ইফতেখার সৈকত: করোনা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ—দুইয়ে মিলে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। একে একে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সব পণ্যে। গেলো কিছুদিন আগে তমুল ঝড় বয়ে গেছে দেশটির ব্যাংকিং খাতে। সেই ঝড়ে অনেক ব্যাংক আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। দেশটিতে এবার নতুন শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই।
জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছর ধীরে ধরে কমে আসছে চাকরির সুযোগ। বেড়ে যাচ্ছে বেকারত্বের হার। ফেডারেল রিজার্ভের নীতিনির্ধারকরা ইতিমধ্যেই পূর্বাভাস দিয়েছেন যে এই বছরের শেষ নাগাদ বেকারত্বের হার বেড়ে ৪.৬ শতাংশ হতে পারে, যা ঐতিহাসিকভাবে মন্দার সাথে যুক্ত একটি বড় বৃদ্ধি। করোনাকালেই মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যামাজন আর ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল জনবল নিয়োগ দিয়েছিল৷ কারণ সেসময় এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার চাহিদা হুড়মুড়িয়ে বাড়ছিল৷ কিন্তু রেকর্ড ছুঁয়ে স্থায়ী হওয়া মুদ্রাস্ফীতি আর পরিচালনা খরচ বিপুল বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ছাঁটাইয়ের পথে হাটছে।
শুরুতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মতো ব্যাপার মনে হলেও এখন সেটা রীতিমত জলস্রোতে পরিণত হয়েছে৷ বাঘা বাঘা মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন হাজারও কর্মী ছাঁটাই করছে৷ করোনাকালের বিধিনিষেধ এসব প্রতিষ্ঠানের মুনাফায় লাগাম টেনেছিল, এখন তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় মুনাফা বাড়াতে উদ্যোগী তারা৷ গত ১২ মাসে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সবমিলিয়ে ৩ লাখ ৩০ হাজারের বেশি কর্মী ছাঁটাই করেছে৷ এরমধ্যে ৯০ হাজারের চাকরি গেছে চলতি বছর৷ যেহেতু মুদ্রাস্ফীতি এখনো বেশ উঁচু, আর সুদের হার বাড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কা করা হচ্ছে যে মার্কিন অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও প্রযুক্তি খাতের এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ তবে, অর্থনীতিবিদেরা বলছেন ভিন্ন কথা৷
ফিচ রেটিংসের মার্কিন আঞ্চলিক অর্থনীতিব বিভাগের প্রধান ওলু সিনোলা বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের হার করোনা মহামারির আগের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি, যেখানে বর্তমানে সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থানের হার সেসময়ের চেয়ে কিছুটা বেশি৷ এর অর্থ হচ্ছে ২০২১ এবং ২০২২ সালে এই খাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে৷
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আগের থেকে চরম অবনতির দিকে গেছে। এপ্রিল মাস দেশটির অর্থনীতিতে আরও বড় ধস নামাতে পারে বলেও শঙ্কা করা হচ্ছে প্রতিবেদনগুলোতে।
বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন অর্থনীতি ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। এটি শেষ পর্যন্ত স্টক মার্কেটকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে কারণ বিনিয়োগকারীরা অনুমান করে যে খারাপ খবর ফেডারেল রিজার্ভকে তার সুদের হার বৃদ্ধি বন্ধ করতে বা কঠোর করতে প্রলুব্ধ করবে কিনা।
দেশটির চাকরির বাজারও সন্তোষজনক নয় বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিকভাবে গরম শ্রম বাজার দুর্বল হতে শুরু করেছে। এডিপি চাকরির প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে মার্চ মাসে ১ লাখ ৪৫ হাজার চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।যিা প্রত্যাশার তুলনায় ৬৫ হাজার কম। ফেব্রুয়ারীতে যে সংখ্যা ছিলো ২ লাখ ৬১ হাজার।
অর্থনৈতিক দুর্বলতা এখানে থামেনি। ২০২১ সালের মে থেকে প্রথমবারের মতো ফেব্রুয়ারিতে চাকরির সুযোগ ১০ মিলিয়নের নিচে নেমে গেছে এবং সাপ্তাহিক বেকার গত সপ্তাহে ২ লাখ ২৮ হাজার ছুঁয়েছে, যা বিশ্লেষকদের প্রত্যাশার ২ লাখ হতে পারে।
আটলান্টা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক দুর্বল অর্থনৈতিক তথ্যের নোটিশ দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে তারা জিডিপি পূর্বাভাসকে যথেষ্ট কমিয়ে দিয়েছে। মার্চের শেষের দিকে জিডিপির পূর্বাভাস প্রথম ত্রৈমাসিকে মার্কিন অর্থনীতি ৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করেছিল। দুই সপ্তাহ পরে সংস্থাটি জিডিপি পূর্বাভাস মাত্র ১.৫ শতাংশ দেখাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্বঠানের উৎপাদন এবং বিক্রয়ও কমেছে। এছাড়া দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরা ব্যবসায়ীদেরও হিমসিম খেতে হচ্ছে।
কর্মী ছাঁটাইয়ে কর্পোরেট জায়েন্টরা
গত ২ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য প্রযুক্তি সংস্থা কভার মাই মেডস কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়। সংস্থার ৮১৫ কর্মীকে বরখাস্ত করা হবে বলেই জানানো আর্থিক মন্দার কারণেই কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্বাস্থ্য প্রযুক্তি সংস্থা। কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি স্কটসডেলের অফিস বন্ধ করার পরিকল্পনাও করছে মার্কিন স্বাস্থ্য প্রযুক্তি সংস্থা কভার মাই মেডস।
এদিকে চলতি সপ্তাহ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সব অফিস সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে পারে বিশ্বের জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল রবিবার (২ এপ্রিল) তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে করপোরেট কোম্পানিটি কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এমন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে ম্যাকডোনাল্ডসের যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীদের একটি ই-মেইল পাঠায়। সোম থেকে বুধবার পর্যন্ত নিজ নিজ বাড়িতে কাজ করতে অনুরোধ করা হয়। কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর যেন মেইলে জানানো যায়।ম্যাকডোনাল্ডস ঠিক কতজন কর্মী ছাঁটাই করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। শিকাগোভিত্তিক কোম্পানিটির একটি ইমেইল দেখেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। তাতে বলা হয়েছে, ৩ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহে আমরা পুরো সংস্থাজুড়ে কর্মীদের ভূমিকা ও সংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত মূল সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করবো।
দুই হাজারের বেশি কর্মী ছাঁটাই করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টও। প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি ওয়্যারহাউস থেকে এসব কর্মী ছাঁটাই করবে। ওয়ালমার্ট বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বেসরকারি কোম্পানি। ৬০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই কোম্পানিতে কাজ করেন ২৩ লাখ কর্মী। ওয়ার্কার অ্যাডজাস্টমেন্ট রিট্রেনিং নোটিফিকেশন (ওয়ার্ন) ফাইলিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, ওয়ালমার্ট টেক্সাস থেকে এক হাজার, পেনসিলভানিয়া থেকে ৬০০, ফ্লোরিডা থেকে ৪০০ ও নিউজার্সি থেকে ২০০ জন কর্মী ছাঁটাই করবে।
ওয়ালমার্ট এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গ্রাহকদের প্রয়োজনের জন্য নিজেদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করার জন্য এই প্রতিযোগিতার বাজারে ওয়্যারহাউসের কর্মীদের স্তর সমন্বয় করা হচ্ছে। খুব কঠোরভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে যেসব কর্মী চাকরি হারাবেন তাদের অনেকেই প্রতিষ্ঠানটির অন্য ওয়্যারহাউসে চাকরির সুযোগ পাবেন।
ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজন গত মার্চে আবারও ৯ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে গত জানুয়ারি মাসে ১৮ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয় অ্যামাজন। সারা বিশ্বে অ্যামাজনে প্রায় ৩ লাখ করপোরেট কর্মী আছেন। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে প্রতিষ্ঠানটি ২৭ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে, যা মোট কর্মীর ৯ শতাংশ। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা ১ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গেছে।
অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সারা বিশ্বের শ্রমবাজার এখন অস্থিতিশীল। প্রায় সময় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে। ২০২২ সালের শেষ দিকে গুগল, মেটা, টুইটারসহ বড় বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বে প্রথম একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঢল শুরু হয়। সেই ঢল এখনো অব্যাহত। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও অর্থ, গণমাধ্যম, অটোমোটিভসহ আরও নানা সেক্টর থেকে কর্মী ছাঁটাই চলছে।
সমস্যা বিদেশি শ্রমিকদের
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জীবিকার তাড়নায় ছুটে যান বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বাসিন্দারা। আর সেখানে গিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের জড়ান বিদেশিরা। ওয়ালমার্ট, ম্যাকডোনাল্ডসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করেন অসংখ্য বিদেশি। আর প্রতিষ্ঠানগুলো যে হারে কর্মী ছাঁটাই করছে তাতে বাইরের দেশ থেকে আসা মুনষদের সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন