রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫

শিরোনাম

বেলালের আজানের সুরে নেমে আসত ফেরেশতারা

রবিবার, অক্টোবর ১৯, ২০২৫

প্রিন্ট করুন

গাঢ় বাদামি বর্ণের অথচ সোনার হৃদয়ধারী মানুষের দেশ আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া। যাদের শারীরিক গঠনে রয়েছে বিশালতা, তবে অন্তরে বিরাজমান কোমলতা।

কথায় সুর, চরিত্রে অবিচলতা—এসবই তাদের গুণাবলী। এমনই এক জাতির দম্পতির নাম রাবাহ–হামামাহ। দুজনেই ছিলেন মক্কার জুমাহ গোত্রের ক্রয়কৃত ক্রীতদাস। পরিচয়ে দাস-দাসী হলেও মহান রব তাদের কোলে দান করেছিলেন সেই প্রবাদপুরুষ, যার কথা শুনলে পাষাণ হৃদয় বিগলিত হয়, আঁখি অশ্রুসিক্ত হয়ে যায় প্রতিজনের; যার ইতিহাস পড়লে ঈমানের তেজোদীপ্ততা বৃদ্ধি পায় বহুগুণে।

মালিকের প্রতি আস্থার এক অনন্য নিদর্শন পাওয়া যায় যাকে জানলে—তিনি আর কেউ নন, ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন সাইয়েদুনা বিলাল ইবনে রাবাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু।

অল্প কথায় তার ইসলাম গ্রহণ-পরবর্তী স্থিরচিত্র—ঈমানের অবসাদগ্রস্ত অবস্থা থেকে মুসলিম উম্মাহর প্রথম মুয়াজ্জিন হয়ে ওঠার গল্পটা জানব আজ।

মক্কা নগরীতে তখনও জাহেলিয়াতের জয়জয়কার। লাত–উজ্জার পূজাই যাদের মুখ্য ইবাদত—বিলালের মনিব খলফপুত্র নৃশংস উমাইয়াও সেই হতভাগাদের একজন। ইসলাম কবুলের আগ পর্যন্ত তো সবকিছু স্বাভাবিকই চলছিল, কিন্তু ঈমান আনাটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল সাহাবি বিলালের জন্যে।

ইসলামের সূচনা লগ্নের চিরসৌভাগ্যবান গুটিকয়েক সাহাবি—উম্মুল মুমিনীন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ, আবু বকর সিদ্দিক, আলী ইবনে আবু তালিব, আম্মার বিন ইয়াসির ও তাঁর মা সুমাইয়া, সাহাবি সুহায়ব আর রুমি এবং আল মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রাযিয়াল্লাহু আনহুম।

তারা সকলেই প্রচণ্ড তিরস্কার, ভয়ানক জুলুমের সম্মুখীন হয়েছেন। অতিষ্ঠ হয়েছেন কাফিরদের অত্যাচারে। কত অবসন্ন সকাল পেরিয়ে শ্রান্ত বিকেল কাটিয়েছেন শুধু এক ইসলাম গ্রহণের কারণে—তারও হিসাব অজানা।

কিন্তু বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারটা একদমই ভিন্ন। তিনি শুধু জুলুমের শিকারই হননি, বরং জয় করেছেন দোজাহানের বাদশাহর হৃদয়। স্বর্ণাক্ষরে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের দীপ্ত পাতায়। দ্বীনকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসে চির আদর্শ হয়ে আছেন সমগ্র উম্মাহর কাছে।

ভাবুন তো—এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ধরনে কৃষ্ণবর্ণের, চেহারা-সুরতে আফ্রিকান, একটু মোটা ঠোঁট, চ্যাপ্টা নাসিকা, আবার পরিচয়ে একজন দাস, যার বংশ লাপাত্তা। এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে কেন আমাদের এত চর্চা, এত আলোচনা?

হাদিস ও ফিকহের প্রতিটি কিতাবে যার নাম একবার হলেও ধ্বনিত হয়, উচ্চারিত হয় সম্মানের সাথে। নাম শেষে বলতে হয়—রাযিয়াল্লাহু আনহু। লম্বা কৃষ্ণবর্ণ ছিপছিপে গঠনের মানুষ হলেও প্রিয় বিলালের অন্তর ছিল এতটাই উজ্জ্বল যে, আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসায় তিনি হয়ে ওঠেন ইসলামের অমর প্রতীক। কিন্তু কিভাবে? কী করে গড়লেন এ কীর্তি?

মক্কার তপ্ত মরুভূমির বুকে জ্বলন্ত বালুর ওপর ফুটন্ত বিশ্বাসের এক অনন্ত প্রতীক বিলাল হাবশি রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন জালেম উমাইয়ার মালিকানায় ছিলেন দাস হয়ে, জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি রবের তরে।

জ্বলন্ত মরুর উষ্ণ বালুকণা, পোশাক খুলে জ্বলন্ত আঙ্গারে রূপ নেয়া লোহার বর্ম পরানো, নাদান উমাইয়া আর বদবখ্ত আবু জেহেলের চাবুকের আঘাতে পিঠ রক্তাক্ত করে দেয়া, দুষ্ট বালকদের হাতে উঁচু-নিচু পাহাড় আর উত্তপ্ত মরুর পথ ধরে টেনে হেঁচড়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা—কোনোটাই বন্ধ করতে পারেনি বিলালের মুখনিঃসৃত জান্নাতি বাণী—‘আহাদ! আহাদ!’। এরকম জুলুমের শিকার হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মন একবারও ঝুঁকেনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও দিকে।

তার জবান একবারও উচ্চারণ করেনি লাত–উজ্জার অপবিত্র নাম। গেয়েছেন শুধুই রবের গীতি—“আহাদ! আহাদ!” আল্লাহ এক, আল্লাহ অদ্বিতীয়। জীবনের এই চরম বিপ্রকৃত পরীক্ষায় পাশও করেছেন তিনি অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে।

তাই তো প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাকে আপন করে। দয়াময় আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে চিরকাল স্মরণীয় করে রেখেছেন তাঁকে পৃথিবীর বুকে। আজও বিলাল অমর আমাদের মাঝে।

যখন আজানের বিধান আসল, নবীজি একবারও না ভেবে, কোনো প্রকার বাছাই ছাড়াই নির্দেশ দিলেন—“হে আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ! তোমার স্বপ্নে দেখা আজানের বাক্যগুলো শিখিয়ে দাও বিলালকে। বিলালই হবে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন।” এরপরেই বিলালের কণ্ঠে এ ধরার বুকে প্রথম বারের মতো মুখরিত হলো আজানের সুমধুর সুর— আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।

তাকে বারবার বলা হয়েছিল, ধর্ম ত্যাগ করতে। অমানবিক নির্যাতনের প্রতিটি ক্ষণে তাকে বলা হয়েছিল, “তোমার রবকে অস্বীকার করো।” কিন্তু যতবার বলা হয়েছে, ততবারই তার জিহ্বা কেঁপে উঠেছে একই উচ্চারণে—“আহাদ, আহাদ, আহাদ।”

অবাক লাগে, তিনি তো চাইলে একটু হেকমত দেখিয়ে কিছু একটা বলে বাঁচতে পারতেন। শরীরের ক্ষতগুলো লুকিয়ে ফেলতে পারতেন সাময়িকভাবে। কিন্তু তিনি হেকমতের আশ্রয় নেননি, নিয়েছিলেন আজিমতের। কারণ তিনি জানতেন, হেকমত জীবন বাঁচায়, কিন্তু আজিমত ইতিহাস গড়ে।

যদি তিনি আমাদের মতো একটু আঘাত দেখেই হেকমতের পথে হাঁটতেন, তাহলে কি আজ ইতিহাসে “বেলাল” নামে কোনো অধ্যায় থাকত? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ে কি তিনি এত প্রিয় হতে পারতেন?

মক্কার রক্তাক্ত বালুকণায় তার “আহাদ” ধ্বনি যদি স্তব্ধ হয়ে যেত, তাহলে মদীনায় প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে তার কণ্ঠে কি বেজে উঠত আজানের সূর? সেই আজানের সুরে নেমে আসত কি ফেরেশতারা?

যে বেলাল একদিন আজান না দিলে জিবরীল আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে নেমে আসতেন কারণ জানতে— সে কি কেবল এক দাস ছিল? না, সে ছিল ঈমানের প্রতীক, অটল বিশ্বাসের অনির্বাণ আলো। হযরত উমর রাযিআল্লাহু আনহু যখন জেরুজালেম জয় করে বায়তুল মুকাদ্দাসে দাঁড়িয়ে বললেন, “বেলাল, একবার আজান দাও,” তখন বেলালের কণ্ঠে উঠেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে আবেগময় আজান।

সেই আজানে রাসূলের স্মৃতি ফিরে এসেছিল, আর মানুষ হাউমাউ করে কেঁদেছিল— কারণ তারা শুনছিল এক বেলালের কণ্ঠে ঈমানের চূড়ান্ত সুর।

আজও যখন কেউ বেলালের নাম নেয়, তখন আকাশে বাতাসে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে— যেন ফেরেশতারা থেমে যায় সেই সুর শোনার জন্যে। বেলালের গল্প মানে কেবল ইতিহাস নয়, এটা ঈমানের গল্প, এটা অটলতার গল্প, এটা সেই আত্মার গল্প যে বলেছিল, “আহাদ” — আর পৃথিবী জবাব দিয়েছিল, “সত্যিই, একমাত্র তিনি-ই আহাদ।”

লেখক: শিক্ষার্থী; দারুল উলুম রামপুরা ঢাকা, ১২১৯

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন