জাহিদ শিকদার :
‘একাত্তরের দিনগুলি’ জাহানারা ইমামের লেখা এক অনবদ্য সৃষ্টি , যা একটি দিনলিপি রচনার মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের এক মূল্যবান দলিল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।যার মধ্যে জাহানারা ইমাম তৎকালীন (১৯৭১)সময়ের বাস্তব চিত্র অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠার সহিত তুলে ধরেছেন যা বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলাদেরকে কালজয়ী নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সাথে সাথে ঢাকা নগরের চিত্র বর্ণনার মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী ভয়াবহ চিত্রের জাল বিস্তারের বর্ণনা দিয়েছেন, সাথে ক্রোধ, ক্ষোভ ও গেরিলাদের মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাবে শিহরণ জাগানো ভাষায় বর্ণনা করে মুক্তিযুদ্ধকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন পাঠক হৃদয়ে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক রচিত ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তে মার্চ – ডিসেম্বর মাসের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং বর্ণিত মাসগুলির মধ্যে ১৬৮ দিনের বর্ণনা তুলে ধরেছেন।তার এই বর্ণিত দিনগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে বাঙালীর ক্ষোভ,আন্দোলন ও সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন,মায়ের অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও ভূমিকা,গেরিলাদের একের পর এক সাহসী অভিযান, হানাদার বাহিনীর গা শিহরানো নির্যাতন, অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর চিত্র ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সাহায্যের চিত্র।মার্চের ১ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ পর্যন্ত উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে ভাগ করলে প্রতিটি মাসে যে বর্ণনাগুলো স্থান পায় তা নিম্নরূপঃ
মার্চ: অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে সর্বস্তরের জনগনের ক্ষোভ,আন্দোলন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোপন ষড়যন্ত্র।
এপ্রিল: অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর ভয়াবহ চিত্র।
মে: অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর চিত্র,গেরিলা বাহিনী গঠন,মুক্তিফৌজের হালকা মাথাচারা।
জুন: গেরিলা বাহিনীর সক্রিয়তা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি, বিদেশীদের সাহায্য, হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধ্বংসযজ্ঞ স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা।
জুলাই: মুক্তিযোদ্ধা আর গেরিলাদের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শুরু।
আগস্ট: গেরিলা বাহিনীর সফল অভিযান,গেরিলা বাহিনীর অনেকে হানাদার কর্তৃক গ্রেপ্তার, মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেনীর সাহায্য।
সেপ্টেম্বর: গেরিলাদের উপর অমানবিক নির্যাতন।
অক্টোবর: গেরিলাদের আবার শক্তিশালী হয়ে উঠার কাহিনী।
নভেম্বর: মুক্তিযুদ্ধের জয়ের মাত্র অতিদ্রুত অগ্রসরমান।
ডিসেম্বর: বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন,আনন্দের কান্নায় সকলের প্রানভর্তি ভালোবাসার হাসি এবং সর্বোপরী মার্চ – ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতিটি মাসে মায়ের ভূমিকা বিদ্যমান।
জাহানারা ইমামের এই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ যা চির মানব হৃদয়জয়ী একটি দিনলিপি। এই দিনলিপির বর্ণিত ১৬৮ দিনের দিনগুলোকে যদি নিম্নোক্ত বিষয়ের আলোকে ব্যাখা করা যায়, তাহলে এই বইটির কিছুটা হলেও স্পষ্টভাবে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব।
(১) স্বাধীনতা যুদ্ধকে সার্বিকভাবে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক মানুষের সমর্থন।
(২)অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর চিত্র।
(৩) গেরিলাদের কাহিনী।
(৪) মায়ের ভূমিকা।
আর উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ভূমিকা এবং রাজনৈতিক চিত্র উপরোক্ত ৪ টি বিষয়ের মধ্যেই লক্ষ্য করা যাবে।
(১) স্বাধীনতা যুদ্ধকে সার্বিকভাবে দেশপ্রেমিক মানুষের সমর্থন:
এই দিনলিপিটি শুরু হয়েছে পহেলা মার্চ থেকে। ১ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় বাংলার আপামর জনতা রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ছাত্র, কৃষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যেমন ১ লা মার্চ ১৯৭১ এ:
(ক) শেখ মুজিব হোটেল পূর্বাণীতে প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন।
(খ) বটতলা,পল্টনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
(গ)পাকিস্তানি ফ্লাগ আর জিন্নার ছবি পোড়ানো।
(ঘ)গুলিস্তানের মোড়ে কামানের উপর দাঁড়িয়ে মতিয়া চৌধুরীর আগুন ঝরানো বক্তৃতা ইত্যাদি।
২, ৩, ৫, ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন বাঙালি জনতার হরতাল, সমাবেশ চলমান, পাকিস্তানি সরকারের সামরিক আদেশ জারি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে দোকানপাট, ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং ইয়াহিয়া খানের ২৫ মার্চ অধিবেশন ডাকার ঘোষণা প্রদান।
অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে পূর্ব পাকিস্তানে ভিমরুলের চাকে ঢিল ছুড়েছে।
৭ মার্চে বাঙালির আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের ঘোষণা।
১০, ১৪, ১৫ মার্চে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর স্বাধীনতার সমর্থনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল গঠন এবং অনেকের খেতাব বর্জন লক্ষ্যনীয়।
১৪ মার্চে গঠিত হয়েছে “লেখক সংগ্রাম শিবির” নামে কমিটি; যার সভাপতি আহমেদ শরীফ।
সদস্যঃ সিকান্দার আবু জাফর, শওকত ওসমান,শামসুর রাহমান সহ আরও অনেকে।
বেতার টেলিভিশন শিল্পীরা গড়ে তুলেছেন “বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ “
যার সভাপতি সৈয়দ আবদুল হাদী।
১৫ মার্চ অনেক বিখ্যাত মানুষের খেতাব বর্জন।যেমন: জয়নুল আবেদীন বর্জন করেছেন ‘হেলালে ইমতিয়াজ’ খেতাব, মুনীর চৌধুরী বর্জন করেছেন ‘সিতারা – ই- ইমতিয়াজ’ খেতাব, নাটোর হতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডাঃ মোবারক হোসেন ‘ তকমা – এ পাকিস্তান ‘,ফরিদপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শেখ মোশাররফ হোসেন তকমা – এ কায়েদে আযম ‘ খেতাব বর্জন,দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন বর্জন করেন ‘ সিতারা – ই খিদমত’ ও ‘সিতারা – ই ইমতিয়াজ ‘ এবং আরো অনেকে।
পটুয়া কামরুল হাসান কর্তৃক বিভিন্ন স্টিকার তৈরি।যেমন একটি স্টিকার হলো “একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন”।
১৭, ২০, ২৫ তারিখ বর্ণনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের কথা।
(২)অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর চিত্র:
জাহানারা ইমাম তার ” একাত্তরের দিনগুলি” বইটিতে কয়েক মাস ব্যাপী অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর চিত্র তুলে ধরেছেন। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর চিত্র আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়গুলো আসে, সেগুলো হলো: হানাদারদের অত্যাচার,অনবরত কারফিউ,বিহারিদের নৃশংসতা, ধর্ষণ,সাধারণ জনগণের হতভম্বের মতো এদিক ওদিক ছোটাছুটি।
প্রথমে মার্চ মাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় মার্চের ১৭, ২০, ২৫ তারিখ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। ১৭ তারিখের এক বর্ণনায় ” প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ,প্রিন্সিপাল স্টাফ লেফঃ জেনারেল পীরজাদা,মেজর জেনারেল ওমর এবং আরও ছয়জন ঢাকায় এসেছেন”। ২০ মার্চে ভুট্টো এসেছেন বারোজন উপদেষ্টা নিয়ে। ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস পালনের পর ২৫ মার্চের বর্ণনায়, “চট্রগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ এসে ভিড়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।সে অস্ত্র চট্রগ্রামের বীর বাঙালিরা খালাস করতে দিবে না বলে মরণপর করে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে।ওদের ছত্র-ভঙ্গ করার জন্য আর্মিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর”।আর তারপর সেইদিন রাত্রে শুরু হয়ে যায় নির্বিচারে হত্যা। কোথায় গেল ২৫ মার্চের অধিবেশন?এরপর হানাদার বাহিনী মাসের পর মাস হত্যাকান্ডের স্টিম রোলার চালিয়ে যায় বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর।যেমন ২৭ মার্চের বর্ণনায় ধ্বংসের চিত্র লক্ষ্যনীয় “সামনেই পুরো কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই হয়ে রয়েছে।এখনো কিছু ধোঁয়া উঠছে।আমি চেঁচিয়ে উঠলাম মানুষও পুড়েছে।ওই যে পোড়া চালের টিনের ফাঁকা দিয়ে”।
তাছাড়া লক্ষ্য করা যায় শহীদ মিনার দুমড়ে-মুচড়ে পড়ার বর্ণনা এবং ২৫ মার্চের হত্যাকান্ডে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি শহীদ হন।যেমন: পাক-সেনার গুলিতে শহীদ হন-মুনিরুজ্জামান স্যার,ড. জি.সি দেব, ড. এফ.আর খান, মি. এ. মুকতাদির, কমান্ডার মোয়াজ্জেম সহ আরো অনেকে।
এপ্রিলের ১, ৩, ১৩, ১৮, ২২ তারিখে লক্ষ্য করা যায় হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতনের দৃশ্য। ১ এপ্রিল দেখা যায় ত্রিপল ঢাকা ট্রাকে করে পেছনে হাত বাধা,চোখ বাধা অবস্থায় যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে হানাদার বাহিনী। ৩ এপ্রিল দেখা যায় জিঞ্জিরায় সাধারণ মানুষের উপর হানাদারদের নির্মম হত্যাকান্ড।তারা নির্বিচারে হত্যা করে বলে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।কচি বাচ্চা, থুথরে বুড়ো – কাউকে রেহায় দেয়নি জল্লাদরা। ১৩ এপ্রিল বর্ণনা করা হয়েছে নদীতে প্রচুর লাশ ভেসে যাওয়ার কথা।পেছনে হাত বাঁধা,গুলিতে মরা লাশ। জাহানারা ইমাম দুঃখে বলেছেন পঁচা লাশের দুর্গন্ধে মাছ খাওয়াই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। ২২ এপ্রিলের বর্ণনা, ” বাজারের পরিবেশ মোটেই ভালো লাগলো না।দগ্ধ, বিধ্বস্ত বাজারের মাঝে মাঝে দোকানি লোকগুলো কেমন যেন অস্বাভাবিক নির্বাক বসে আছে।চোখে বাবা দৃষ্টি, সারা বাজার পানিতে থৈ থৈ।… জানেন মামী, গতকাল নাকি বিহারিরা ঠাটারী বাজারে কয়েকজন বাঙালী কসাইকে জবাই করেছে”।
অনবরত কারফিউয়ের কথা বললে দেখা যায়,এরা কারফিউ জারী করে জনগণকে ঘরে আটকে রাখে, যাতে মারতে সুবিধা হয় আর বের হলে তো কপাল খারাপ।যেমন: ৯ এপ্রিল লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ৯ তারিখের বর্ণনায় পাঁচ তারিখে ৬ – ৬ টা, ছয় তারিখে ৭ – ৫ টা, আট তারিখে ৯ – ৫ টা। তাছাড়া ৩ ডিসেম্বর দেখা যায় ব্ল্যাক আউটের কথা।
বিহারি, রাজাকারদের ভয়াবহ কর্মকান্ড দেখা যায় ১৪, ২৩, ২৯, ৩০ এপ্রিলের বর্ণনায়।যেমন: ২৯ এপ্রিলের বর্ণনায় দেখা যায়,বিহারীরা বাস যাত্রীদের নামিয়ে ধারালো দা – চাকু এসব দিয়ে মারতে থাকে।লাশগুলো ব্রীজের ওপর থেকে নদীতে ফেলে দেয়। ৩০ এপ্রিলের বর্ণনায়, ” মর্গে যত লাশ দেখলাম,সব পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করা।পিচাশগুলো প্রথম কোঁপ দিয়েছে পেটে”।তাছাড়া মে মাসের ১, ৯, ২৩, ২৮ তারিখে অবরুদ্ধ ঢাকাসহ চট্রগ্রামের চিত্রও লক্ষ্য করা যায়। ১ মে এক ভয়াবহ্ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যেখানে বাঙালিদের ধরে ধরে সিরিঞ্জ দিয়ে শরীর থেকে সব রক্ত বের করে নিয়ে রক্তশূন্য করে মারার কথা। ৯ মে দেখা যায় হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে জাহানারা ইমামের এক আত্মীয়ের বেহাল দশা; ” বাসায় ফিরে ঘরে পা দিয়ে চমকে গেলাম। বসার ঘরে সোফায় বসে এক রোগা, পাতলা লোক,চুলদাড়ি সব সাদা,গর্তে ঢোকা চোখ,কপালে গভীর ভাঁজ।চিনতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম। তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললেন,’ সালাম আলায়কুম,আমি রসুল’।চিনতে পারেন নি, না?”
অর্থাৎ ভয়ে যুবক মানুষ বুড়ো হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ২৩ মে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ আছে, যেখানে এক জায়গায় ট্রাক থেকে কয়েকজন লোককে নামিয়ে একটি ঘরে নিয়ে চাবুক মারার দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। ২৮ মে বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে ঢাকার ভয়াবহতার কথা উল্লেখ আছে। টাইম ম্যাগাজিনে ড্যান কোগিন একটা প্রবন্ধ লিখেছেন, যার নাম “ঢাকা সিটি অব দা ডেড – লাশের শহর ঢাকা”।
তাছাড়া ধর্ষণ ও অত্যাচারের সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠেছে ২ জুলাই ১৯৭১।বর্ণনা হলো, ” ডাক্তার প্রায় আর্তনাদের মতো স্বরে বললেন, ধর্ষিতা মহিলা, অল্পবয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে প্রৌঢ় মহিলা,মা, নানী,দাদী – কেউ রেহায় পায়নি। অনেক বুড়ি মহিলা বাড়ি থেকে পালায় নি, ভেবেছেন তাদের কিছু হবে না।অল্প বয়সী মেয়েদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা থেকেছেন,তাদেরও ছেড়ে দেয়নি পাকিস্তানি পাষাণ্ডরা।এক মহিলা রুগীর কাছে শুনেছিলাম তিনি নামাজ পড়ছিলেন,সেই অবস্থায় তাকে টেনে রেপ করা হয়।আরেক মহিলা কোরান শরীফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কোরান শরীফ টান দিয়ে ফেলে তাকে রেপ করে”।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তখন সাধারণ মানুষ কে কোথায় যাবে?তা নিয়ে কেউ মন স্থির করতে পারে নি।কেউ ঢাকা থেকে জিঞ্জিরা, কেউ ধানমণ্ডি – আসাদগেট, কেউ মালিবাগ,আবার কেউ শহর থেকে গ্রামে।অর্থাৎ নরকীয় ভয়াবহতায় সবাই দিশেহারা অবস্থায় পড়ে গিয়েছে।
(৩) গেরিলাদের কাহিনী: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গেরিলাদের ভূমিকা অপরিসীম। জাহানারা ইমাম তার এই বইটি উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও জীবিত গেরিলার উদ্দেশ্যে।গেরিলা, মুক্তিফৌজ এদের বর্ণনা মে মাস থেকে পাওয়া যায়।মে মাসের ৩, ৭, ১১, ২২, ২৫ তারিখে গেরিলাদের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন: রুমি গেরিলা বাহিনীর সাথে যোগ দিবে, কিন্তু কীভাবে যাবে? কোথায় যাবে? কোন কথা তার মায়ের কাছে বলবে না।কারন গেরিলাদের আচারণই এরকম।তাদের কোন সূত্র থাকবে না। ৩ মে বলা হয়েছে ” রুমি এখন নিজের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে,তার একান্ত নিজস্ব ভুবন, সেখানে তার জন্ম-দাত্রীরও প্রবেশাধিকার নেই”। ৭ মে রুমি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য রওয়ানা হয়,কিন্তু পথে বিপদ থাকায় আবার ১৪ মে গেরিলা বাহিনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২৫ মে দেখা যায় গেরিলাদের অভিযানের কথা। বর্ণনা করা হয়েছে ” ঢাকার ছ’ জায়গায় গ্রেনেড ফেটেছে,আমরা তো সাত আটদিন আগে এরকম গ্রেনেড ফাটার কথা শুনেছিলাম,কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করি নি।ব্যাপারটা তাহলে সত্যি? আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো।… এতদিন জেনেছিলাম বর্ডার ঘেষা অঞ্চলগুলোতেই গেরিলা তৎপরতা।এখন তাহলে খোদ ঢাকাতেও”।
১২ জুন ইন্টারকনে গেরিলাদের বোম্বিংয়ের বর্ণনা আছে।তখন ইন্টারকনে ছিলো ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মিশনের লোকজন, ইউনাইটেড নেশনস এর পাকিস্তানি সদস্য প্রিন্স সদরুদ্দিন।
৩০ জুনের বর্ণনায় বলা হয়েছে ” মিসেস হোসেনের অনেক আত্মীয়ের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে।এক বোনের এক দেওরের এক ছেলে সম্প্রতি ঢাকায় এসেছে।সে বলেছে রুমী আগরতলার কাছাকাছি এক ক্যাম্পে আছে”।
জুলাই মাসের ৩, ৫, ৭, ১৮, ২০ তারিখে গেরিলাদের প্ল্যান ও অভিযানের কথা বলা হয়েছে। ৩ জুলাই খালেদ মোশাররফ বাংলাদেশের সবকয়টা ব্রিজ ও কালভার্টের তালিকা চেয়েছেন,যাতে ব্রিজ ও কালর্ভাট ধ্বংস করার মাধ্যমে হানাদারদের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেওয়া যায়। ৭ জুলাই শরীফ ও বাঁকা দুজনে ৩৫০০ টি ব্রিজ ও কালভার্টের তালিকা তৈরি করেন এবং খালেদ মোশাররফ এর কাছে পাঠানোর চেষ্টা করেন। ২০ জুলাই ধানমণ্ডির পনেরো নম্বর রোডে গেরিলাদের আক্রমণ, মোটরগাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া, উলান, গুলবাগে পাওয়ার স্টেশনের ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দিয়ে ঠিকমত ভেগে যাওয়া ইত্যাদি গেরিলা অভিযানের কথা পাওয়া যায়।
অাগস্ট মাসে গেরিলাদের বিস্তর অভিযান,গেরিলাদের ক্যাম্প,চিকিৎসা, খাদ্যাভাস এবং কে কে গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।যেমন: কয়েকজন গেরিলার নাম হলো- রুমি, শাহাদাত, আলম, চুল্লু, আজম, বদি, জুয়েল, চিন্নু, স্বপন, কাজী, আজাদ, সেলিম, হ্যারিস, মুক্তার, জিয়া, আনু, ওয়াহিদ, চিংকু, ডা. আখতার আহমদ, ডা. নাজিম, ড. জাফুরুল্লাহ্, খালেদ মোশাররফ( ২নং সেক্টর কমান্ডার) , লে. কমান্ডার এ.টি.এম হায়দার সহ অনেকে।
এরা সবাই বিভিন্ন পেশাজীবির লোক।কেউ কৃষক, কেউ কলেজ ছাত্র, কেউ সামরিক বাহিনীর লোক, কেউ ডাক্তার। এ সম্পর্কে ৮ আগস্টে বর্ণনা করা হয়েছে ” মেলাঘরে গিয়ে দেখি — ঢাকার যত কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা, ধানমণ্ডি – গুলশানের বড়লোক বাপের গাড়ি হাঁকানো ছেলেরা, খেলার মাঠের চৌকস ছেলেরা, ছাপোষা চাকুরে বাবার ছেলেরা, সবাই ওখানে জড়ো হয়েছে।সবাই যুদ্ধ করার জন্য গেছে”। ২০ আগস্ট তাদের খাবারের,ঘুমানোর ব্যাপারে বলা হয়েছে, শুধু ডাল আর ভাত,কখনো নুন দিয়ে, কখনো ঘ্যাঁট, কখনো-সখনোমাছ। তারা চাটাই পেতে ঘুমাতো,তাদের উপর দিয়ে কেঁচো,বিছে, চলে যেত। তাদের খাবারের প্লেট ছিলো গ্রেনেডের খালি বাক্স, মাটির সানকি। তাদের প্লেট দিতে চাইলে তারা বলে, ” আমরা বাসন প্লেট চাই না,তার বদলে আমাদের বুলেট দিতে বলুন”। তাছাড়া আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ রুমি, কাজী, স্বপন, বদি, সেলিমরা ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর ও পাঁচ নম্বর রোডে যথাক্রমে এম.পি ও এক ট্রাক হানাদার বাহিনীকে খতম করে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে গেরিলারা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গেরিলা সম্পর্কে ২১ আগস্টের বর্ণনায় পাওয়া যায় একটি চমৎকার কথা। রুমি তার মাকে বলে, ” আমাদের সেক্টর কমান্ডার কি বলেন, জান? তিনি বলেন, ‘ কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না ; চায় রক্তস্নাত শহীদ। অতএব মা মণি, আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাব — এই কথা ভেবে মনকে তৈরি করেই এসেছি”।
গেরিলাদের ক্যাম্প বা হেটকোয়াটার্সয়ের কথা বললে দেখা যায়, তা বিভিন্ন জায়গায় তাদের সুবিধামত স্থানান্তরিত করা হয়েছে। যেমন: মতিনগর – মেলাঘর – তেলিপাড়া – ভারতের সোনায়মুড়া – ডাকবাংলা – দারোগা বাগিচা – বিশ্রামগঞ্জ।
২৯, ৩০ আগস্ট;
যারা ২৫ আগস্টে মিলিটারি মেরেছে,তাদের প্রত্যেককে তাদের পরিবার – পরিজন সহ গ্রেপ্তার করা হয়।২৯ আগস্ট রুমি ধরা পড়ে রাত বারোটায়, সামাদ বিকেল চারটায়, জুয়েল, আজাদ, বাশার সহ তার খালাতো বোনের স্বামী রাত বারোটায়,চুল্লু রাত সাড়ে বারোটায়, স্বপন ১.৩০ – ২ টার মধ্যে, আলতাফ মাহমুদ ভোর পাঁচটায়।
এভাবে বেশ কয়েকজন গেরিলাদের ধরার পর তাদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়।গেরিলাদের উপর এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের উপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে,তা ১, ২ সেপ্টেম্বর এ বর্ণিত হয়েছে। অফিসাররা যখন বন্দিকে প্রশ্ন করে, তখন তাদের প্রশ্ন না সূচক হলে অমনি পড়ে লাঠির বাড়ি, লাথি,রাইফেলের বাঁটের গুঁতো।আবার তারা বন্দিকে সিলিংয়ের হুকে ঝুলিয়ে পাঁকানো দড়ি দিয়ে সপাসপ পেটায়। কাউকে উপুড় করে শুইয়ে দুই হাত পেছনে টেনে পা উল্টোদিকে মুড়ে তার সাথে বেঁধে দেয়, দেহটা হয়ে যায় নৌকার মতো। বেশি ত্যাড়া কোন বন্দির পা দুটো সিলিংয়ের ফ্যানে ঝুলিয়ে জোড়ে পাখা ছেড়ে দেয়।
১ সেপ্টেম্বরের বর্ণনায় আছে, ” আলতাফ মাহমুদের গেঞ্জি বুকের কাছে রক্তে ভেজা,তার নাক মুখে তখনো রক্ত লেগে রয়েছে, চোখ ঠোঁট সব ফুলে গেছে, বাশারের বাঁ হাতের কবজি ও কনুইয়ের মাঝামাঝি দুটো হাড়ই ভেঙ্গেছে।… হাফিজের নাকে মুখে রক্ত, মারের চোটে একটা চোখ গলে বেরিয়ে এসে পড়েছে এবং গালের উপর ঝুলছে।জুয়েলের এক মাস আগের জখম হওয়া আঙ্গুল দুটো পাটকাঠির মতো মুচড়ে ভেঙ্গে দিয়েছে”।
৪ সেপ্টেম্বর দেখা যায় মতিয়ুর রহমান প্লেন হাইজ্যাকে শহীদ হয়।তার সম্পর্কে পাকিস্তানিরা বিশ্বাসঘাতক বললে; জাহানারা ইমাম বলে, ” যদি কোনদিন পূর্ব বাংলার এই ভূখন্ড স্বাধীন হয়,তবে মতিয়ুর রহমান — সেই স্বাধীন দেশ নিশ্চয় তোমাকে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত করবে”।
অক্টোবর-নভেম্বর পুরো মাস গেরিলারা ঢাকায় একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকে এবং হানাদার বাহিনীদের দিশেহারা অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়।যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য বাঙালির কাছে আত্মসমর্পণ করে।
(৪)মায়ের ভূমিকা: ‘একাত্তরের দিনগুলি’ জাহানারা ইমাম রচিত একটি স্মৃতিকথামূলক দিনলিপি। কিন্তু এটা কি শুধু দিনলিপি, এর মধ্যে কি শুধু গদগদ বাক্যের পাল? না, এই দিনলিপি এমন একটি বই,যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল,বাংলা সাহিত্যের এক উচ্চ মর্যাদাশীল সাহিত্য-কর্ম। এই দিনলিপির লেখক একজন মা,যে তার সন্তানকে তার চিরশান্তির আঁচল পাতা কোল থেকে একমাত্র দেশের জন্য ত্যাগ করেছে,যে ছেলে মাকে একনজর না দেখে থাকতে পারতো না, ছেলে চলে যাওয়ার পর লেখকের মনে হয়,যেন লোহার সাঁড়শী দিয়ে কেউ তার বুক চেপে ধরে।সেই রুমী এবং অন্যান্য গেরিলাদের মা হয়ে তিনি হৃদয়ছেঁড়া ব্যাথা নিয়ে নির্মাণ করেছেন এক অমোঘ নিরেট বাস্তবতা সমৃদ্ধ এক দিনলিপি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন রুমী শহীদ হয়নি,লক্ষ্য-লক্ষ্য রুমি শহীদ হয়েছে।আর এই লক্ষ্য-লক্ষ্য রুমীর মা হলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।একজন মা হিসেবে যুদ্ধকালীন সময়ে জাহানারা ইমামের যে ত্যাগ,ধৈর্য্য, ভালোবাসা তা অভুতপূর্ণ। যা পুরো মার্চ – ডিসেম্বর এই দশ মাস জুড়ে লক্ষ্য করা যায় তার এই স্মৃতিকথায়।মা হিসেবে লেখিকার ভূমিকাগুলো বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে ১৭ মার্চ, ২৭ মার্চ, ২১ এপ্রিল, ৩ মে, ১, ৮, ২৮ আগস্ট, ৩, ৫, ৬, ৯, ১৪, ১৯ সেপ্টেম্বর, ৩১ অক্টোবর ও ১৭ ডিসেম্বর।
১৭ মার্চে দেখা যায়, যখন রুমী বিভিন্ন সভা সমিতিতে যোগদান করতে শুরু করে,তখন জাহানারা ইমাম তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন,রুমীকে যেতে বাধা দিলেও সে তার কথা মানে না। একপর্যায়ে তার এক আত্মীয়, যে কিছুটা গনক টাইপের, তাকে রুমীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, ‘ওকে একটু সাবধানে রাখবেন’।তখন জাহানারা ইমাম বলেন, “ঐ সব সাবধানে রাখার কথা বাদ দিন।আমার কপালে পুত্রশোক আছে কি না,তাই বলুন? ওটা থাকলে লখিন্দরের লোহার ঘর বানিয়েও লাভ নেই”। অর্থাৎ দেশের জন্য কতটুকু প্রস্তুত এই মাতৃহৃদয়, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
২১ এপ্রিল এই আত্মত্যাগ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।রুমীর একটা স্বভাব সে কোন কাজ করতে গেলে মায়ের অনুমতি নিয়ে করবে,কারন তার মা তাকে এই শিক্ষা দিয়েছে।রুমী যখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যেতে চায়,তখন তার মা তাকে নিষেধ করলে,সে তার মাকে নানাভাবে বুঝায় যে, “ছাত্রজীবন লেখাপড়া করার সময়।কিন্তু ১৯৭১ এপ্রিল মাসে এই সত্যটা মিথ্যা হয়ে গেছে,এই সময়টা সমস্ত দেশ পাকিস্তানি বাহিনীর জান্টার টার্গেট প্র্যাকটিসের জায়গা হয়ে উঠেছে।তাই আমরা বসে থাকবো না,আমরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো,তাই তো যেতে চাই”।অবশেষে জাহানারা ইমাম রুমির সাথে যুক্তি তর্কে না পেরে হৃদয় গোলাপকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।২১ এপ্রিল বর্ণিত আছে, ” আমি জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম, ‘ না, তা চাই না।ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম।দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে।যা,তুই যুদ্ধে যা”।
রুমী যখন গেরিলা বাহিনীতে যাবে, তখন কিভাবে যাবে,কার সাথে যাবে, তা জানতে চাওয়া হলে রুমী বলে গেরিলাদের কথা বলা যাবে না।অর্থাৎ মাকেও বলে না দেশের রত্নদের কথা।এই বিষয়টি ৩ মে বর্ণিত আছে।সেখানে আছে, ” রুমী এখন তার নিজের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে,তার একান্ত নিজস্ব ভুবন,সেখানে তার জন্ম-দাত্রীরও প্রবেশাধিকার নেই”।অর্থাৎ লেখিকার পাঁজর কে যেন লোহার সাড়সী দ্বারা চেপে ধরেছে।
রুমী যে গেরিলা হয়ে গেছে, এতে মায়ের কোন দুঃখ নেই,কিন্তু সে যে তার মানিককে এক নজর দেখতে পাচ্ছে না,এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে? তা সমস্ত আগস্ট মাস জুড়ে বর্ণনা করা হয়েছে। ১ আগস্ট আছে, ” রুমী গেছে আটচল্লিশ দিন হলো। মনে হলো আটচল্লিশ মাস দেখে নি”।
২৮ আগস্ট রুমী যখন তার মাকে টম জোনসের ‘গ্রীন গ্রীন গ্রাস’ গানটির বাংলা অনুবাদ শোনাল।যেখানে এক ফাঁসির আসামীর কথা বলা হয়েছে।সেই কাহিনী শুনে জাহানারা ইমাম বলেন, ” চুপ কর রুমী,চুপ কর; আমার চোখে পানি টলমল করে এল।হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললাম, রুমী। রুমী এত কম বয়স তোর,পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না।জীবনের কিছুই তো জানলি না।তখন রুমী বললো, বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা?হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো জানি না, ভোগও করি নি,কিন্তু জীবনের যত রস – মাধুর্য – তিক্ততা – বিষ – সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা।যদি চলেও যাই,কোন আক্ষেপ থাকবে না”।
৫ সেপ্টেম্বর শুধু জাহানারা ইমাম না শরীফও তাদের ছেলে রুমীর ছাড়ার ব্যাপারে মার্সি পিটিশন করতে নারাজ।এতে রুমীর আর্দশ ক্ষুণ্ণ হবে।কতটুকু দেশপ্রেম থাকলে যা সম্ভব,তা এখান থেকে বুঝা যায়।এরপর ৭ সেপ্টেম্বর আজাদের মায়ের কতটুকু ত্যাগ- ভালোবাসা দেশের রত্নদের প্রতি, যা তার নিজের ছেলের প্রতি অত্যাচারের কথা স্মরণ করেও বলে, ” বইনরে। বড্ড মারছে আমার আজাদরে।আমি কইলাম বাবা কারো নাম বল নাই তো? সে কইল,’না মা, কই নাই।কিন্তু মা, যদি আরো মারে? ভয় লাগে,যদি কইয়া ফেলি, ‘ বাবা,যখন মারবো,তুমি শক্ত হইয়া সহ্য কইরো”।
এরপর ৯ সেপ্টেম্বর থেকে দেখা যায় জাহানারা ইমাম রুমীর জন্য বিচলিত হয়ে পড়েছে।যে কখনো পীর বিশ্বাস করেনি,সেই এখন পীরের কাছে দিনের পর দিন ধর্ণ্য দেয়।হানাদার তার ছেলেকে কোথায় নিয়ে গেল? ছাড়ছে না কেন? পীরের কাছে জিজ্ঞাসা করে।শুধু লেখিকা নয়,সব শিক্ষিত পরিবারের লোকজন পীরের কাছে ছুটে,কারো স্বামী, কারো ছেলের খোঁজ করার জন্য।অর্থাৎ মানুষের মন যে বুদ্ধিহীন,তা প্রমাণিত,ভালোবাসার কাছে সব গ্রহণযোগ্য।
সর্বশেষ,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যেদিন স্বাধীনতার সূর্য উঠলো,সেদিন মা হিসেবে; শুধু রুমী না,সকল মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলাদের মা হয়ে জাহানারা ইমাম বলতে লাগলো, আজ যদি রুমি, আজাদ এরা থাকতো, তাহলে সবাই এই স্বাধীনতা পেয়ে কতই না খুশি হতো!
১৭ ডিসেম্বর যেদিন ভোরে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো,সেইদিন রুমি কখন আসবে, তা ভেবে মাতৃহৃদয় আকুল হয়ে ওঠলো।কিন্তু রুমী আর আসলো না,আসলো রুমীর সহযোদ্ধারা; শাহাদাত, আলম,আনু,জিয়া,ফতে,চুল্লু এবং স্বয়ং ক্যাপ্টেন হায়দার।
শেষ বর্ণনার মধ্যে লেখিকা বলেছেন, “আমি ওদেরকে হাত ধরে এনে ডিভানে বসালাম।আমি শাহাদাতের হাত থেকে চাইনিজ স্টেনগানটা আমার হাতে তুলে নিলাম।ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম।তারপর সেটা জামীর হাতে তুলে দিলাম।চুল্লু মাটিতে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসল।আমার দুইহাত টেনে তার চোখ ঢেকে আমার কোলে মাথা গুঁজল।আমি হায়দারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ জামী পারিবারিক অসুবিধার কারনে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারে নি।ও একেবারে পাগল হয়ে গেছে।ওকে কাজে লাগাও”।
এক সংগ্রামী দেশপ্রেমিকের স্ত্রী, এক দৃঢ়চেতা বাঙালি নারী আমাদের সকলের হয়ে সম্পাদনা করেছেন এই মূল্যবান কাজ।বুকচেরা আর্তনাদ নয়,শোকবিহ্বল ফরিয়াদ নয়,তিনি গোলাপকুঁড়ির মতো মেলে ধরেছেন আপনার নিভৃততম দুঃখ অনুভূতি।তার ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি তাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের সকলের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে,তার আপনজনের গৌরবগাঁথা যুক্ত হয়ে যায় জাতির হাজারো বীরগাঁথার সঙ্গে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী,বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Views: 36
চলমান নিউইয়র্ক ফেসবুক পেজ লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন