনটেইনার ইয়ার্ড, বে-টার্মিনাল, বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ ও জলযান সংগ্রহে অনেকদুর এগিয়েছে সরকার। দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর যাত্রী ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতার মান ও পরিধি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ চলমান। কক্সবাজার ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। বাগেরহাট জেলায় খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণসহ যশোর, সৈয়দপুর ও বরিশাল বিমানবন্দর এবং রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার।
বহুমুখী উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়ন করে ২০৪৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে তার রজত জয়ন্তী উৎসব পালন করবে- এতে কোন সন্দেহ নেই। বিজয়ের গৌরবে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির শক্ত হাতের পরিচালনায় সদর্পে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ- এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ফের সবাইকে জানাই বিজয়ের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কোষাধ্যক্ষ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন